বিশ্ব একদিন রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই ভারত চিনেছিল। রবীন্দ্রনাথই বোধহয় প্রথম বাঙালি যিনি যতটা ভারতের, ততটাই গোটা বিশ্বের। তিনি বিশ্বনাগরিক। তিনি বিশ্ববীণায় তার বেঁধেছেন, বিশ্বজনের মন মোহিত করেছেন।
জাতীয়তাবাদের ক্ষুদ্র গণ্ডি অতিক্রম করে আন্তর্জাতিকতাবাদের পক্ষে সওয়াল করেছেন। তিনি নোবেল পেয়েছেন ১৯১৩ সালে। তারও আগে শিকাগোর ধর্ম মহাসভায় ঝড় তুলেছেন আরেক বঙ্গসন্তান— স্বামী বিবেকানন্দ। সালটা ১৮৯৩। ধর্ম মহাসভায় দাঁড়িয়ে প্রথম সম্বোধনেই আমেরিকাবাসীর মন জয় করেছেন। তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে আইরিশ মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল হয়েছেন ভগিনী নিবেদিতা। লোকমাতা হয়ে এই বাংলাকেই নিজের কর্মক্ষেত্র করে তুলেছেন। জন্মসূত্রে না হলে কী হবে, সারদা মায়ের প্রিয় ‘খুকি’ কি কোনও অংশে কম বাঙালি? তবে সবার আগে আসে রাজা রামমোহন রায়ের কথা। ভারতের ‘প্রথম আধুনিক মানুষ’, বিশ্বপথিকও বটে। তিনিই সতীদাহপ্রথা বিলোপের নেপথ্য নায়ক। লর্ড বেন্টিংক-এর প্রধান সহযোগী। ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে তাঁর প্রয়াণ। সেখানেই তাঁর সমাধিমন্দির।
বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও দেশনায়ক গোপালকৃষ্ণ গোখলের সেই বিখ্যাত উক্তিটি সবার জানা— বাংলা আজ যা ভাবে, ভারত তা ভাবে আগামীকাল। সাহিত্য-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, বাণিজ্য, কূটনীতি, রাজনীতি, প্রশাসন পরিচালনা— সমস্ত ক্ষেত্রেই পথ প্রদর্শক হয়ে থেকেছে বাংলা ও বাঙালি— দেশের কাছে, গোটা বিশ্বের কাছে। সেকাল থেকে একাল।
ব্রিটিশের দুর্ভেদ্য প্রশাসনিক দুর্গে প্রথম ভারতীয় হিসাবে ঢুকে পড়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম ভারতীয় আইসিএস। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের এক কৃতী সন্তান। আরও দুজন এমন বঙ্গসন্তানও রয়েছেন যাঁরা আইসিএস পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হয়েও হেলায় সেই লোভনীয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে দেশসেবায় ব্রতী হয়েছেন। সুভাষচন্দ্র বসু আর অরবিন্দ ঘোষ। আবার দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচন পরিচালনা করেছেন আরেক বাঙালি আমলা সুকুমার সেন— দেশের প্রথম নির্বাচন কমিশনার।
সুভাষচন্দ্র সে কংগ্রসের সভাপতির পদ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন সেই কংগ্রেসের প্রথম সভাপতিও এক বাঙালি— উমেশচন্দ্র বোনার্জি। অ্যানি বেসান্তের পর কংগ্রেসের দ্বিতীয় সভানেত্রীও বাঙালি— সরোজিনী নাইডু। পৈতৃক পদবি চট্টোপাধ্যায়। বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও প্রথম মহিলা ‘ভারতরত্ন’ অরুণা আসফ আলিও তো এই বাংলারই সন্তান। প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হিসাবে প্রণব মুখোপাধ্যায় সেরা বাঙালির তালিকায় জায়গাটা পাকা করে নিয়েছেন।
