অপারেশন পুস্তক

গোটা পাড়া স্তম্ভিত হয়ে গেল অমিয়বাবুর বাড়িতে ওআইডি প্রবেশ করায়। ওআইডি মানে অপারেশন ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট।

Must read

বিশ্বজিৎ সরকার
গোটা পাড়া স্তম্ভিত হয়ে গেল অমিয়বাবুর বাড়িতে ওআইডি প্রবেশ করায়। ওআইডি মানে অপারেশন ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট। যারাই প্রথমে ঘটনাটা শুনল তারাই বলতে শুরু করল অসম্ভব, হতেই পারে না। সারা জীবন যে মানুষটাকে পাড়ার লোকেরা দেখেছে এক স্বতন্ত্র মানুষ হিসেবে সেই লোকটা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, হতেই পারে না। কিন্তু ঘটনাটা ঘটল। মূল রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে গটগট করে ওআইডির পাঁচজন কর্তা চলে এল অমিয় দাসের বাড়িতে। বাড়িতে ঢুকেই একেবারে দোতলায় উঠে গেল অফিসারের দল আর নিচে পুলিশি বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে দিল বাড়ি চত্বর। এই ঘটনাতে শোকাহত হয়ে পড়ল গোটা পাড়া। কেননা, এই অমিয়বাবু না ছিলেন কোনও বদ নেতা, না ছিলেন দু’নম্বরি ব্যবসায়ী। তিনি ছিলেন সরকারি সামান্য চাকুরে। চাকরি জীবনের প্রথম লগ্নে ছিলেন কেরানির পদে, যখন রিটায়ার করেন তখনও সেই একই পদে। পেশাগত উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে তিনি কখনওই অগ্রাধিকার দেননি। কেননা তাঁর একটা নিজস্ব জগৎ ছিল, সেই জীবনেই তিনি আনন্দ খুঁজে নিতেন। সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন তাই রোজগারের বেশ কিছুটা ব্যয় করতেন পত্রপত্রিকা কিনে। পাড়ার নানান সামাজিক কাজে তিনি ছিলেন দরাজ। তাঁর দরজা থেকে বিনা হাতে কেউ ফিরত না। এই সামাজিক কাজে তাঁর এই মুক্তহস্তে দান নিয়ে স্ত্রী মাঝে মাঝেই রেগে বলত— ‘গরিবের ঘোড়া রোগ।’
কিন্তু স্ত্রীকে বলতেন— দেখো বাবু এখন তো মানুষ সব একা হয়ে গেছে, উৎসব পালনে বা কোনও কাজে দশটা মানুষ তো একসঙ্গে মিলিত হচ্ছে, সেখানে যদি কিছু সহযোগিতা করা যায় মন্দ কী। এমনই মানুষ ছিলেন অমিয়বাবু। আর এই মানুষটি দু’মাস আগে যখন অ্যালঝাইমার্স রোগে আক্রান্ত হলেন পাড়ার লোকেরাও আহা করতে ভোলেনি। আর  ঠিক এক মাসের মাথায় ওআইডি! নাঃ সত্যিই আর কাউকে বিশ্বাস করা যায় না— পাড়ার দু-একজন লোকের মুখ থেকে বেরিয়ে এল এমন কথাও।
  দোতলার ছোট্ট বাড়ি অমিয়বাবুর, তাতে চারটি কুঠুরি। তার মধ্যে পুরো ওপরের দুটো কুঠরি নানান পুরনো পত্রপত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে ঠাসা, তার একটিতেই ছোট্ট খাটে অমিয়বাবুর রাত্রিযাপন। স্ত্রী গত হয়েছেন বেশ কয়েক বছর আগেই, এখন সংসারে আছে বিবাহযোগ্য কন্যা ও পুত্র। পুত্রই বড়, সে গত তিন বছর ধরে একটি বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। মেয়েও একটি অ্যাডভার্টাইজিং কোম্পানিতে গত এক বছর ধরে চাকরি করছে। সেই মেয়েরও বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হয়ে গেছে তিনমাস আগে। স্ত্রী চলে গেলেও ছেলেমেয়েরা মোটামুটি সামলে নিয়েছে। কিন্তু গত দু’মাস ভুলোমনা হয়ে যেতেই সব যেন গন্ডগোল পাকিয়ে গেল তার সংসার।
