দেবযানী বসু কুমার: এ আমার খোলা চিঠি তোমাদের সবার জন্য। তাই সম্মোধনহীন। বাকি জীবনটা আমাকে ছাড়াই কাটাবে তোমার এরপর থেকে। আমাকে নিয়েই তো তোমাদের পদে পদে অসুবিধে? তোমাদের অসুবিধেগুলো লাঘব করার জন্যই না হয় আমি চলে গেলাম। বাবার সকাল পাঁচটার চা, পনেরো-বিশ মিনিট দিতে কোনওদিন দেরি হলে উনি বিরিক্ত হন, তোমার আপিসের সময় কোনওদিন চারপদ করে না উঠতে পারলে তোমার মা নানান কথা শোনান। বলেন— যার অন্ন ধংস করছ তার প্রতি একটুও নজর নেই। বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমায় দিঘা নিয়ে গিয়েছিলে। এসে বলেছিলে— বেড়াতে যেতে আমার ভাল লাগে না। তারপর আর কখনও কোথাও যাইনি। মেয়েরা কত বায়না করেছে তা-ও যাওনি। কিন্তু আপিসের ট্যুরে প্রতিমাসেই তুমি পাঁচ-সাতদিন বাইরে থাক। আপিসের পিকনিক, অফিস পার্টি, সেলস প্রোমোশনের জন্য ডে স্পেন্ট, বসকে খুশি রাখার জন্য নাইট স্পেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি থাকে তোমার। এ-সব নাকি তোমার কাজের অঙ্গ।
আরও পড়ুন-টেলি-ইন্ডাস্ট্রিতে জোয়ার, সরগরম টেকনিশিয়ানস স্টুডিও
অথচ বছরের পর বছর আমার সঙ্গে একটা সিনেমা দেখার সময় পাও না। তখন মনে পড়ে বাবা-মা-কে কার ভরসায় ফেলে যাওয়া হবে? নানান প্রশ্ন। মেয়েরা মুখবইতে আমার একটা অ্যাকাউন্ট করে দিয়েছে। তোমাকে ইচ্ছে করেই বলিনি। আমার তো কিছুই লেখার নেই তাই সাদা প্রোফাইল— প্রায় সাদা। কিন্তু তোমার মুখবইয়ে দেখি তোমার প্রচুর ছবি তোমার পুরুষ ও মহিলা সহকর্মীদের সঙ্গে। অথচ তোমার সঙ্গে আমার ছবি হাতে গোনা। বিয়ের সময় কিছু ছবি আর মেয়েদের মুখে প্রসাদ দেবার সময়। কারণ তোমাদের বাড়িতে মেয়েদের অন্নপ্রাশন হয় না। তাই হয়নি। যদিও জানি হাওয়ালেই হয় কিন্তু হয়নি। আমার খুব ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও হয়নি। বড় মেয়ে হতে কোনও প্রশ্ন না উঠলেও দ্বিতীয় মেয়ে হতে অনেক কথা শুনেছি তোমার বাবা-মায়ের কাছে। বংশধর দিতে পারিনি বলে। তুমিও চুপ করেছিলে। কিন্তু তুমি ভাল করেই জানো ছেলে হওয়া বা না হওয়া আমার ক্ষমতার মধ্যে নয়। তোমরা আমার সম্বন্ধে কতটুকু জান? জানতে চেয়েছ কি? তোমরা জানো না আমি কাঠি-আইসক্রিম খেতে ভালবাসি। আর দই আমার ভারি অপছন্দ। তোমরা মা-ছেলে-বাবা ভালবাস বলে প্রতি রবিবার দই আসে। তোমরা মাছ ভালবাস আর আমি ডিম। তোমাদের বাড়িতে ডিম হয় কালেভদ্রে। আমি সবার ফরমাশ মতো সব রান্না করি কিন্তু হুকুম নেই নিজের জন্য একটা ডিম ভেজে নেওয়ার। তোমরা জানো না আমি গল্পের বইয়ের পোকা। কিন্তু আমার দিন শুরু হয় ভোর পাঁচটা আর শেষ হয় রাত বারোটায়।
আরও পড়ুন-রনিলকে চায় না বিক্ষোভকারীরা, এগিয়ে সাজিথ
বই নিয়ে শুই বটে তবে চোখ টেনে রাখতে পারি না তোমাদের সংসারের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ করার পর। নিজের জন্য আমার কোনও সময় নেই। কিন্তু আমি চাই নিজের জন্য একটু হলেও সময় তুলে রাখতে। কিন্তু হয় না। তোমরা জানো না কবে আমার জন্মদিন— বিয়ের এত বছর পরেও। অথচ তোমার জন্মদিনে আমি পাঁচরকম ভাজা, পাঁচরকম মাছ, পায়েস রান্না করি আর তোমার মা তোমাকে সামনে বসিয়ে খাওয়ান। আমার ঝুলিতে ছিটেফোঁটাও প্রশংসা আসে না। আমার কথা ছেড়েই দাও মেয়েদের জন্মদিন তোমার মা করতে দেন না। এমনকী পায়েসটুকুও করতে দেন না। মেয়েদের নাকি জন্মদিন করতে নেই। মেয়েদের