অফ মাদার্স অ্যান্ড সন্স

‘মুখোমুখি’ প্রযোজিত ‘অফ মাদার্স অ্যান্ড সন্স’। পরিচালনার পাশাপাশি একক অভিনয়ে পৌলমী চট্টোপাধ্যায়। স্বল্পদৈর্ঘ্যর এই নাটকে মহাভারতের দুই জননী এবং তাঁদের বীর পুত্রদের করুণ পরিণতির ছবি আঁকা হয়েছে। নাটকটি আওয়াজ তুলেছে যুদ্ধের বিরুদ্ধে। দেখে এসে লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহে মুখোমুখি নাট্যগোষ্ঠী মঞ্চস্থ করল ‘অফ মাদার্স অ্যান্ড সন্স’। শ্রমণা ঘোষের লেখা স্বল্পদৈর্ঘ্যের ইংরেজি নাটক। পরিচালনার পাশাপাশি একক অভিনয়ে ছিলেন পৌলমী চট্টোপাধ্যায়।
নাটকে মহাভারতের দুই জননী এবং তাঁদের বীর পুত্রদের করুণ পরিণতির ছবি আঁকা হয়েছে। প্রথমেই সুভদ্রা। তিনি শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের ভগিনী। বাসুদেব ও রোহিণীর কন্যা। এই নারী তাঁর সৌন্দর্য, বুদ্ধিমত্তা এবং দৃঢ় ইচ্ছাশক্তির জন্য পরিচিত। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। শ্রীকৃষ্ণ এই বিবাহে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনিই সুভদ্রাকে অর্জুনের সঙ্গে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। এই বিবাহের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন বলরাম। তাঁর পছন্দের পাত্র ছিলেন জ্যেষ্ঠ কৌরব দুর্যোধন। সুভদ্রা ও অর্জুনের পুত্র অভিমন্যু।

আরও পড়ুন-মধ্যপ্রদেশে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ের ১৯ গাড়িতে তেলের বদলে জল

নাটকে এক-একটি চরিত্র, এক-এক রকম স্বরক্ষেপণ, ভিন্ন ভিন্ন অঙ্গভঙ্গি, নানারকম পদক্ষেপে মূর্ত হয়ে ওঠেন পৌলমী। কখনও সুভদ্রার চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন, কখনও ফুটিয়ে তুলেছেন বলরাম এবং অভিমন্যুর চরিত্র। সুভদ্রা হিসেবে সন্তান জন্ম দেওয়ার মুহূর্তে আলোকিত হয়ে ওঠে তাঁর মুখমণ্ডল। নিখুঁত অভিব্যক্তির মধ্যে দিয়ে তিনি অসীম আনন্দের প্রকাশ ঘটান। পাণ্ডব শিবির থেকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য অভিমন্যুর কাছে আহ্বান এলে সুভদ্রাকে দেখা যায় শঙ্কিত হতে। তখন পৌলমীর অভিনয় আলাদা মাত্রা পায়। তাঁর মানসিক অস্থিরতা, তাঁর ভাঙচুর ধরা পড়ে দর্শক-চোখে। মাতৃহৃদয় চায় না পুত্র যুদ্ধে যাক, কিন্তু আটকানোর কোনও উপায় নেই। কারণ, সবার উপরে পিতার অধিকার। সমাজ যে পিতৃতান্ত্রিক। যদিও, শুধুমাত্র জন্ম দেওয়া ছাড়া পিতা হিসেবে পুত্রের প্রতি কোনওরকম কর্তব্য, দায়দায়িত্ব পালন করেননি অর্জুন। বালক অভিমন্যু বীর যোদ্ধা হয়ে উঠেছিলেন মাতুলালয়ে। পুত্রকে বুকে আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিলেন সুভদ্রা। কারণ, অভিমন্যু তাঁর বাঁচার একমাত্র অবলম্বন। বীর স্বামী তাঁর অধরা। এই সময়েই প্রকাশ পেয়েছে বলরামের ক্ষোভ। স্পষ্ট ভাষায় সুভদ্রাকে জানিয়েছেন, কেন তাঁর মত ছিল না অর্জুনের সঙ্গে এই বিবাহে। যা শুনে কুঁকড়ে যান সুভদ্রা। মানসিক দ্বন্দ্ব, টানাপোড়েনের ছবি ফুটে উঠেছে অংশটিতে। মঞ্চে পৌলমীর দক্ষতা দর্শক মহলকে বিমুগ্ধ করে দেয়।
চক্রব্যূহে প্রবেশের উপায় জানতেন অভিমন্যু। কিন্তু প্রস্থানের উপায় ছিল তাঁর অজানা। কপট যুদ্ধের আশ্রয় নিয়ে কৌরব পক্ষের বীর যোদ্ধারা তাঁকে হত্যা করেন। পুত্রের মৃত্যুসংবাদ শোনামাত্র বুকফাটা আর্তনাদে ফেটে পড়েন সুভদ্রা। এখানে পৌলমীর অভিনয় আলাদা উচ্চতায় পৌঁছয়।

