আমার দুর্গারা

নারী আজ আর শুধুই সংসারের ছোট্ট ঘেরাটোপে আবদ্ধ নয়। অর্থনৈতিক বাধা পেরিয়ে, সংস্কারের শিকল ভেঙে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, সব শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে অস্বীকার করে অসীম সাহস ও শক্তিতে ভর করে তাঁরা আজ গোটা বিশ্বের কাছে অনুপ্রেরণা। তাই মায়ের আগমনের আগে সেই সব দুর্গাদের কুর্নিশ যাঁরা লড়াই চালিয়েছেন এবং তাঁদের কর্ম দিয়ে গড়েছেন ইতিহাস। লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

শৃঙ্গজয়ী ছোনজিন
ছোট থেকেই চোখে স্বপ্ন দেখতেন পর্বতারোহণ ও শৃঙ্গজয়ের। কিন্তু যাঁর চোখ অন্ধ তাঁর স্বপ্ন কি রঙিন হয়? সবটাই যে সাদা-কালো। তাও আবার সুউচ্চ মাউন্ট এভারেস্ট! এও কি সম্ভব! অদম্য জেদ আর ইচ্ছে থাকলে সবই সম্ভব। ভারত-তিব্বত বর্ডারের হিমাচলের কিন্নৌরের প্রত্যন্ত ছোট্ট গ্রাম ছাঙ্গোতে জন্ম ছোনজিন অ্যাংমোর। জন্মান্ধ ছিলেন না। মাত্র আট বছর বয়সে চিকিৎসাজনিত ত্রুটিতে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন অ্যাংমো। দৃষ্টিশক্তি হারালেও মনোবল কখনও কমেনি তাঁর। ধাপে ধাপে পড়াশোনা সম্পূর্ণ করেছেন তিনি। হিমাচলের বাসিন্দা ছোনজিনকে অনুপ্রেরণা জোগাত হেলেন কেলারের কাহিনি। দৃষ্টিশক্তি না থাকার চেয়েও বড় হল দৃষ্টি থাকতে কোনও লক্ষ্য না থাকা। এই কথাকেই মনেপ্রাণে মানতেন ছোনজিন। ২০১৮ সালে মানালি থেকে খারদুংলা যান অ্যাংমো। ১৮ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু মোটর যান চলাচলের রাস্তার মধ্যে একটা হল এই রাস্তা। ২০১৯-এ মাত্র ছ’দিনে নীলগিরির মধ্যে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে ভারতের তিনটি রাজ্য অতিক্রম করেন অ্যাংমো। সিয়াচেনেও ইতিহাস রচনা করেছেন তিনি। ২০২১ অপারেশন ব্লু ফ্রিডমের অংশ হয়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ যুদ্ধক্ষেত্র সিয়াচেন হিমবাহে পর্বতারোহণকারীদের বিশেষ দলে একমাত্র মহিলা পর্বতারোহী ছিলেন অ্যাংমো। এরপরে দৃষ্টিহীনতার বাধা তুচ্ছ করে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়াও স্পর্শ করেন তিনি। প্রথম ভারতীয় দৃষ্টিহীন মহিলা যিনি বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয়ের নজির গড়লেন ২০২৫-এ। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মিরান্ডা হাউস থেকে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর শেষ করেন। বর্তমানে দিল্লির একটি নামজাদা ব্যাঙ্কের গ্রাহক পরিষেবা সহযোগী হিসেবে কর্মরত ছোনজিন। তবে মাউন্ট এভারেস্ট তাঁর প্রথম পর্বতারোহণ নয়। ২০২৪ সালে অক্টোবরে প্রথম ভারতীয় দৃষ্টিহীন মহিলা হিসেবে মাউন্ট এভারেস্টের বেস ক্যাম্পে ট্রেকিং করেছিলেন। এছাড়া একটি বিশেষভাবে সক্ষম দলের সঙ্গে ৬ হাজার মিটার উঁচু শৃঙ্গ জয় করেন। তিনি শুধু পর্বতারোহী নন, একজন অ্যাথলিটও। রাজ্যস্তরের সাঁতারে সোনার পদক জেতেন। জাতীয় স্তরে জুডোতে অংশ নিয়েছেন, ম্যারাথনেও অংশগ্রহণ করেন। জাতীয় স্তরে ম্যারাথনে দুটি ব্রোঞ্জপদক পেয়েছেন অ্যাংমো। আঞ্চলিক এবং জাতীয় স্তরে ফুটবলও খেলেছেন অ্যাংমো। অসামান্য কৃতিত্বের জন্য পেয়েছেন একাধিক সম্মান এবং পুরস্কার। রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পেয়েছেন সর্বশ্রেষ্ঠ দিব্যাঙ্গজন জাতীয় পুরস্কার। জীবনে অসম্ভব বলে কিছু হয় না। সঠিক প্রশিক্ষণ ও সদিচ্ছা থাকলে কোনও বাধাই আর বাধা হয়ে ওঠে না।

