সঞ্চয় তলানিতে ভাঁড়ারে টান খাব কী? বাঁচব কীভাবে?

সঞ্চয়ের পরিমাণ কমলে অথনৈতিকভাবে রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে। বর্তমান পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের আর্থিক সমৃদ্ধি ক্রমশ তলানিতে ঠেকেছে। কোভিড সময়কাল থেকে বহু মানুষ মধ্যবিত্তের তকমা হারিয়েছেন। সারা দেশে যতটা নিম্নবিত্ত মানুষকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হয়, তার ১ শতাংশ ভাবনাও মধ্যবিত্তদের নিয়ে হয় না। লিখছেন অধ্যাপক ড. রূপক কর্মকার

Must read

বর্তমান পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের আর্থিক সমৃদ্ধি ক্রমশ তলানিতে এসে ঠেকেছে। যত দিন যাচ্ছে ক্রয়ক্ষমতা তত কমছে। ক্রয়ক্ষমতা নির্ধারণের জন্য মূল্যস্ফীতি বা মুদ্রাস্ফীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পণ্য ও পরিষেবার দামের তারতম্য ঘটতে থাকে। মুদ্রাস্ফীতির ফলে আপনাকে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হয় আপনার প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংগ্রহ করতে, যার ফলে আপনার সঞ্চয়ের ওপর কোপ পড়তে বাধ্য। গত একদশকে ভারতে মুদ্রাস্ফীতি সমান্তরাল রেখায় চলছে। যা বিনিয়োগকারীদের জন্য সবসময়ই সমস্যা তৈরি করে। মুদ্রাস্ফীতি সাধারণত আমরা জানি ব্যক্তিগত অর্থের স্বেচ্ছামৃত্যু। ভারতবর্ষে সাধারণত দুটি সূচক মুদ্রাস্ফীতি পরিমাপ করে, একটি হল ভোক্তা মূল্যসূচক (Consumer price index) এবং অন্যটি হল পাইকারি মূল্যসূচক (Wholesale price index)। ভোক্তা মূল্যসূচক সাধারণত প্রতিফলিত করে ভোক্তারা কী পণ্য ও পরিষেবা কেনেন তাদের দামের পরিবর্তন কে।

আরও পড়ুন-১ ডিসেম্বর থেকে শুক্রবার পর্যটকদের জন্য বন্ধ সুন্দরবন, বসছে ক্যামেরা, শুরু বাঘ শুমারি

পাইকারি মূল্যসূচক সাধারণত পাইকারি পর্যায়ে পণ্যের দামের গড় পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করে। মুদ্রাস্ফীতি অর্থনীতির একটি পরিচিত মুখ হলেও বড় ধরনের মুদ্রাস্ফীতি হলে কিন্তু অর্থনীতির ধ্বংসের কারণ হিসাবেও ব্যাখা করা যায়। কোভিড অতিমারি থেকে ভারতবর্ষ বেরিয়ে এলেও অর্থনীতির বিরূপ প্রভাব কিন্তু দৃশ্যমান। একটি সহজ সমীকরণে যদি মুদ্রাস্ফীতি বোঝাই তাহলে বলতে পারি, ধরুন গত মাসে ১ কেজি চাল কিনতে খরচ হয়েছে ৫০ টাকা। কিন্তু চলতি মাসে সেই চাল কিনতে ৫৫ টাকা খরচ হয়েছে। একমাসে ৫ টাকা বা ১০ শতাংশ বেশি খরচ হল সমপরিমাণ চাল কিনতে। অথাৎ এই ১০ শতাংশ হল মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ। আবার অন্যভাবে বলতে পারি ১০ শতাংশ টাকার দাম কমে গেছে। মুদ্রাস্ফীতি নানাবিধ কারণে হতে পারে, যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা যুদ্ধ পরিস্থিতি বা পণ্য ও সেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে অসুবিধা হলে, রাজস্বনীতির পরিবর্তনে বা মুদ্রানীতির পরিবর্তনে এছাড়াও নানাবিধ কারণে। একটু বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে কেন বাজার এমন অস্থির, করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ববাজারে পণ্যের দামে ওঠা-নামা, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি তো ছিলই এ-ছাড়াও অসাধু ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। যার কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা চড়া দামে পণ্য কিনছে এবং খুচরো বাজারে পণ্যের মূল্য বেড়ে অস্থিরতা তৈরি করছে। আমরা জানি কয়েকটি পণ্যের দামের ওঠা নামার ওপর মূদ্রাস্ফীতি নির্ভর করে না, সামগ্রিক ভাবে পণ্য ও সেবার মূল্য বাড়ার ফলেই মুদ্রাস্ফীতি ঘটে। আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে বসবাস করে। তারা যা আয় করে তার বেশিরভাগটাই সংসারের পিছনে ব্যয় করে। সুতরাং সঞ্চয় করা তাদের কাছে বিলাসিতার সমান। আর আমরা এটাও বলতে পারি সঞ্চয়ের পরিমাণ কমে গেলে অথনৈতিক ভাবে রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পরিকাঠামোগত দিকগুলো নড়বড়ে হয়ে যায়। কোভিড অতিমারির সময়কাল থেকে বহু মানুষ মধ্যবিত্তের তকমা হারিয়েছেন। সারাদেশ এমনকী বিশ্বব্যাপী যতটা নিম্নবিত্ত মানুষকে নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হয়, তার ১ শতাংশ ভাবনাও মধ্যবিত্তদের নিয়ে করা হয় না। অথচ এই মধ্যবিত্তরাই কিন্তু বেশি পরিমাণে সঞ্চয় করে থাকে। এই সমাজের ৫-১০ শতাংশ মানুষ হয়তো ভাবে কোথায় সঞ্চয় করলে সর্বাধিক রিটার্ন পাওয়া যায়। আর ৬০-৭০ শতাংশ মানুষ ভাবে মাসের শেষে আমরা কত টাকা সঞ্চয় করতে পারব। আর এই সঞ্চয় কিন্তু শুধু বেশি রিটার্ন পাওয়ার জন্য নয়, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনার জন্যও বটে।