আরও পড়ুন-কে বলল জগন্নাথ কেবল পুরীরই, কে বলল দিঘার প্রসাদ মহাপ্রসাদ নয়

আর একজন মায়ের কথা বলা হয়েছে নাটকে। তিনি নাগকন্যা উলুপী। মহাভারতের এক উপেক্ষিতা নারী। নাগরাজ কৌরব্য ও বিষবাহিনীর কন্যা। পিতা গঙ্গার জলভাগে সর্পরাজ্যের সম্রাট। তার উপর বিশ্ববন্দিত যোদ্ধা। শিশুকাল থেকে উলুপীও যুদ্ধে নিপুণা। শিক্ষা-দীক্ষায় তাঁর সমতূল্য কেউ ছিলেন না। সঠিক বয়সে বিবাহ হলেও স্বামীসুখ পাননি। অকালবৈধব্য মানতে হয়েছিল। যখন উলুপী স্বামী-শোকে কাতর, তখন তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন নির্বাসনে দিন কাটাচ্ছেন। একদিন দুজনের সাক্ষাৎ হয়। উলুপীই প্রথম প্রেম নিবেদন করেন। অর্জুন প্রথমে উপেক্ষা করলেও, উলুপীর ব্যক্তিত্বের কাছে হেরে যান। তাঁদের বিবাহ হয়।
এই প্রেমপর্ব সুন্দরভাবে বুনেছেন পৌলমী। অভিনয়ের পাশাপাশি নৃত্যের প্রতি তিনি বিশেষ অনুরাগী। এই অংশে রয়েছে নৃত্যের বিশেষ ভূমিকা।
অর্জুন ও উলুপীর পুত্র ইরাবান। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ইরাবান ছিলেন পাণ্ডব পক্ষে। যুদ্ধে পাণ্ডবের জয়ের জন্য কালীকে সন্তুষ্ট করতে বলির প্রয়োজন ছিল। ইরাবানের দেহ ছিল পুরুষের মতো কঠিন, হৃদয় ছিল নারীর মতো নরম। এই বিশেষ বৈশিষ্টের জন্য শ্রীকৃষ্ণের পরামর্শে ইরাবানকে বলি দেওয়া হয়। ইরাবানের শর্ত ছিল বিবাহিত হয়েই তিনি বলির জন্য প্রস্তুত হবেন। শ্রীকৃষ্ণ নিজের মোহিনীরূপে এক রাতের জন্য বিবাহ করেন ইরাবানকে। ইরাবানের মৃত্যুতে পাণ্ডবদের জয়ের পথ মসৃণ হয়। পুত্রহারা হন উলুপী। অর্জুন এবং চিত্রাঙ্গদার পুত্র বভ্রূবাহন উলুপীর স্নেহছায়ায় বেড়ে ওঠেন।

আরও পড়ুন-দ্রুত ব্যবস্থা প্রশাসনের, বিরোধীদের কথা বলার কোনও অধিকার নেই

উলুপীর পাশাপাশি অর্জুন এবং ইরাবানের চরিত্র অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়েছেন পৌলমী। পুত্রের প্রতি জননীর গভীর স্নেহ, ব্যাকুলতা, উৎকণ্ঠা কীরকম হতে পারে, নিখুঁত অভিনয়ে এঁকেছেন। ইরাবানের মৃত্যুসংবাদ উলুপীকে খানখান করে দেয়। তিনি উগরে দেন স্বামীর প্রতি অভিমান, ক্ষোভ। নাটকে ধরা পড়েছে বীর অর্জুনের চরম স্বার্থপর রূপ। সবক্ষেত্রেই পৌলমীর অভিনয় ছুঁয়েছে শীর্ষবিন্দু।
সংলাপের মাধ্যমে দর্শকের মধ্যে জাগিয়ে তোলা হয়েছে কয়েকটি প্রশ্ন, যা চাপা পড়ে গেছে প্রাত্যহিকতার অভ্যাসে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে নাটকটি। মানস মুখোপাধ্যায় আলোকসম্পাত মায়াময় পরিবেশ রচনা করেছে। আবহ যথাযথ।
পৃথিবী জুড়ে চলছে চরম অস্থিরতা। যুদ্ধবিধ্বস্ত কয়েকটি দেশ। দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই নাটক আওয়াজ তুলেছে যুদ্ধের বিরুদ্ধে। যুদ্ধে প্রাণ যায় বহু মানুষের। কোল খালি হয় জননীর। তাই যুদ্ধ কোনও ভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। ‘অফ মাদার্স অ্যান্ড সন্স’ নাটকের মধ্যে দিয়ে এই বার্তাই ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনবদ্য নাটকটি আশা করি আগামী দিনে আরও বেশি দর্শক-আনুকূল্য পাবে।

Latest article