ছবি আঁকা শেখাতে চেয়েছিলাম। তোমরা ‘ভবিষ্যতে শিল্পী হবে এ-বাড়ির মেয়েরা’ বলে ব্যঙ্গ করলে। সব চাপা পড়ে গেল। তোমরা জানো না সেরকম না শিখেও আমি কত ভাল আঁকতে পারি। তোমরা কথায় কথায় খোঁটা দাও ‘বসে বসে খাই’ বলে। কিন্তু তোমরা বোধহয় ভুলে গেছো আমার এই আঁকার জন্য আমি চাকরি করতাম কনসারিয়া রেয়ন মিলে ডিজাইনিং ডিপার্টমেন্টে। মাইনে হয়তো অল্প কিন্তু উন্নতির সুযোগ ছিল। তোমার মা বললেন বাড়ির বৌ চাকরি করা চলবে না। তুমিও সায় দিলে। আমার একদম মত ছিল না চাকরিটা ছাড়ার। দোষ শুধু তোমাদের নয়, দোষী আমার বাবা-মা-ও। বললেন একমাত্র ছেলের বৌ চাকরি করলে শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখভাল করবে কে। এ-যেন বৌ নয় একাধারে নার্স, আয়া, রাঁধুনি, ছেলের শয্যাসঙ্গিনী, চব্বিশ ঘণ্টার বিনিপয়সার কাজের লোক।
আরও পড়ুন-কপ্টার ভেঙে মৃত ১৪
আসলে বাবা-মা ভয় পেলেন, যদি এ-সম্বন্ধ হাতছাড়া হয়ে যায়! কারণ এর আগে অনেকগুলোই গেছে। কারণটা আমি দেখতে খুব সাধারণ। প্রচণ্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাকরিটা আমাকে ছাড়তে হল। ওসব দুঃখ ভুলে যতদিন গেছে তোমাদের সংসারটা, তোমাদের সবাইকে আপন করে নিতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু এক হাতে তো তালি বাজে না। তোমরাও আমাকে নিজের করে নিতে পারোনি। তোমরা বাবা-মা-ছেলে এক শিবিরে আর আমি যেন বিরোধীপক্ষ। মিথ্যে বলব না তাই আমি চুপ করে থাকলেও তোমাদের থেকে মনের দূরত্ব যত দিন গেছে বেড়েছে। যত দিন গেছে আমি বুঝেছি তোমাকেও আমি ভালবাসতে পারছি না। কিন্তু চেষ্টা আমি করেছিলাম। আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। আসলে আমি যে একটা আলাদা মানুষ সেটাই তোমরা কোনওদিন ভাবনি। ঠিক সেই কারণে তুমি বা তোমার পরিবার বরাবর ভেবেছ তোমার বা তোমাদের পরিবারের ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে, তোমাদের সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত। আমাকে তুচ্ছজ্ঞানে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত অপমান করে আমাকে বারবার রক্তাক্ত করেছ। হয়তো সে-রক্ত দেখা যায় না কিন্তু মন থাকলে অনুভব নিশ্চই করা যায়? আর আমিও জানতে দিইনি। দায়িত্ব পালন করেছি কিন্তু খুন করেছি তোমার প্রতি আমার ভালবাসাকে। ওরা তোমার মেয়ে কিনা জানি না তবে আমার দুই মেয়ে তোমাদের ফতোয়ার ওপর ঝামা ঘষে দিয়ে দুজনেই আজ দেশের দুই শহরে বেশ বড় চাকরি করে। ওরা এখন বিয়ে করবে না। ওদের মাকে দেখে ওরা বুঝেছে আগে নিজের পায়ের তলার মাটি শক্ত করতে হবে তারপর বিয়ে। ওরা দেখেছে ওদের মাকে কতটা মানসিক অত্যাচার করা হয়েছে।
আরও পড়ুন-কপ্টার ভেঙে মৃত ১৪
হ্যাঁ এটা, এটাই অত্যাচার। এমনকী মেয়ে দুটো চলে গেছে সেটাও নাকি আমার দোষ! তার জন্য এত মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছ যে আমার অসহ্য হয়ে উঠেছে এ-জীবন। মেয়েরা আমাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল কিন্তু আমি যাইনি। আর পরগাছা হয়ে বাঁচতে ইচ্ছে নেই। বেশ কিছুদিন ধরে চেষ্টা করছিলাম। ঈশ্বর মুখ তুলে চাইলেন। এই বয়সে একটা লেডিজ হোস্টেলে মেট্রনের চাকরি পেয়ে গেলাম। আমার বাকি জীবনটা মনে হয় চলে যাবে। না হলে আমার দুই কৃতী মেয়ে আছে। ধরে নিতে পার এটা আমার ইস্তফাপত্র।
ভাল থেকো তোমরা সবাই।
ইতি, দেবযানী