শীতে মানে শুধু লেপ-কম্বলে মুড়ি দিয়ে সুখনিদ্রা নয়। সুখের পাশে শীতের দুঃখ অনেক। নিভন্ত রোদ, গা-পিঠ, কোমর-হাত-পায়ের যন্ত্রণা, মাসল স্টিফনেস— কত কী! যত ঠান্ডা বাড়তে থাকে তত বাড়তে থাকে এইসব সমস্যা। কারও আর্থ্রাইটিস থাকলে তা আরও বেড়ে যায়। সাইটিকার সমস্যা বা ব্যথা, অতীতে খুব চোট পেয়েছে হাত, পা, হাঁটুতে বা কোমরে— সেইসব ব্যথা বাড়ে। বিশেষত বয়স্করাই শীতকালে এই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন। বলা যেতে পারে কমবেশি সকলেরই এই সমস্যা থাকেই। তাই শীতের শুরুতেই অনেক বেশি সচেতন হয়ে যাওয়া উচিত।
শীতে কেন বাড়ে ব্যথা
শীতে বাতাসের চাপ কমে যায়। সেই সঙ্গে অক্সিজেনের পরিমাণও কমে যায়। ফলে এই সময় নিঃশ্বাসের সঙ্গে খুব অল্প পরিমাণ অক্সিজেন শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে ফলে শরীর আরও বেশি স্থবির হতে থাকে। এই কারণে শীতে হাত ও পায়ের দিকে রক্তসঞ্চালন কমে যায় এবং অস্থিসন্ধিগুলোতে অর্থাৎ জয়েন্টে প্রদাহ বাড়তে থাকে। ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে শরীরে জড়তা আসে। শরীরে বিভিন্ন পেশি শক্ত হয়ে যায়। মাসল স্টিফনেস দেখা দেয়। এ ছাড়াও শরীরে অস্থিসন্ধির মাঝে যে তরল থাকে, এই মরশুমে তার ঘনত্ব বেড়ে যায়। তাই অস্থিতে নমনীয়তার অভাব দেখা দিতেই পারে। এই কারণেই গ্রীষ্মকালে শরীর অনেক বেশি রিল্যাক্সড বা ফ্লেক্সিবল থাকে।
এই ধরনের ব্যথা তাঁদের হয় যাঁরা ভারী কাজ করেন বা সারাদিন বসে কাজ করেন এবং যাঁদের ওজন খুব বেশি। তাঁদের সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর অস্থিসন্ধি শক্ত হয়ে থাকে। এঁদেরই কোমরের ব্যথায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় বেশি।
এছাড়া শীতকালে শরীরে ভিটামিন ডি-র পরিমাণ কমতে থাকে। কারণ, এই সময় দিন ছোট হয়ে যায়। সকাল ১০টার পর যে রোদ হয়, তা শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি করে না। আমাদের ত্বকের ভিতরে রয়েছে কোলেস্টেরল। এই কোলেস্টেরলের উপর এসে পড়ে সূর্যরশ্মি। তা থেকে তৈরি হয় ভিটামিন ডি। এই ভিটামিন ডি সরাসরি শরীর গ্রহণ করে। কিন্তু শীতকালে সেটা হয় না। এই ভিটামিন ডি কমতে থাকার ফলে ক্যালশিয়াম হাড়ের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে না। ফলে হাড়ের ক্ষয় অনিবার্য হয়ে পড়ে। অস্থিসন্ধিতে সমস্যা তৈরি হয়, রোগ প্রতিরোধ শক্তি দুর্বল হতে থাকে।
আবার যাঁরা ওবেসিটিতে ভুগছেন অর্থাৎ অত্যধিক বেশি, ওজন শীত শুরুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের এই ধরনের ব্যথা বেড়ে যায়। ভিটামিন ডি-র অভাবে শুধু হাড়ের ব্যথা বাড়ায় না, এটি বর্তমানে করোনা প্রতিরোধে কার্যকরী ফলে যাঁদের শরীরে ভিটামিন ডি, সি, ই-র অভাব, তাঁদের করোনা আক্রমণ করলে ক্ষতিটা বেশি হয়।
কী করবেন
ব্যথার জায়গাগুলোয় দিনে অন্তত দু’বার গরম সেঁক দিলে কিছুটা আরাম পাওয়া যায়। এককাপ জলে সামান্য পরিমাণ ম্যাগনেসিয়াম সালফেট মিশিয়ে ভাল করে গরম করে নিন। এবার ওই জলে কাপড় ডুবিয়ে সেঁক দিতে থাকুন। সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন করলে ভাল উপকার পাবেন।
এক গ্লাস জলে হলুদ আর আদা ফুটিয়ে নিন। জল ফুটে আধ কাপ হলে নামিয়ে নিন। এবার ছেঁকে নিয়ে মধু মিশিয়ে খান। দিনে দু’বার খেলেই কমবে ব্যথা। সারা শীতে খেতে পারলে সুস্থ থাকবেন।