পরাধীন দেশে প্রথম স্বদেশি কল-কারখানা, প্রথম স্বদেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বদেশি ব্যাঙ্ক তৈরির কৃতিত্বও তো বাঙালির। প্রথম স্বদেশি জাহাজ কোম্পানির গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। সে কোম্পানি বেশিদিন না টিকলেও তাঁর পথ অনুসরণ করে বাঙালিরা আজ উদ্ভাবনায় সেরা। বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আক্ষেপ ছিল বাঙালিরা বাণিজ্য বোঝে না। তাই তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে শুরু করেছিলেন এক অভিনব বাণিজ্য উদ্যোগ ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’— যা এখনও টিকে রয়েছে স্বমহিমায়। বাঙালির উদ্যোগহীনতাকে ভুল প্রমাণ করেছেন হলদিয়া পেট্রোকেমিক্যালের অন্যতন কর্ণধার পূর্ণেন্দু চ্যাটার্জি ও দেশের বিখ্যাত রেস্তরাঁ চেনের প্রতিষ্ঠাতা অঞ্জন চ্যাটার্জি। উদ্ভাবক বাঙালির মধ্যমণি হয়ে রয়েছেন মণি ভৌমিক আর অমর গোপাল বোস। মণি ভৌমিকের উদ্ভাবিত লেজার বহু অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। আর ‘বোস’-এর সাউন্ড সিস্টেম মানেই আলাদা আভিজাত্য। মার্কিন নাগরিক হলে কী হবে এঁদের শিকড় তো আদতে এই বাংলাতেই।
বেতারের প্রথম উদ্ভাবকও এক বঙ্গসন্তান তবে স্বীকৃতিহীন। রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তিতে বাঙালি যতটা গর্বিত হয়েছে, জগদীশচন্দ্র বোসের নোবেল বঞ্চনায় তারা ততটাই ক্ষুব্ধ। যে বেতার আবিষ্কারের কৃতিত্ব আসলে তাঁর, মার্কনি সেটাকে অন্যায় ভাবে হাতিয়ে নেওয়ার জন্য ঔপনিবেশিক শাসনকে আজও দায়ী করে বাঙালি। আবার নোবেল বঞ্চিত হলেও বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু যে স্বীকৃতি পেয়েছেন তা কি আর কেউ পেয়েছেন? তাঁর নামে নামাঙ্কিত হয়েছে একটি পদার্থকণা— বোসন। এদেশে রাশিবিজ্ঞানের সূচনাও এক বাঙালির হাত ধরে— প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। তিনি ভারতের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার অন্যতম রচয়িতা, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা।
উদ্ভাবনের পাশাপাশি অর্থনীতির জগতেও বাঙালিদেরই আধিপত্য— সে দেশে হোক বা বিদেশে। নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন, নোবেলজয়ী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কৌশিক বসু, বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রণব বর্ধন, ডেভেলপমেন্ট অফ ইকোনমিক্স পত্রিকার সম্পাদক মৈত্রীশ ঘটক, বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের প্রতিষ্ঠাতা ও ক্ষুদ্র ঋণের অন্যতম প্রবক্তা নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস— বাঙালি অর্থনীতিবিদদের বিশ্বজয়ের তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। স্টেট ব্যাঙ্কের প্রথম মহিলা ডিরেক্টর হিসাবে বাংলার মুখ উজ্জ্বল করেছেন অরুন্ধতী ভট্টাচার্য। ইউরোপীয়ান ব্যাঙ্ক ফর রিকনস্ট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হয়েছেন প্রবাসী বাঙালি সুমা চক্রবর্তী।