আরও পড়ুন-আত্মরক্ষায় আজকের দুর্গারা

মৎস্য-গবেষক রীনা
কথায় বলে, মাছে ভাতে বাঙালি। সেই মাছ চাষের গবেষণায় অভূতপূর্ব আবিষ্কার সাড়া ফেলেছেন এক বাঙালি কন্যা। তিনি হলেন গবেষক রীনা চক্রবর্তী। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার খণ্ডঘোষ ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম শাঁকারী। সেই গ্রামের চাষি প্রশান্ত চক্রবর্তীর মেয়ে রীনা চক্রবর্তী। গ্রামেরই স্কুলে শৈশবে পড়াশুনো করেছেন রীনা। পড়াশোনার দিনগুলোয় বাবা-মা’ই ছিলেন একমাত্র অনুপ্রেরণা। ছোট থেকে প্রত্যন্ত গ্রামে বড় হওয়ার ফলে ছিল না কোনও সুযোগ-সুবিধা। লেখাপড়া শেখার জন্য অনেকটাই স্ট্রাগল করতে হয়েছিল তাঁকে। শাঁকারী উচ্চবিদ্যালয় থেকে পড়াশুনো শেষ করে তিনি বর্ধমানের রাজ কলেজ ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ সম্পূর্ণ করে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যা শাখার মৎস্যবিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি সম্পূর্ণ করেন। কিছু করে দেখানোর অদম্য ইচ্ছে ছিল তাঁর। এর সঙ্গে এটাও চেয়েছিলেন তাঁর কর্মে যেন সমাজের মানুষের উপকার হয় এবং জেদের ফলে রীনা চক্রবর্তী আজ সাফল্যের শীর্ষে। কিন্তু কী ছিল তাঁর সেই গবেষণা। যার জন্য আজ বিশ্বজোড়া নাম তাঁর। রীনার গবেষণার মূল বিষয় ছিল জলের অপচয় না করে, অল্প জায়গায় কৃত্রিম জলাশয় তৈরি করে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা। এই পদ্ধতিতে অর্থাৎ কম জলে শুধু মাছ চাষই নয়, মাছ চাষ করে লাভের দিশাও দেখিয়েছেন রীনা তাঁর গবেষণায়। গবেষক রীনা চক্রবর্তী নিজের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে দিল্লির নয়ডার মুরাদনগরের কাছে ১৪ বিঘা জমি কিনেছেন। অল্প জায়গায় অল্প জলে বিজ্ঞানসম্মতভাবে মাছ চাষ করে কীভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানো যায়, সেটাই রিসার্চ সেন্টার এবং ওই জমিতে করে দেখাবেন তিনি। সেখানে মাছ চাষে উৎসাহী নারী ও পুরুষ সকলকে হাতেকলমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে সেই কাজ। দেশের এমন প্রতিভাবান বিজ্ঞানী স্বয়ং রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পেয়েছেন সম্মান। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রীনা চক্রবর্তীর দাদা দিলীপ চক্রবর্তী। যিনি নিজেও একজন নামজাদা ও সম্মানপ্রাপ্ত কৃষি বিজ্ঞানী। রীনা বর্তমানে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে মৎস্যবিজ্ঞান শাখার বিভাগীয় প্রধান পদে দায়িত্বে রয়েছেন।
প্রজ্জলা সুনীতা