[২]
বিকেল ছ’টা। স্থান রবীন্দ্র সরোবর।… গোল হয়ে বসে আছে পাঁচ যুবক। প্রথম যুবকের মুখ থেকে শোনা গেল— ‘আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে, এক কাজ কর— একটা সিসিটিভি লাগিয়ে দে ওই দুটো ঘরে, তারপর একজনকে কাজে লাগিয়ে দে।’
পরের জন বলল, আইডিয়াটা মন্দ না তবে বিশ্বাসী লোক না হলে সিসিটিভি গার্ড করেও অনেক কিছু করে নিতে পারে। আরেকজন বলল— ধুস, আমরা তো চার বন্ধু, দিনকতক ছুটি নিয়ে বসে গেলে কেমন হয়। এবার যার উদ্দেশ্য বলা  সে বলল— না রে এ চাট্টিখানি কথা না। অন্য একজনবন্ধু বলল, অ্যাবসার্ড, অসম্ভব আমাদের পক্ষে এ কাজ করা। ঠিকই বলেছিস, এ চাট্টিখানি কাজ না। আর একজন বলল— আমার মাথায় তো কিছুই আসছে না, একটু উষ্মা নিয়ে আবার বলল— এসব প্রস্তর যুগে শুনতাম, এখন বোঝো ঠেলা, না তোকেই ভুগতে হবে, কী আর করবি বল অনির্বাণ!
কোনও বুদ্ধি আলোচনা যখন আর খাড়া হল না তখন একজন লাফিয়ে ওঠে বলল— ‘ইউরেকা ইউরেকা পেয়েছি পেয়েছি, চল চল এবার চা খাওয়া যাক। অনেকক্ষণ ধরে চিন্তা করতে করতে মাথা জ্যাম হয়ে গেছে রে।’
আরও পড়ুন-নিরাপদ?
বাকিরা সব উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘তা হলে বলে ফেল, কী পেয়েছিস?’
সে বলল, ‘এখন কিন্তু কমু না, দেখবি প্রবলেম সলভ। বি রিল্যাক্স। ব্যাপারটা আমাকেই  টেক-আপ করতে দে।’ কথা আর না হয়ে চার বন্ধু উঠে এগিয়ে যায় চা-স্টলের দিকে।
[৩]
ওআইডি ডিপার্টমেন্টে প্রথম যে বেনামী চিঠিটা এসেছিল তাতে বিশেষ পাত্তা দেয়নি দফতর। এরকম কত চিঠি আসে সবগুলোকে গুরুত্ব দিতে গেলে ওআইডির কাজকর্ম লাটে উঠে যাবে। কিন্তু  একটা নয়, এক সপ্তাহের অন্তরে ৪টে চিঠি এবং একদিন ফোন আসায় নড়েচড়ে বসে ওআইডির রাজ্য দফতর। হয়তো কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে আসবে এই ভাবনাতে এই পদক্ষেপ। ছোট ছোট এমন নানান ঘটনা থেকে উদ্ভাসিত হয় বড় রহস্যের সমাধান। এটা ডিপার্টমেন্টের অভিজ্ঞতা।
 অমিয়বাবুর ঘরে ঢুকেই অবশ্য আশ্বস্ত হয় ওআইডির আধিকারিক দল, অভিযোগকারীরা তাদের ধোঁকা দেয়নি। একেবারে অভিযোগের সঙ্গেই নাক-বরাবর প্রমাণ। সেই ঠাসা বই, আর এই বইয়ের গাদায় মিলবে টাকা। কিন্তু এত বই তারা আশা করেনি, ভেবেছিল দু-চারটে পত্রপত্রিকা এবং ফাইল ঘেঁটে এক বেলাতেই তারা কাজ হাসিল করে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু তা হওয়ার নয় ভেবে জল্পনা না করে অপারেশন শুরু করে। আগেই ছেলেকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল, মেয়েও এল। চারদিকে লোকে লোকারণ্য। অবশ্য পুলিশ ব্যারিকেডে ঘিরে থাকায় বেশ কিছু দূরে তাদের অবস্থান। ফিসফিসানি আর অপার বিস্ময় তাদের চোখে-মুখে। অমিয়বাবু ছিলেন নিচের ঘরে, তাঁর অর্ধ সচেতন মনে দিশাহারা আতঙ্কের ছাপ।
