অসভ্যতামি এদের যেন বহুকালাগত পরম্পরা

যাদবপুরে ফের অভব্যতা। মূলে সেই বাম আর অতি-বাম ছাত্রদের উচ্ছৃঙ্খলতা। শিক্ষাঙ্গনে ফের একটা কালো দিন। তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে আক্রমণ করে যদি কেউ ভেসে থাকতে চায়, তাহলে বাধা দেব না। বিষয়টা কিন্তু মাত্রা ছাড়িয়েছে। মনে রাখবেন তৃণমূল কংগ্রেসও বামপন্থী। তবে স্তালিনিস্ট, লেনিনিস্ট বামপন্থা থেকে পৃথক দক্ষিণ আমেরিকার বামপন্থী দলগুলির সঙ্গে তুলনীয়। আলোচনায় বারাসত কলেজের শিক্ষক ড. রূপক কর্মকার

Must read

শুন্যতার বহিঃপ্রকাশ যে এত ভয়ঙ্করদর্শন দিতে পারে তা স্বচক্ষে না দেখলে উপলব্ধি করা সম্ভবপর নয়। ছাত্রাবস্থায় চোখের সামনে বাম ছাত্র সংগঠনের বিশৃঙ্খলতা দেখার অভ্যাসটা নতুন নয়। আর শিক্ষক হিসেবে সেটা আবারও দেখতে হবে সেটা হয়তো অনুমান করতে পারিনি। আজ অধ্যাপক সংগঠনের একজন প্রতিনিধি হিসেবে ওয়েস্ট বেঙ্গল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক সমিতি (ওয়েবকুপা) সম্মেলনে যাব তা আগে থেকেই ঠিক ছিল এবং জায়গাটা যদি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় হয় তাহলে উদ্দীপনার মাত্রাটা একটু বেড়ে যায় বইকি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এই সময়কালে রাজ্যের প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয় সমৃদ্ধ হয়েছে।

আরও পড়ুন-যাদবপুর ক্যাম্পাসে শিক্ষামন্ত্রীর ওপর হামলায় ধৃত প্রাক্তনী বীরভূমের সাহিল

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ভারতবর্ষ তথা বিশ্বের এক অন্যতম সুসমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে পড়ুয়ারা পড়তে পারবে সেটাই সব থেকে বড় গর্বের, এবং আমরা অধ্যাপক-কুল সেখানে কোনও সম্মেলনে যোগদান করব সেটাই বা কম কীসের? কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরে যে ঘুণ ধরেছে তা যেন জনসমক্ষে বিকশিত। একটি সুশৃঙ্খল সম্মেলন কীভাবে বানচাল করা যায়, তার চিত্রপট যে আগে থেকেই রচিত তা আমাদের বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনওই চান না শিক্ষাঙ্গনে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হোক। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীন ভাবে চলবে সেখানে পঠন-পাঠন উন্নতমানের হবে সেটাই কাম্য। এতদিন যাবৎ আমরা দেখেছি যখনই কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন হয়েছে সেখানে পুলিশ প্রশাসনের ওপর নিষেধাজ্ঞা রাখা হয়েছে, যাতে ছাত্রছাত্রীদের গায়ে পুলিশের হাত না পড়ে। এটাই তো রাজ্যের কোনও প্রশাসনিক প্রধানের নির্দেশ হবে।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু ও সেই একই নির্দেশ পালন করেছেন। বাম, অতিবাম, নকশালপন্থী ছাত্র-ছাত্রী বললে ভুল হবে, বলা ভাল দুষ্কৃতীদের দ্বারা ঘেরাও, কটূক্তি, ধাক্কাধাক্কি হওয়া সত্ত্বেও পুলিশ প্রশাসনের সাহায্য নেয়নি। আসলে আমরা যারা শিক্ষক সমাজ ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধা অসুবিধাটাই আগে দেখি, তাদের থেকে এইরকম তালিবানি সমাদর পাব তা হয়তো ভাবনারও অতীত। ছাত্রদের দাবিদাওয়া থাকবে, আন্দোলন হবে, ঘেরাও হবে, শেষে আলোচনা হবে এই সবই তো সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশের অঙ্গ। কথা বলার স্বাধীনতা থাকবে, যুক্তি-তর্ক থাকবে, তবে তো বোঝা যাবে রাজনৈতিক ভাবে রাজ্য কতটা সুসংহত। আমার সঙ্গে যখন আমার সহযোদ্ধারা (অধ্যাপক ওমপ্রকাশ মিশ্র, অধ্যাপক মনোজিৎ মণ্ডল, অধ্যাপিকা চন্দনা সাহা, অধ্যাপক মিঠু রায়, অধ্যাপক রমেশ বর্মণ, অধ্যাপক প্রদীপ্ত মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক চঞ্চল মণ্ডল, অধ্যাপক সত্যজিৎ দে) এছাড়া আরও অনেক অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা বাম অতি-বাম হুলিগানদের দ্বারা চরম হেনস্থার শিকার হচ্ছে, এমনকী মহিলাদের কাপড় ছিঁড়ে দেওয়ার মতন ঘটনাও ঘটেছে, সেই পরিস্থিতিতে নিজেদেরকে রক্ষা করাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জের।