ছোট্টখাট্টো চেহারার সুনীতা কৃষ্ণন। হাজার ভিড়ে চোখে পড়বেন তিনি কিন্তু তাঁর জীবনকাহিনি, সংঘর্ষ, কীর্তিকলাপ, সাফল্যের ঘটনা তাবড় মানুষের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। যৌনপাচার রুখে দেওয়ার অন্যতম কান্ডারি সুনীতা। নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়েই লড়ে গেছেন। তাঁর কাজের চরম খেসারত দিতে হয়েছে সুনীতাকে। মাত্র ১৫ বছর বয়স গ্যাং রেপ হয় তাঁর। তবুও মনোবল এতটুকু ভাঙতে পারেনি কেউ। ১৯৭২-এ বেঙ্গালুরুতে জন্ম সুনীতার। উচ্চতা চার ফুট বলে নিজেকে নিয়ে অস্বস্তি, লজ্জা— দুই-ই ছিল। কিন্তু তিনি বরাবর বেশ ডাকাবুকো ধরনের। বাবা বলেছিলেন, ‍‘‘উচ্চতা কম সেদিকে নজর দিও না। মনের দিক থেকে বড় হওয়ার চেষ্টা কোরো।’’ সেই কথাটা মনে রেখেছিলেন সারাজীবন। তারপর থেকেই সমাজে বঞ্চিতদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করেন। মাত্র আট বছর বয়সে মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের নাচ শেখাতেন। এরপর বস্তিতে গিয়েও পড়িয়েছেন। ১৫ বছর বয়সে দলিত সম্প্রদায়কে শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে একটি ক্যাম্প করেন। তাঁর এই পদক্ষেপে আগুন ধরে যায় বহু মানুষের মনে এবং সুনীতাকে এই কাজ থেকে প্রতিহত করতে আটজন বিকৃতমনস্ক মানুষ তাঁকে নৃশংসভাবে ধর্ষণ করে। এত ভয়ঙ্কর ছিল সেই অত্যাচার, মারধর যে সুনীতা আজও একটা কানে ভাল করে শুনতে পান না। প্রাথমিক ধাক্কায় নিজেকে গুটিয়ে নেন সুনীতা। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ফলে লোকলজ্জার ভয়, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়েছিলেন তাঁর বাবা-মাও। তবে সুনীতা থেমে যাননি। অদ্যম মনোবলে তিনি আবার ঘুরে দাঁড়ান। সুনীতা জানতেন তাঁকে কী করতে হবে। ফলে বাবা-মাও আর বাধা হননি তাঁর চলার পথে। এই প্রসঙ্গে সুনীতা বলেছেন, ‍‘‘আমার মধ্যে এমন এক রাগ জন্মেছিল যে তার আগুন এখনও দাউ দাউ করে জ্বলছে। তাই আমি নিজের সংস্থার নাম রেখেছি প্রজ্জলা।’’ স্কুল শেষ করে ম্যাঙ্গালোরে সোশ্যাল নেটওয়ার্ক নিয়ে পড়াশুনো শেষ করেন সুনীতা। তারপর শুরু হয় তাঁর আসল লড়াই। সমাজ সচেতনতামূলক নানা কাজে যুক্ত হন। একবার সেজন্য তাঁকে জেলেও যেতে হয়। বাবা-মা মেনে নিতে পারেন না সুনীতাকে। এরপর তিনি বাড়ি ছাড়েন। আজও তিনি বাবা-মায়ের থেকে দূরেই থাকেন। এরপর হায়দরাবাদের রেড লাইট এরিয়ার যৌনকর্মীদের পরবর্তী প্রজন্মদের সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন দিতে তিনি উদ্যোগী হলেন এবং শুরু করলেন তাঁর সংস্থা ‘প্রজ্জলা’। সুনীতার সংস্থা প্রজ্জলা এখনও পর্যন্ত ১২ হাজারেরও বেশি মেয়েদের নারী-পাচারকারীদের হাত থেকে উদ্ধার করে তাঁদের পড়াশুনো শিখিয়ে নিজের পায়ে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছে। তবে সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল তাঁর পাচার হওয়া মেয়েদের নিজের বাড়িতে ফেরানো। কারণ অনেকেই আর মূলস্রোতে ফিরতে চান না। প্রজ্জলায় এখন ২০০ জনের ওপর কর্মী, যাদের লভ্যাংশের একটা টাকাও সুনীতা নেন না। ওদের টাকা ওদেরই থাকে। সুনীতার স্বামী রাজেশ ফিল্মমেকার। তাঁর এই সুবিশাল কর্মকাণ্ডে স্বামীকে সবসময় পাশে পেয়েছেন সুনীতা। সুনীতার ওপর এখনও পর্যন্ত ১৪ বার আক্রমণ করা হয়েছে। কিন্তু থামানো যায়নি তাঁকে। পেয়েছেন পদ্মশ্রী সম্মান-সহ আরও অনেক পুরস্কার।

