কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা, ওরা ব্যস্ত বিভাজনের তাস খেলতে

পহেলগাঁও গণনিধন-উত্তর পরিস্থিতিতে ভারতবর্ষ বিস্ময়াবিষ্ট চোখে দেখল, নির্লজ্জ মোদি সরকার নিজেদের অপদার্থতা আড়াল করতে ধর্মীয় বিভাজনের বিষ ছড়াতে শুরু করল। পাক-হানাদারদের স্রেফ মুসলমান অভিধায় অভিহিত করে আর নিহত ভারতীয়দের ধর্মীয় পরিচয় বড় করে দেখিয়ে নোংরা রাজনীতির খেলায় নামল। এর বিরুদ্ধে লড়তে হলে পরস্পরের হাত ছাড়লে চলবে না। লিখছেন মুর্শিদাবাদের ডোমকল গার্লস কলেজের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান প্রিয়ঙ্কর দাস

Must read

এক অন্ধকার সময়ের মধ্যে দিয়ে দিন কাটছে, পহেলগাঁও-এর ঘটনায় শিহরিত হয়েছে গোটা দেশ। ২২ এপ্রিল সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা নিহত হয়েছেন সাধারণ পর্যটকরা, তাতে ১৪০ কোটি ভারতবাসী শোকস্তব্ধ ও আতঙ্কিত। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এটাই যে, যে সময়ে আমাদের সকলকে একত্রে থাকতে হবে, দলমত, ধর্মমত নির্বিশেষে সকল ভারতবাসীকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে থাকতে হবে সেই সময়ে ভারতবাসীর একতার সুরকে ভেঙে দিয়ে, নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে নেমেছে বিজেপি নামক রাজনৈতিক দল। বাংলার বুকে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী মৌলবাদী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে মৌখিক আক্রমণ না শানিয়ে, আক্রমণ শানাচ্ছেন ভারতীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে, আর আক্রমণ শানাচ্ছেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে। বিজেপি ভাবছে এই অস্থির পরিস্থিতির ফায়দা তুলে তাঁরা ২০২৬-এর বিধানসভা ভোটের বৈতরণী পার হবে। বিজেপির এই ভেদাভেদের আগুনে ঘি ঢালছে এক শ্রেণির বিজেপির মদতপুষ্ট সংবাদমাধ্যম। নির্লজ্জভাবে ভারতীয় সংবিধানের ‘সেকুলার’ শব্দটির অবমাননা করে তাঁরা সংবিধানের অবমাননা করছেন। প্রতিনিয়ত খবরের শিরোনামে ভেসে উঠছে সন্ত্রাসবাদীদের আক্রমণে নিহত হলেন হিন্দু পর্যটকরা। প্রশ্ন জাগছে মনে, কেন তাঁরা ‘হিন্দু’ শব্দটির ব্যবহার করেছন ভারতীয় শব্দের পরিবর্তে। উত্তরটা খুব সহজ, ভারতীয় পর্যটকদের মৃত্যু উল্লেখ করলে সেখানে কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিফলতাকে প্রশ্ন করা হবে। বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রক তাই এই প্রশ্নগুলোকে চাপা দিতে চায়।

আরও পড়ুন-সাত লাখি কলম! মনের মতো লেখার টানে পেন উৎসবে

প্রধানমন্ত্রী এই ঘটনার পরবর্তী সময়েই ভোটের অঙ্ক কোষতে ভোট প্রচারে বিহারে চলে গেছেন। সেখান থেকে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছেন এই আক্রমণ ভারতীয় আত্মার বিরুদ্ধে আক্রমণ। বলতে ইচ্ছে করে, এই ভারতীয় আত্মা মানে সর্বধর্ম সমন্বয়ের আত্মা, এই আত্মা হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়ের আত্মা।
এই নারকীয় হত্যালীলার পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি, যে তিনজন বঙ্গসন্তান প্রাণ হারিয়েছেন তাঁদের পরিবারের প্রতি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় ১০ লক্ষ টাকা অনুদান ঘোষণা করেছেন, নিহত বঙ্গসন্তান বিতান অধিকারীর বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্যে মাসিক ১০ হাজার টাকা পেনশনের ব্যবস্থাসহ স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। অপরদিকে উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও বিহার রাজ্যের যে সন্তানেরা নিহত হলেন তাঁদের পরিবারের জন্যে সেই রাজ্যের বিজেপি ও বিহারে তাঁদের সমর্থনকারী সরকার কোনও পদক্ষেপ নেয়নি উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা যে গুজরাত মডেলের ঢক্কানিনাদ শুনে থাকি তা যে প্রকৃতই কতটা অন্তঃসারশূন্য তা বোঝা যায় যখন গুজরাতের সন্তান নিহত হবার পর মাত্র ৫ লক্ষ টাকা অনুদান হিসেবে ঘোষণা করা হয়, পরিবারের কোনও সদস্যের চাকরি তো অনেক দূরের কথা। বাংলা থেকে অস্তমিত হয়ে যাওয়া সিপিএম, টিমটিম করে জ্বলছে একমাত্র কেরলে। সেই কেরলের যে সন্তান নিহত হলেন তাঁর পরিবারের পাশেও দাঁড়ায়নি কেরল সরকার। নির্লজ্জতার এ এক কঠিন বহিঃপ্রকাশ। বাংলা মায়ের বীরসন্তান ঝন্টু আলি শেখ সন্ত্রাসবাদীদের সাথে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন, ধর্মীয় মেরুকরণের খেলায় বঙ্গ বিজেপি এতটাই মগ্ন যে তাঁদের কোনও প্রতিনিধি এই বীর শহিদের পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। দাঁড়িয়েছেন বাংলার অগ্নি কন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পরিবারের জন্যে ১০ লক্ষ্য টাকা অনুদান ঘোষণার পাশাপাশি তাঁর স্ত্রীর রাজ্য সরকারি চাকরির বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করেছেন। একথা তাই অনস্বীকার্য যে, দেশমাতৃকার প্রকৃত সেবক বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়।
পহেলগাঁও-এর ঘটনায় আমরা সকলে শিহরিত হয়েছি, এই শিহরনের কম্পন সকল ভারতবাসীর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে। এই শিহরনের কোনও হিন্দু-মুসলমান হয় না। স্বজনহারাদের চোখের জল প্লাবিত করেছে গোটা ভারতকে, সেই প্লাবনে ভাসছি আমরা সকলে। এই প্লাবনেরও কোনও হিন্দু-মুসলমান হয় না। গোটা ভারতবর্ষ আজ কঠিনতম পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে আছে, যেকথা সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে, কোনও প্রতীকী পদক্ষেপ নয় চাই কঠিন পদক্ষেপ। সেই কঠিন পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে আছি আমরা সকলেই। এই অপেক্ষার কোনও হিন্দু-মুসলমান হয় না। জীবনানন্দ দাশের কবিতার একটি লাইন মনে পড়ে যায়— “মহামৈত্রীর বরদ তীর্থে পুণ্য ভারত পুরে / পুজার ঘন্টা মিশিছে হরষে নমাজের সুরে সুরে”।

Latest article