সংবিধানের (Constitution) জন্যই, সংবিধানের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ভারতীয় গণতন্ত্র ৭৩ বছর ধরে কাজ করছে। সংসদ যখন এর ত্রুটি খুঁজে পায়, তখন সংবিধান সংশোধন করে সংসদ। এখনও পর্যন্ত ১০৬টি সংবিধান সংশোধনী আইন তৈরি হয়েছে। জরুরি অবস্থা কার্যকর হওয়ার সময় সংবিধান একটি সরাসরি এবং গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিল। সংবিধান পরোক্ষ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার দৃষ্টান্তও অনেক রয়েছে : আহত হয়েও টিকে গিয়েছে সংবিধান। যখন এই ধরনের ঘটনাগুলিতে ভারতের সুপ্রিম কোর্টকে জড়ানো হয়েছে, আদালত হয়তো হোঁচট খেয়েছে, কিন্তু নিজেকে পুনরুদ্ধার করেছে যথাসময়ে।
আদালত প্রমাণ করেছে যে ভুল স্বীকার করার ক্ষমতা আছে তাদের। আদালতের হোঁচট খেয়েছে— এ কে গোপালন, আই সি গোলোকনাথ এবং এ ডি এম জবলপুর মামলায়। নিজেকে সংশোধনের মাধ্যমে, আদালতের তরফে একটি উদার গণতান্ত্রিক সংবিধানের মৌলিক নীতির উপর গুরুত্ব আরোপের ঘটনা ঘটেছে মানেকা গান্ধী, এস আর বোম্মাই, কেশবানন্দ ভারতী এবং কে এস পুত্তাস্বামী মামলায়।
কিন্তু সম্প্রতি সংবিধানের ওপর একের পর এক পরোক্ষ আক্রমণ নেমে এসেছে।
২০১৯-এর ৫ অগাস্ট জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে সেটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়—অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে এটিরও বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংবিধানের একটি উদ্ভট ব্যাখ্যা অনুসারে, সংসদের সঙ্গে পরামর্শ করে সংসদ এবং শেষোক্তদের ‘অভিমত’ পাওয়ার পরে, সংসদই রাজ্যটিকে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের স্তরে নামিয়ে দেয়। ভবিষ্যতে অন্য কোনও রাজ্যের সঙ্গেও এই জিনিস ঘটবে না, তার কোনও গ্যারান্টি কিন্তু নেই।
কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল দিল্লি (গভর্নমেন্ট অব দ্য ন্যাশনাল ক্যাপিটাল টেরিটরি অব দিল্লি বা জিএনসিটিডি) ১৯৯২ সাল থেকে যেসব ক্ষমতা উপভোগ করে আসছিল, সেগুলি থেকে তাকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় সরকার দুটি ক্ষেত্রে আইন পাশ করেছে। এজন্য উভয় ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সরকারকে ভর্ৎসনা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। সরকারি কর্মচারীদের উপর নির্বাচিত মন্ত্রীদের যে নিয়ন্ত্রণ ছিল সেটা কেড়ে নিতে সংসদের বাদল অধিবেশনে কেন্দ্রীয় সরকার একটি আইন পাশ করেছে এবং সেই নিয়ন্ত্রণ অর্পণ করা হয়েছে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নরের হাতে। এই নয়া ব্যবস্থার ফলে নির্বাচিত মন্ত্রীরা হয়ে উঠেছেন— সরকারি কর্মচারী এবং একজন নিয়োগপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট গভর্নরের করুণার পাত্র।
ভারতের নির্বাচন কমিশন গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার পাঁচবছর অন্তর পুনর্নবীকরণের দায়িত্ব পালন করে। অনুপ বারানওয়াল মামলার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট একটি প্রক্রিয়া তৈরি করে দিয়েছে যাতে প্রধানমন্ত্রী, ভারতের প্রধান বিচারপতি এবং বিরোধী দলের নেতাকে একটি নির্দলীয় সংস্থা বা নন-পার্টিজান বডির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনাররা নির্বাচিত হন। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার এই রায় খারিজই করে দিল। এরপর অন্য একটি আইন পাশের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির জায়গায় আনা হল প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক মনোনীত একজন মন্ত্রীকে।
মণিপুরে বিধানসভা প্রাথমিকভাবে স্থগিত রাখার পর, সম্প্রতি রাজ্যপাল ইম্ফলে বিধানসভার অধিবেশন ডেকেছিলেন। কিন্তু ৬০ সদস্যের বিধানসভায় যে দশজন কুকি সদস্য রয়েছেন, অধিবেশনে তাঁরা যে যোগ দিতে পারলেন না! এই পরিস্থিতিও যদি সংবিধানের একটি ‘বিপর্যয়’ না-হয়ে থাকে এবং মুখ্যমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখে দেওয়া হয়, তবে সেটা সংবিধান থেকে অনুচ্ছেদ ৩৫৬ মুছে ফেলার শামিল।
এরকম অবস্থায় বারবার প্রশ্ন উঠছে, সংবিধান (Constitution) অনুসারী ভারতীয় গণতন্ত্র কি তবে খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে?
বিশ্বের প্রাচীনতম গণতন্ত্রগুলির মধ্যে একটির একজন সার্বভৌম রাজা বা রানি রয়েছেন। কিন্তু তাঁদের কোনও লিখিত সংবিধান (Constitution) নেই। তবুও সংবিধান-নির্ভর অন্যান্য গণতন্ত্রের জন্য দেশটি একটি মডেল হিসেবেই বিবেচিত হয়। যেসব দেশের লিখিত সংবিধান রয়েছে, ‘সংবিধান’ অনুসারে ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা সেগুলির চেয়ে উচ্চতর। ডেনমার্ক, সুইডেন, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতির পাশে রাখুন চিন, ইরান, মায়ানমার প্রভৃতি দেশের বৈপরীত্য। ভি-ডেম ইনস্টিটিউট উদার গণতন্ত্রের (লিবারাল ডেমোক্রেসি) তালিকার শীর্ষে রেখেছে প্রথমে উল্লিখিত দেশগুলিকে এবং শেষোক্ত দেশগুলিকে রেখেছে রুদ্ধদ্বার স্বৈরাচারী (ক্লোজড অটোক্রেসি) দেশের শ্রেণিতে।
বর্তমান ভারতের অবস্থাটা ঠিক কী? উদারনৈতিক গণতন্ত্র থেকে রুদ্ধদ্বার স্বৈরাচারের পথে আমাদের যাত্রায় কি তবে পূর্ণচ্ছেদ পড়ল?
২০২৪-এর নির্বাচন এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর ঠিক করে দেবে।
সুতরাং, মোদি-বিদায় নিশ্চিত করতে না পারলে সংবিধানকে বিদায় জানাবে ভারত।
আরও পড়ুন- আবার দেশের শীর্ষে বাংলা