আরও পড়ুন-যাদবপুরে বারবার পড়ুয়ার মৃত্যু, উদাসীন কর্তৃপক্ষ, প্রতিবাদে টিএমসিপি

অদম্য অরুণিমা
অরুণিমার ঘটনা কোনও সিনেমার গল্পের চেয়ে কম কিছু নয়। তখন তাঁর ২৪ বছর বয়স। জাতীয় স্তরের ভলিবল খেলোয়াড় হয়েছেন। যথেষ্ট পরিচিতি। একই সঙ্গেই চলছে চাকরির প্রস্তুতিও। কেন্দ্রীয় নিরাপত্তাবাহিনীর চাকরির পরীক্ষা দিতে ট্রেনে করে লখনউ থেকে দিল্লির পথে রওনা হল অরুণিমা। ঠিক সেই সময় এক বড় ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হলেন তিনি। কিছু দুষ্কৃতী তাঁর মায়ের দেওয়া সোনার চেনটি ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল কিন্তু অরুণিমা ভয় পেয়ে তাঁদের হাতে সেই চেন তুলে দিতে চাননি। তিনি বাধা দেন এবং তারই চরম খেসারত দিতে হয় অরুণিমাকে। দুষ্কৃতীরা তাকে চলন্ত ট্রেন থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ঠিক সেই সময় পাশের লাইন দিয়ে যাচ্ছিল আর একটি ট্রেন যার ধাক্কায় অরুণিমার পা চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসায় থাকার পর ক্ষতিগ্রস্ত পা হাঁটুর নিচ থেকে বাদ যায়। মুহূর্তে তাঁর জীবন পাল্টে যায়। যে স্বপ্ন নিয়ে পথচলা শুরু সেই স্বপ্ন এমন এক আকস্মিকতায় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
কিন্তু তিনি হেরে যাননি। সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়তে যেখান থেকে উঠেপড়ে লেগেছিলেন আর সেখান থেকে তাঁর শৃঙ্গ জয়ের স্বপ্ন দেখার শুরু। শুনতে খুব অবাক লাগলেও ওই একটি সম্পূর্ণ পা নিয়েই তিনি দেখেছিলেন এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন। হাসপাতালের চিকিৎসাধীন থাকার সময়েই ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াই যে করবেন তা স্থির করে নিয়েছিলেন। তার জন্য নিজেই নিজের জন্য বেঁধে নিয়েছিলেন লক্ষ্য। তাঁর পর্বত অভিযানের কথা শুনে লোকজন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতেও ছাড়েনি কিন্তু মনোবল হারতে দেয়নি।
এইসময় পাশে পেয়েছিলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা পর্বতারোহী যিনি এভারেস্ট জয় করেছেন সেই বাচেন্দ্রী পালকে। তারপর কঠোর পরিশ্রম শুরু। উত্তরকাশীর নেহরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে বেসিক মাউন্টেনিয়ারিং কোর্স করেন তিনি। তারপর দেড় বছরের কঠোর পরিশ্রম। নিয়মিত ব্যায়াম করতেন সেই সঙ্গে, শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লড়াই চালিয়েছেন আর মানসিক শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করে গেছেন তারপর একদিন আসে সুযোগ। একটি নামী কোম্পানির স্পনসরশিপে হওয়া Eco Everest Expedition-এ জয় করলেন এভারেস্ট। এভারেস্ট জয়ের করেও থেমে থাকেননি তিনি। ইতিমধ্যেই একাধিক মহাদেশের শৃঙ্গ তাঁর পায়ের তলায় এসেছে। সেই তালিকায় রয়েছে আফ্রিকার কিলিমাঞ্জারো, ইউরোপের এলব্রুস, দক্ষিণ আমেরিকায় অ্যাকনকাগুয়া, অস্ট্রেলিয়ার কসিউজকো ইত্যাদি। বিশেষভাবে সক্ষম শিশুদের জন্য একটি স্কুল চালান তিনি। প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা বই ‘Born Again on the Mountain’। পেয়েছেন পদ্মশ্রী সম্মান।