অপারেশন শুরু হলেও টাকার হদিশ নেই। আরও মিনিট দশ এভাবেই চলে। হঠাৎ এক অফিসার আগ্রহভরে একটা বইয়ের কয়েকটা পাটা ওল্টাতেই বেরিয়ে পড়ে কয়েকটা ২০০০ টাকার নোট। চোখ কপালে ওঠে অফিসারদের। এবার শুরু হয় ডাঁই করা বইগুলি টেনে টেনে বার করা আর বইগুলো ঝাড়া। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আর একটা বই থেকে বেরিয়ে পড়ে বেশ কিছু ২০০০ টাকার  নোট। নিমেষের মধ্যেই খবরটা চাউর হয়ে যায় অপেক্ষারত পড়শিদের মধ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসে লোকাল কেবলের কয়েকজন। ছোকরারা কিন্তু পুলিশ ব্যারিকেড থাকায় পৌঁছতে পারে না ভেতরে। শুধু ওখান থেকেই তারা তৈরি করে নিজমনে গড়া এক রহস্য উপাখ্যান। কিন্তু টাকার হদিশ পেতে শুরু হলেও কাজটা কঠিন, কিছুক্ষণ চলার পরই উপলব্ধি হয় আধিকারিকদের। কেননা কোনও বান্ডিল না, লুজ নোট, ১০টা বই বার করলে একটাতে মেলে। সারা বইপত্র পত্রিকা না ঘেঁটে উদ্ধার সম্ভব নয়। এদিকে কিছু সময় অন্তর অন্তরই মিলছে টাকা, সেই হিসেবে অনেক কিছুরই সম্ভাবনা।
  রাত পর্যন্ত চলে তল্লাশি, আরও বেশ কিছু টাকা মেলে। তারপর সেই দিনের মতো উপরের দুটি ঘর সিল করে দিলেন আধিকারিকরা আর বাইরে দুটো পুলিশ মোতায়েন করে সেদিনের মতো অভিযান বন্ধ রাখেন। পরের দিন অভিযান শুরু হয়। ধীরে ধীরে হলেও পত্রিকার মধ্য দিয়েও পাওয়া যায় টাকা। কিন্তু এবার যেন ওআইডির আধিকারিকরা প্রমাদ গুনলেন, কেননা টাকা পাওয়া যাচ্ছে সত্যি কিন্তু সে-টাকা উল্লেখযোগ্যভাবে কম এবং এই টাকা হঠাৎ করে লুকিয়ে রাখেননি, মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে রাখা হয়েছে এই টাকা। কেউ হয়তো বিশেষ উদ্দেশ্যে তাদের এই খবর দিয়েছে! অগত্যা কাজ পুরোপুরি সম্পূর্ণ করার জন্য আরও দু’জন স্টাফকে নিযুক্ত করলেন পরের দিন। টানা চারদিন পর যখন সব বইপত্র দেখা হল তখন মোট পাওয়া গেল ১ লাখ ৭৭ হাজার টাকা, যার বেশিরভাগই লুজ ২০০০ টাকা। যে বই এবং পত্রিকা থেকে টাকা মিলেছিল আধিকারিকরা সেই বইগুলো আলাদা করে রেখেছিলেন। এখন তাঁরা খেয়াল করলেন বইগুলি দুই লেখকের এবং বাকিগুলি একই পত্রিকার, অর্থাৎ মনে রাখার জন্যই এই ব্যবস্থা। ইতিমধ্যেই অমিয়বাবুর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট জোগাড় করেছিল ওআইডি, দেখা গেল স্যালারি এবং পেনশনের টাকাটা প্রত্যেকবারই পরের কয়েকদিনেই খেপে খেপে এটিএম থেকে তুলে নিয়েছেন অমিয়বাবু এবং তাঁর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ভাঁড়ার প্রায় শূন্য। ফাঁপরে পড়লেন আধিকারিকরা, তাহলে এই একলাখ সাতাত্তর হাজার টাকা তো তাঁরই! কীভাবে বাজেয়াপ্ত করবে এই টাকা! এ তো তাঁর আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। ছেলেকে