আরও পড়ুন-উৎসর্গ করল নিজের জীবন, বান্ধবগড়ে বাঘের মুখ থেকে মনিবকে ফিরিয়ে আনল জার্মান শেফার্ড

আন্দোলনের সূত্রপাতেই শিক্ষামন্ত্রীর তরফ থেকে বারংবার আলোচনায় বসার আবেদন করা সত্ত্বেও আন্দোলনকারীরা বিশৃঙ্খলা লক্ষ্যেই অনড় ছিলেন। এখানে বলে রাখা ভাল সম্মেলনের উদ্যোক্তারা আগে থেকেই ঘোষণা করেছিল সম্মেলনের শেষে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী প্রেসের মুখোমুখি হবেন। কোনও সুষ্ঠু পরিবেশে সরকারের কোনও দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর ওপর শুধু নয়, তাঁর দেহরক্ষীদের ওপর এমনকী অনেক গুণিজনদের ওপর এহেন আক্রমণ পূর্বে কখনও সংগঠিত হয়েছে কিনা তা কিন্তু স্মৃতির অগোচরে। সত্তরের দশকে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য গোপালচন্দ্র সেনের খুনের ইতিহাসের কালো ছায়া আজ আবারও যেন কোথাও কোথাও উঁকি মারছিল এই আন্দোলনের আড়ালে। গাড়ির কাঁচ ভেঙে দেওয়া হচ্ছে, গাড়ির চাকার হাওয়া খুলে দেওয়া হচ্ছে, সত্যি যেন আমরা অন্য কোনও এক জগতে ছিলাম। আসলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে ভিন গ্রহের কোনও প্রাণীর মতো করে তৈরি করে রাখা হয়েছে, দূর থেকে দেখা যাবে কিন্তু কাছাকাছি যাওয়া যাবে না। আর ভিতরে কিছু বাম, অতি-বাম, নকশালপন্থী ছাত্রবেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নষ্ট করবে। তার উদাহরণ আমরা চোখের সামনে দেখে এলাম। এর আগেও আমরা দেখেছি স্বপ্নপুরী যাদবপুর কীভাবে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। ২০২৩ সালে লাগাতার র‍্যাগিং ও যৌন নির্যাতনের জেরে এক ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনায় দেশ তোলপাড় হয়েছিল। সেই দুঃস্বপ্নের রাত কিন্তু মানুষ আজও ভোলেনি। আবার কিছুদিন আগেই এক তরুণীর শ্লীলতাহানির ঘটনায় তোলপাড় পড়ে গিয়েছিল। ইউজিসির নিয়ম অনুযায়ী যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের জন্য পৃথক ছাত্রাবাস চালু হয়েছে, কিন্তু যাদবপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই নিয়ম কতটা কার্যকর হবে সেই বিষয়ে আমরা যথেষ্ট সন্দিহান। আবার কর্তৃপক্ষের মতে ১০টায় হস্টেল বন্ধ করা হলে স্বাধীনতার ওপর নাকি হস্তক্ষেপ করা হয়, অর্থাৎ এদের আবদার এতটাই মাত্রাতিরিক্ত যে হয়তো সারারাত হস্টেল খুলে রাখলেই ভাল। আরও আগে ফিরে গেলে সিসিটিভি বসানো নিয়েও আমরা আন্দোলন দেখেছি এবং সেখানে প্রাক্তন উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীকে পদত্যাগ করতেও দেখেছি।

আরও পড়ুন-কাঁথি জেলা তৃণমূলের সাধারণ সভায় ভুয়ো ভোটার রোখা, জনসংযোগে জোর

আসলে বাংলার শিক্ষাজগৎ বাম রাজনীতির কালো ছায়া থেকে এখনও সম্পুর্ণ মুক্ত হয়নি তা আজকের ঘটনা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। বিরোধী রাজনীতির দলের আদর্শে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় চললেও তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার গঠনের পর কখনও সেইখানে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলায়নি, এমনকী মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে তৃতীয় ক্যাম্পাস গঠনের জন্য নিউ টাউনে পাঁচ একর জমিও দিয়েছেন। তবে ছয় বছর অতিক্রম করার পরও সেইখানে এখনও কাজ শুরু করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আসলে আজকের দৃশ্য দেখার পর কিছুটা ভয় ধরেছে মনে তাদের জন্য যারা দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে অনেক স্বপ্ন নিয়ে যাদবপুরে পড়তে আসে, আদৌও তারা নিরাপদ তো এই পরিবেশে? আবারও কোনও বাবা-মায়ের কোল খালি হবে না তো? এই প্রশ্ন আমাদের সবার মনেই জাগছে এখন। আজকের প্রেক্ষাপটে হীরক রাজার মগজ ধোলাই যন্তরটার কথা খুব মনে পড়ছে, যে কোন পর্যায়ে মগজ ধোলাই হলে তবে অধ্যাপক-অধ্যাপিকদের ওপর চড়াও হওয়া যায়? শিক্ষকেরা জাতির মেরুদণ্ড আর তাদের ওপর আঘাত সমাজের ওপর আঘাতের সমান, যা ইতিহাসের পাতায় একটি কালো অধ্যায় রূপে বিবেচিত হবে।

Latest article