আরও পড়ুন-পশ্চিম বর্ধমান : ঐক্যে জোর, এবার টার্গেট ৯/৯

চাষের দিদিমণি মৌসুমী
মুর্শিদাবাদের দৌলতাবাদ থানার ছয়ঘরি গ্রামের কৃষক মৌসুমী বিশ্বাস।
২৮ বছরের নিরলস পরিশ্রমে আজ তিনি গোটা পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের এক পরিচিত নাম। তিনি সফল এবং সমৃদ্ধশালী এক মহিলা কৃষক। খুব অল্প বয়সে তাঁর বাবা চলে যান। পাঁচ বোন দুই ভাইয়ের সংসার। অভাবের সংসারে কোনওমতে পড়াশুনো চালিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর অদ্যম প্রচেষ্টা ছিল তাঁর। একটা সময় দাদা মুম্বইয়ে চাকরি পেলেন। খুব কমবয়সে সংসারের হালও ধরলেন। তখন মৌসুমী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পাঠরতা। হঠাৎ এক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় দাদার। অথৈ সাগরে পড়লেন মৌসুমী। পড়া থামিয়ে ফিরে এলেন গ্রামে। বাড়িতে বৃদ্ধা মা, অসুস্থ আরও এক বড় দাদা। তাঁর স্ত্রী, সন্তান— সবাই মৌসুমীর কাঁধে। সংসারে হাঁড়ি চড়া দায়। শূন্য থেকে শুরু করলেন মৌসুমী। মায়ের অনুপ্রেরণায় জমি লিজে নিয়ে শুরু করলেন চাষ। খুব কঠিন ছিল সেই দিনগুলো। বারবার ব্যর্থ হয়েছেন আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন। এরপর কৃষি নিয়ে একটা প্রশিক্ষণ নিলেন মৌসুমী। আবার শুরু করলেন ধান এবং একানি চাষ। একানি হল একধরনের ফসল যা মাছচাষে অপরিহার্য। এরপর তিনি শুরু করলেন গবেষণা। কারণ গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং দূষণের প্রভাবে দিনে দিনে পানীয় জলের পরিমাণ কমছে এবং বাড়ছে নোনা জলের পরিমাণ। আর ধান চাষে প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে জলের। সেই রেশিওটা হল এক কিলো ধানচাষ করতে এক হাজার লিটার জল। সেই জল খরচ কমিয়ে আনতে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য অনেকটা জল সংরক্ষণ করে রাখতে দীর্ঘদিনের গবেষণায় মৌসুমী আবিষ্কার করলেন উন্নতমানের বীজ। কম জলে ও শুষ্ক আবহাওয়ায় অধিক ফলনশীল ধান চাষের জন্য নতুন সেই বীজের নাম ‘এম যামিনী’। এই বীজ হাতে এলে উপকৃত হবেন চাষিরাও, কারণ অনেক কম জলে তাঁরা চাষ করতে পারবেন। ধানচাষের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ— সব তিনি একাই করেন। তার কাজের জন্য পেয়েছেন বহু সম্মান। ২০২৫-এ তাঁর জেলা মুর্শিদাবাদের প্রশাসন থেকে তাঁকে দেওয়া হয় ভূমিকন্যা সম্মান। আগামী দিনে মৌসুমীর পরিকল্পনা প্রকৃতিকে বাঁচানো, চাষে যথেচ্ছ সার আর কীটনাশকের ব্যবহার কমানো, বিষমুক্ত ফসল ফলানো। এর জন্য জরুরি উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন। যেসব মেয়ে আগামীতে কৃষিতে আসতে চান তাঁদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন সবার প্রিয় চাষের দিদিমণি।

Latest article