আন্তর্জাতিক সাহিত্য জগতে বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করেছেন সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী। ম্যাগসেসে সম্মানও তিনি পেয়েছেন। আরেক খাঁটি বঙ্গসন্তান অমিতাভ ঘোষ বিশ্বজনের সম্মান পেয়েছে। সম্প্রতি ‘ও হেনরি’ সাহিত্য পুরস্কার পেয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বাংলার কথাসাহিত্যিক অমর মিত্র। বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে সাহিত্যিক শংকরের বিখ্যাত উপন্যাস ‘চৌরঙ্গি’। পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন ঝুম্পা লাহিড়ী, যদিও তিনি আমেরিকা নিবাসী।
বিশ্ববীণায় সে সুর একদিন একদিন রবীন্দ্রনাথ বেঁধে দিয়েছিলেন সেই সুরকে আরও ছড়িয়ে দিয়েছেন রবিশংকর, আলি আকবর খান, বিলায়েত খানের মতো বঙ্গসন্তানেরা। ভারতীয় নৃত্যশৈলীকে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপিত করেছেন উদয়শঙ্কর। পাঁচ বার গ্র্যামি সম্মান পেয়েছেন রবিশংকর। তাঁকে সম্মাননা দিয়ে গ্র্যামি সম্মানিত হয়েছে। বাংলার বাউল গান শুনিয়ে বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করেছেন পূর্ণদাস বাউল। বব ডিলানও তাঁর অনুরাগী। কিশোরকুমার (গাঙ্গুলি), বাপ্পি লাহিড়ী দেশে-বিদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা ও সম্মান পেয়েছেন।
সত্যজিৎ রায়ের শিল্প আর রবিশংকরের সংগীতের যুগলবন্দির ফসল ‘পথের পাঁচালী’ বিশ্বের সর্বকালের সেরা ছবিগুলির অন্যতম হয়ে উঠেছে। বিশ্ববাসীর কাছে ভারতীয় চলচ্চিত্রের মুখই হলেন সত্যজিৎ। সত্যিকথা বলতে কি আজকের বলিউডের ভিতটা গড়ে দিয়েছিলেন এক বাঙালি— শশধর মুখার্জি। বঙ্গকন্যা অভিনেত্রী দেবিকারানি বলিউডের প্রথম মহিলা প্রযোজক। তাঁর হাত ধরে হিন্দি ছবি সাবালক হয়েছে। ভারতীয় ছবিতে প্রথম চুম্বন দৃশ্যে অভিনয় করে হইচই তিনি ফেলে দিয়েছিলেন। তিনিই দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের প্রথম প্রাপক। আবার একালে বিশ্বসুন্দরীর মুকুট জিতে নিয়ে সাদামাঠা বঙ্গজীবনে গ্ল্যামার কোশেন্ট যোগ করেছেন আরেক বাঙালিনী সুস্মিতা সেন।
খেলার জগতে লর্ডসের ব্যালকনিতে ক্যাপ্টেন সৌরভ গাঙ্গুলির ‘দাদাগিরি’ দেখেছে গোটা বিশ্ব। আবার অলম্পিকের মঞ্চে বঙ্গকন্যা দীপা কর্মকার প্রমাণ করে দিয়েছেন জিমন্যাস্টিকেও ভারত আর ব্রাত্য নয়। প্রথম বাঙালি মহিলা হিসাবে আরতি সেন ও প্রথম বাঙালির পুরুষ হিসাবে মিহির সেন ইংলিশ চ্যানেল পার করেছেন। তাঁদেরই যোগ্য উত্তরসূরি বুলা চৌধুরি বা একালের সায়নী দাস।
যুক্তিতক্কে বাঙালিরদের জুড়ি মেলা নাকি ভার। তাই কূটনীতির জগতে বাঙালিরা বারবার শিরোনামে উঠে এসেছেন। আমেরিকার সঙ্গে ভারতের পরমাণু চুক্তির অন্যতম রূপকার রণেন সেন। রাষ্ট্রসংঘে ভারতের প্রথম স্থায়ী প্রতিনিধিও এক বঙ্গসন্তান— সমর সেন। তারপর বাঙালি কূটনীতিক রুনু ঘোষ থেকে শুরু করে একালের বিদিশা মৈত্র— রাষ্ট্রসংঘে দাঁড়িয়ে ভারতের অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন। বাঙালির শিক্ষাবিদেরা বরাবর বিশ্ববাসীর সমীহ আদায় করে নিয়েছেন।
পয়লা বাঙালির তালিকাটা এতই দীর্ঘ এই স্বল্প পরিসরে সবার কথা বলা এককথায় অসম্ভব। অনেকেরই নাম বাদ পড়ে গেছে। এই ত্রুটি মার্জনীয়। একালে থাকলে গোখলে হয়তো বলতেন, বাংলা শুধু ভাবে না, করেও দেখায়।