রসুনের মধ্যে রয়েছে প্রদাহনাশক উপাদান সালফার। এটি রোগ প্রতিরোধশক্তি বাড়ায় এবং পেশি ও গাঁটের ব্যথা ও ফোলাভাব কমাতে সাহায্য করে। কাঁচা রসুন খেলে রক্তের চাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জয়েন্টে রক্তপ্রবাহ স্বাভাবিক থাকে বলে ব্যথা অনেকাংশে কম অনুভূত হয়। এজন্য প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক কোয়া কাঁচা রসুন চিবিয়ে খান। এছাড়া ব্যথার জায়গায় রসুন-তেল গরম করে নিয়মিত মালিশ করতে পারেন।
যথেষ্ট পরিমাণে গরম জামাকাপড় পরে শীত থেকে হাড় ও জয়েন্টকে রক্ষা করতে হবে। পা থেকে ঠান্ডা ওঠে। সেখান থেকেও অনেক সমস্যা হয়। তাই শীতে পায়ে টাইট স্ল্যাকস জাতীয় কিছু পরে থাকুন।
হট ওয়াটার ব্যাগ ব্যবহার করতে পারেন। একবার ঠান্ডা জল একবার গরম জল পদ্ধতিটি ১৫ মিনিট করলেই খুব ভাল ফল পাবেন। হট ওয়াটার ব্যাগে ৩০ মিনিট সেঁক দিন। সেঁক দিলে গাঁটের ব্যথার সমস্যা অনেকটাই কমে।
একটি গবেষণা অনুযায়ী কফি পান করলে শরীরের ব্যথা মরে যায়। দেখা গেছে, নিয়মিত ২০০ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন পান করলে মাথাব্যথা, মাইগ্রেনের ব্যথা অনেক কমে, সেই সঙ্গে গা-হাত-পায়ের ব্যথাও মরে।
নিয়মিত ২০-৩০ মিনিট যোগব্যায়াম করুন। যা পায়ের ব্যথা কমাতে সাহায্য করবে। স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ করুন। স্ট্রেচিং এক্সারসাইজ জয়েন্টগুলিকে লুব্রিকেন্ট করে এবং ফ্লেক্সিবল করে। এতে দেহের ভারসাম্য বাড়বে, স্নায়ুতন্ত্রকে প্রশমিত করবে, রক্তসঞ্চালন উন্নত হবে, নিতম্ব, পা, পায়ের পেশিতে চাপ কমবে।
শীতকালে উপযুক্ত খাদ্য এই ধরনের ব্যথাগুলো কমাতে সাহায্য করে। ভিটামিন ডি, সি, ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, আদা, সয়াবিন, সালমন মাছ, সবুজ শাক-সবজি, বাদাম, বীজ ও কোলাজেন সমৃদ্ধ খাবার পাতে রাখতে হবে শীতে। এই খাবারগুলো হাড়ের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এই সময় যদি হজমের সমস্যা না থাকে তাহলে দুধ খান। দুধে রয়েছে ভিটামিন ডি, ই এবং কে। যা শরীরে প্রদাহ নাশ করে।
গাজরের মধ্যে থাকে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। তাই গাজরের জুস বানিয়ে ওর মধ্যে পাতিলেবুর রস দিয়ে খান। খালি পেটে এক গ্লাস প্রতিদিন সকালে খেলে উপকার পাবেন।
তিলের বীজও ব্যথা সারাতে ভাল কাজ করে। এতে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে, যা মাথাব্যথা ও মাংসপেশির ব্যথা অনায়াসে দূর করতে সাহায্য করে।
অ্যাপেল সিডার ভিনিগারের সঙ্গে আদার রস মিশিয়ে খান। সামান্য মধু দিতে পারেন। হালকা গরম জলে মিশিয়ে খেতে হবে।
পুদিনা পাতায় রয়েছে মেনথল যা রোগ প্রতিরোধে কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া এর তেল পায়ের কবজি ও গোড়ালিতে মালিশে ব্যথা উপশম হয়। এমনকী মাথাব্যথায় পুদিনা পাতা কপালে ঘষলেও ব্যথার উপশম হয়।
গাঁটে গাঁটে ব্যথা
শীতকাল মানেই গা-হাত-পা, কোমর-হাঁটুর ব্যথায় জেরবার। যাঁদের বাত নেই তাঁদেরও নিস্তার নেই। এর নানা কারণ রয়েছে। তাপমাত্রা কমলেই শরীরে দেখা দেয় অক্সিজেনের ঘাটতি আর তার থেকেই শুরু হয় এই খুচরো অথচ দীর্ঘস্থায়ী বিপত্তি। ব্যথা মুক্তির উপায় কী? কী করবেন তারই গাইডলাইন দিলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী