মোদি সরকারের নতুন প্রকল্প ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’। আমাদের পাঠকদের মনে আছে গত লোকসভা নির্বাচনের বেশ আগেই মোদিজি একটি একজনের কমিটি তৈরি করে ফেললেন। তার সভাপতি ও সদস্য হলেন দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপিত শ্রীরামনাথ কোবিন্দ। তাঁদের প্রতিবেদন পেশের সময় বেঁধে দেওয়া হল। সেটা খুবই সংক্ষিপ্ত। জোরতালে কমিটির বৈঠক হল। সমস্ত রাজনৈতিক দলকে ডেকে তাদের মতামত নেওয়া হল। আমাদের দল সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস এমন প্রস্তাবের বরাবর বিরোধী। কমিটির সামনে লিখিতভাবেই সেটা জানানো হয়েছে। লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে যে ‘ইন্ডিয়া’ জোট তৈরি হয়েছিল তারা সকলেই এমন প্রস্তাবকে অবাস্তব বলেছেন। কমিটির প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা পডে়ছিল অনেক আগেই। যখন বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে একাই ৩৭০টি আসন ও জোটে ৪০০ আসন পাওয়ার স্বপ্নে মশগুল ছিল। যদি তা হত তাহলে শপথ নেওয়ার প্রথম সপ্তাহেই প্রতিবেদন মন্ত্রিসভায় গৃহীত হয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। শুধু হয়নি তাই না, বিজেপি একক সংখ্যা গরিষ্ঠতাও পায়নি। একটা শক্তিশালী বিরোধীপক্ষ লোকসভায় উদ্ভব হয়েছে। ফলে ১০০ দিন সময় লেগে গেল। অর্থাৎ শপথ গ্রহণের ১০০ দিন পর মন্ত্রিসভার বৈঠকে কোবিন্দ কমিটির প্রতিবেদন গৃহীত হল। ‘এক দেশ এক নির্বাচন।’
আরও পড়ুন-ওরে ও অবুঝ বাঁচাও সবুজ
কমিটি ৩২টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলেছে। অনেক আইনজ্ঞর সঙ্গে কথা বলেছেন। আমজনতার কাছ থেকে ২১ হাজার পরামর্শ পেয়েছেন। তারমধ্যে ৮০ শতাংশ একসঙ্গে নির্বাচন করার পক্ষে মত দিয়েছেন বলে কমিটি জানিয়েছেন। প্রথমে লোকসভা ও বিধানসভার নির্বাচন একসঙ্গে হবে। তার ১০০ দিনের মধ্যে পঞ্চায়েত ও পৌরসভার নির্বাচন হবে। কমিটি এ-মতামতও দিয়েছে যে কোনও বিধানসভা বা লোকসভা যদি কোনও কারণে ত্রিশঙ্কু হয়ে যায় তাহলে ভেঙে দেওয়া যাবে।
এই সমস্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে সংসদে। সংবিধানের বহু ধারা উপধারা পাল্টাতে হবে। লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন ধারাগুলি বহু আলোচনায় গৃহীত হয়েছিল গণপরিষদে। ৮৩ নং ধারা লোকসভার সময়কাল সংক্রান্ত, ৮৫ নং ধারা মাননীয় রাষ্ট্রপতি কর্তৃক লোকসভা ভেঙে দেওয়া সংক্রান্ত। ১৭২ নং ধারা রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন। ১৭৮ নং ধারা বিধানসভা ভেঙে দেওয়া সংক্রান্ত। ৩৫৬ নং ধারা রাজ্যে রাষ্ট্রপাতি শাসন চালু করা সংক্রান্ত। স্বয়ংশাসিত সংস্থাগুলিতে কমিটি অভিমত চালু করার সময় সংসদে সাংবিধানিক ধারাগুলো পাল্টাতে হবে— নতুন ধারা আনতে হবে সেটাই শুধু নয়। এক্ষেত্রে নতুন আইন অর্ধেক রাজ্য বিধানসভার মান্যতা পেতে হবে।
আরও পড়ুন-অরণ্যের অধিকার
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, সংসদের কোনও কক্ষে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। রাজ্যগুলির মধ্যে ১৯টি বিজেপি ও তার সঙ্গীরা ক্ষমতায় আছে। বিরোধীরা আছে ৮টিতে। এক্ষেত্রে অর্ধেক রাজ্য থেকে নতুন আইনের মান্যতা হয়তো অসুবিধা হবে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে একাধিক রাজ্য থেকে প্রবল বিরোধিতা হবে। পুরো সাংবিধানিক প্রক্রিয়া একটি জটিল আকার ধারণ করবে।
বিজেপি এই কর্মকাণ্ডের পক্ষে যে যুক্তি খাড়া করছে সেটাই প্রথম বলা প্রয়োজন। এরফলে নাকি দেশে উৎপাদন প্রক্রিয়ার শৃঙ্খল বাধাহীনভাবে চলবে এবং ইতিবাচক অগ্রগতি দেখাতে পারবে। যার ফলে দেশের আর্থিক অগ্রগতি তো হবেই, সুশাসন প্রতিষ্ঠা হবে। আর একটা সস্তা যুক্তি তারা দিচ্ছে যে ঘন ঘন নির্বাচন, একাধিক নির্বাচন শ্রমদিবস নষ্ট করে। অর্থের অপচয় হয়। মানুষ নাকি বিরক্ত হয়। এগুলো চা-এর ঠেকে যুক্তি ছাড়া আর কিছু না। হরিয়ানার নির্বাচন একেবারেই সামনে। জম্মু ও কাশ্মীরে নির্বাচন চালু হয়ে গেছে। মহারাষ্ট্রেও নির্বাচন। কোনও রাজ্যে বিজেপি’র জেতার কোনও আশা নেই। ফলে মানুষের মনকে অন্যদিকে প্রবাহিত করার জন্য সময় বুঝে এই প্রস্তাবটিকে ঝুলি থেকে বাইরে বের করে আনা হয়েছে। অনেক আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এম কে স্টালিনের মতো কেন্দ্রীয় বিরোধী নেতা এবং মুখ্যমন্ত্রীরা বলেছিলেন যে, এটা কেটি অবাস্তব প্রস্তাব। ১৪২ কোটি মানুষের দেশ ভারত। তারমধ্যে প্রাপ্ত ২১ হাজার পরামর্শ পেয়েছেন কমিটি বা প্যানেল। আঁক কষে দেখা গেছে যে, তার মধ্যে ৮০ শতাংশ ‘এক দেশ, এক নির্বাচনে’র পক্ষে মত দিয়েছে। এমন অবাস্তব ও অযৌক্তিক কথা আর কী হতে পারে?
আরও পড়ুন-ত্রাণ বিলির নাটক গদ্দারের, চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা পুরশুড়ায়, ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী
সদ্য লোকসভার নির্বাচন হল। ২০২৪ সালে। পরবর্তী নির্বাচন হবে ২০২৯ সালে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকে। যদি কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধান পাল্টে দিয়ে আইন চালু করলেন। ২০২৯ আইন লাগু হল। এবার আমি পাঠকদের মনে করিয়ে দিই যে, ২০২৬ সালে মোট ২৩টি রাজ্যের নির্বাচন আছে। তার মধ্যে উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবাংলা, তামিলনাড়ু, দিল্লি আছে। তখন লোকসভা ভেঙে আবার একসঙ্গে নির্বাচন হবে, না— ২৩টি রাজ্যের নির্বাচন ২০২৯ সাল পর্যন্ত পিছিয়ে দেওয়া হবে? সারা দেশে কেমন অস্থিরতা তৈরি হবে তা সহজেই অনুমেয়। প্রকৃত অর্থে দেশের সংবিধানে এখন ব্যক্তি, সংগঠন, রাজ্য সরকার, স্বয়ংশাসিত সংস্থাগুলেকে যে অধিকার দেওয়া হয়েছে যেটা আমাদের দেশের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য এনেছে। যা আমাদের নানা মত ও গণতন্ত্র ও স্বাধিকারকে শক্তিশালী করেছে সেই দীর্ঘ সংগ্রামে প্রাপ্ত পবিত্র সংবিধানের উপর একটা বড় আঘাত হিসাবে এসেছে। ধর্ম বর্ণ ভাষা মৃতের বিভিন্নতা নিয়ে আমাদের ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’— এই বোধষ্টিকে ধ্বংস করার পথে বিজেপির এমন প্রস্তাব এসেছে।
পঞ্চায়েত ও পৌরসভাতে সারা দেশে প্রায় ৩০ লক্ষ নাগরিক নির্বাচিত হন। একই সময়ে সেটা হতে গেলে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অন্যান্য সরঞ্জাম করতে হবে সেটা কল্পনারহিত। লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন একসঙ্গে করতে গেলে যে পরিমাণ ইভিএম ও ভিভিপ্যাট লাগবে এবং তা রাখার জন্য যে জায়গা দরকার হবে তা শুনলে ভির্মি খাওয়ার জোগাড়।
বিগত যটা পর্বে বিজেপি তথা মোদিজির সরকার কিছুই করে উঠতে পারলেন না। চাকরি হল না। জিনিসপত্রের দাম কমল না। বড় শিল্প তো হচ্ছেই না। ছোট শিল্পগুলোর দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কৃষিতে বিনিয়োগ ক্রমেই কমছে। তাছাড়া সার ও বীজের দাম এত বাড়ছে, কৃষি আর লাভজনক নয় বলে কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে কর্মহীন শ্রমিকে পরিণত হয়েছে। এই কারণে গত লোকসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারেনি বিজেপি। তারা যে দম্ভ নিয়ে দেশ শাসন করবে ভেবেছিল তা হচ্ছে না। মানুষকে বোকা বানানোর কৌশল খুঁজে বের করার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে তারা। সেই জন্য ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’-এর স্লোগান। এই দেশ বৈচিত্র্যের, এই দেশ সমন্বয়ের, এই দেশ কারও একক শাসনে বা একক ইচ্ছায় চলবে না, চলতে পারে না। বিজেপি যতই কানুন করুক না কেন তাদের দম্ভ এবার ধাক্কা খেয়েছে। সামনে সময়ে ভেঙে চুরমার হবে। আর দেশের কোটি কোটি মানুষই তা করবে।