আরও পড়ুন-১৫ ডিসেম্বর থেকে ক্যাম্প ডায়মন্ড হারবারের ৭ কেন্দ্রে, অভিষেকের উদ্যোগে ‘হেলথ ফর অল’

আমরা যদি বিগত কয়েকমাসের ভোক্তা মূল্যসূচক দেখি তা সাধারণত এইরকম— জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ভোক্তা মূল্যসূচক হল যথাক্রমে ৫.০৮, ৩.৫৪, ৩.৬৫, ৫.৫ ও ৬.২১ শতাংশ। (তথ্যসূত্র : Forbes উপদেষ্টা ও Computer Centre @GoIStats)। সাধারণত ৫ শতাংশের নিচে থাকলে যদিও সেটা সহ্য করা যায়, কিন্তু তার থেকে ছাড়িয়ে গেলে সাধারণ মানুষের কাছে অসহনীয় হয়ে ওঠে। উপরের দেওয়া তথ্য থেকে আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি ভারতবর্ষের মানুষ কী পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। মানুষ যদি তাদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে সব অর্থ ব্যয় করে দেয়, তাহলে সঞ্চয় কোথা থেকে হবে? করোনাকালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প সাড়া ফেলে দিয়েছিল। শুধু সংসার চালানোর জন্য সহায়তাই নয়, গৃহিণীরা সঞ্চয়ের উপায় খুঁজে পেয়েছিল। এবং তাবড়-তাবড় অর্থনীতিবিদদের মতে হাতে অর্থের জোগান ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করে শুধু নয়, বাজারকেও সচল রাখে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য টাস্ক ফোর্স গঠন করে নিয়মিত বাজারে নজরদারি চালাচ্ছে যাতে ক্রেতারা সুলভ দামে প্রয়োজনীয় দ্রব্য কিনতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আরও একটি পদক্ষেপ সুফল বাংলা নামে প্রকল্প, যেখানে মানুষ ন্যায্য দামে প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে পারে। সুফল বাংলা প্রকল্পে নথিভুক্ত চাষি, খামারপালক ও মৎস্যজীবীদের কাছ থেকে সরাসরি পণ্য কেনা হয় এবং তা নামমাত্র লাভ রেখে সরকারি স্টলের মাধ্যমে সেগুলো বিক্রি করা হয়। এর ফলে চাষিরাও যেমন ন্যায্য দামে তাদের জিনিস বিক্রি করতে পারবেন এবং ক্রেতারাও সুলভ মূল্যে জিনিস কিনতে পারবেন। সীমিত ক্ষমতার মধ্যে থেকেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য। সাধারণ মানুষের সঞ্চয় তাদের ভবিষ্যতের একমাত্র অবলম্বন। সেই অবলম্বন তৈরি করার জন্য যদি সরকার তাদের হাত বাড়িয়ে না দেয় তাহলে সেটা সরকারের ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। সঞ্চয় তখনই হবে যখন জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসবে। আর এইক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার কী ভূমিকা নেয় সেটাই এখন একমাত্র দেখার বিষয়।

Latest article