আর একদফা জিজ্ঞাসাবাদ করায় ওআইডি জানতে পারে অমিয়বাবু ব্যাঙ্কে টাকা-পয়সা রাখতেন না। যেবার থেকে স্যালারি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট মারফত শুরু হয় তখন থেকেই তাঁর অ্যাকাউন্টে কিন্তু টাকা জমা হলেই তুলে নিতেন তিনি। ছেলে আরও জানায়— একবার বই কেনার সময় ঝগড়া হওয়ায় তিনি বলেছিলেন চোখ বুজলেই নাকি এসব বইপত্র বিক্রি করে দেবে। হয়তো সেই রাগেই বাবা বইয়ের মধ্যেই টাকা জমাতে শুরু করেছিলেন। হয়তো কোনওদিন তাদের বলতেন। কিন্তু গত দু’মাস হল তাঁর মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ায় বলার আর অবকাশ পাননি। সব শুনে ওআইডি বলল— না এ টাকা তো বাজেয়াপ্ত তো করা যাচ্ছে না। তবে এই টাকা উদ্ধারের জন্য পারিশ্রমিক স্বরূপ সার্ভিস চার্জ নেওয়া যায় কি না সেটা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বিচার্য বিষয়— বলে তারা চলে গেল।
[৪]
দিন চারেক পর। রবীন্দ্র সদনের সামনের ফোয়ারার জায়গায় আগেকার সেই পাঁচ যুবক। যে যুবক ইউরেকা বলে চিৎকার করে উঠেছিল তার মুখ থেকে শোনা গেল— কী রে কেমন দিলাম।
‘সত্যিই তুই ইউনিক ভাই, তোর এলেম আছে বলতে হবে, সাহস আছে, বুকের পাটা আছে। কিন্তু ওআইডি যদি তোকে খুঁজে বার করে তা হলে তোর কী হবে ভেবেছিস!’
‘দেখ, এছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। অনির্বাণ বা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না একটু একটু পাতা উল্টে ওই বইয়ের ভেতর থেকে এত টাকা বার করার। অনির্বাণের বাবা যদি অসুস্থ না হত তাহলে তো কোনও অসুবিধা হত না। উনি তো স্মরণ করতেই পারছেন না কোন বইয়ে কোনখানে রেখেছেন। সুতরাং সব বইগুলো দেখা ছাড়া তো আর কোনও পথ ছিল না। তবে ঘটনাটা তো সত্যি।’
এবারে অনির্বাণের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল— ‘তুই কি করে টের পেলি?’
অনির্বাণ বলল— ‘২০০০ টাকার নোটগুলো এটিএম থেকে তুলে আনতাম। অত টাকা খরচা হত না, আমরা বইপত্র বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতাম না। তা সত্ত্বেও বাবা প্রায়ই বলতেন, কোনও বই যেন তাঁর বিনা অনুমতিতে কখনও কাউকে না দেওয়া হয়। এদিকে শরীর খারাপের পরই বইগুলোর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলতেন, সেখান থেকেই আমার সন্দেহ সন্দেহ দৃঢ় হয়েছিল। এদিকে সরকার ২০০০ টাকার নোট বাতিল করতে আমি যে কী ভয় খেয়ে গিয়েছিলাম! তাই তোদের বলতে বাধ্য হয়েছিলাম। সামনে বোনের বিয়ে তাই কী করে এই টাকা উদ্ধার করব এ-নিয়ে সত্যিই আমার ঘুম চলে গেছিল। তাই সেদিন তোদের বলা ছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না রে। তোরা সত্যি করেই আমার ভাল বন্ধু। তবে দেখিস কেউ যেন বিশ্বাসঘাতকতা করে অর্ণবকে না ফাঁসাস।
অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article