পঞ্চায়েত সিজন ফোর

প্রাইম ভিডিও-য় মুক্তি পেয়েছে ‘পঞ্চায়েত সিজন ফোর’। ওয়েব সিরিজটি এনে দেয় মাটির গন্ধমাখা ঘরোয়া এবং আপন অনুভব। যাঁরা গ্রামীণ রাজনীতির গল্প পছন্দ করেন, তাঁদের ভাল লাগবে। লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

ছড়িয়ে পড়েছে গাছপালা এবং মাটির গন্ধ। আবারও দেখা হচ্ছে সহজ-সরল মুখগুলোর সঙ্গে। মুখগুলোর মধ্যে কেউ লাজুক। কারও মুখে হালকা হাসি। অজ গ্রাম। গ্রামে রাজনীতি আছে। তবে মারপ্যাঁচ নেই কথাবার্তায়। নেই অতি-চালাকি, জটিলতা। চতুর্দিকে আনন্দ ফুটে আছে। সবকিছুই বড় বেশি নির্মল। পবিত্র। এতগুলো কথা বলার কারণ একটাই— ২৪ জুন, প্রাইম ভিডিও-য় মুক্তি পেয়েছে জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ ‘পঞ্চায়েত সিজন ফোর’। করোনা-পর্বে লকডাউনে আটকে থাকা বদ্ধজীবনে হাসির দমকা হাওয়া এনে দিয়েছিল সিরিজটি। তখন থেকেই ফুলেরা গ্রামের মজার গল্প আর সাদাসিধে মানুষগুলি আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবারের সিজনে দেখা গেল, শুধুই গ্রামীণ জীবন নয়— গ্রামের ভোট-রাজনীতির আলোকালো দিক, প্রেমের টানাপোড়েন আর কিছুটা সাসপেন্স। সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক মিশ্র স্বাদ।

আরও পড়ুন-দিল্লির করোলবাগে জনপ্রিয় পোশাকের শো-রুমে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড, লিফটেই মৃত ১

সিজন ফোরের গল্প শুরু হয়েছে সিজন থ্রি-র ঠিক পরপরই। আগেই দেখানো হয়েছে— প্রধানজি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। এখন তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ। তবে প্রচণ্ডভাবে মানসিক চাপ রয়েছে। সচিবজি কোর্ট-কাছারির ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছেন। যার মূল কারণ স্থানীয় বিধায়কের সঙ্গে জোর সংঘাত। অন্যদিকে ক্যাট পরীক্ষার রেজাল্টের জন্যও চলেছে অপেক্ষা। এমন সময় গ্রামে শুরু হয়ে গিয়েছে প্রধান নির্বাচনের প্রস্তুতি। দাঁড়িয়েছেন দুই মহিলা। একদিকে মঞ্জু দেবী। অন্যদিকে ক্রান্তি দেবী। যদিও আসল লড়াই তাঁদের স্বামী প্রধানজি এবং ভূষণের মধ্যে। এই নির্বাচনকে ঘিরেই চলতে থাকে নানা কাণ্ড। কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে মঞ্জু দেবী। কারণ, ক্রান্তি দেবী, বনরাকস, ভূষণ আর তাদের গোষ্ঠী প্রধানজিদের কার্যত জ্বালিয়ে মারছে। ওদিকে বিধায়কও এই বিরোধী দলের পাশেই দাঁড়িয়েছে।
কৌশল, কটূক্তি এবং গ্রামীণ দৃশ্যের মাধ্যমে নির্বাচনটি সিজনের কাহিনিতে প্রাধান্য পেয়েছে। তবে নতুন শক্তি আনার পরিবর্তে, গল্পটি প্রসারিত এবং দুর্বল বলে মনে হয়েছে। বিশেষত সিরিজের প্রথম দিকে গল্প কিছুটা শ্লথ লেগেছে। ভোট ঘনাতে শুরু করলেই রাজনীতির আসল রং দেখা যায়। কোথাও হাসি, কোথাও কষ্ট, কোথাও আবার রাগ। ক্রান্তি দেবী আর মঞ্জু দেবীর ভোট লড়াই দেখতে যেমন ভাল লাগে, তেমনি মাঝে মাঝে মনেও হয় একটু যেন একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই বোঝা যায়, কী হতে চলেছে। ফলে চমক তুলনায় একটু কম।
সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হল, সচিবজি, বিকাশ, প্রহ্লাদ এবং প্রধানজি-র মধ্যে যে বন্ধুত্ব এবং চরিত্রের বন্ধন ছিল, সেটা এই সিজনে কোনও ভাবেই ফুটে উঠছে না। তাদের রসায়ন, যা একসময় গল্পের মূল আকর্ষণ ছিল, সেটা মোটামুটি অনুপস্থিত। মাঝপথে প্রহ্লাদ এবং বিকাশকে কেন্দ্র করে একটি সংক্ষিপ্ত আবেগঘন সাব-প্লট রয়েছে, কিন্তু সেটা জোরপূর্বক। গল্পের স্বাভাবিক ছন্দের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয় না। সিজন থ্রি-এ সচিবজি আর রিঙ্কির সম্পর্ক যেভাবে একটু গতি পেয়েছিল। দর্শকেরা আশা করেছিলেন এবার হয়ত প্রেমটা একটু জমাট বাঁধবে। এবার সেটাও হয়নি। ফলে সেই জায়গাটা খালি খালি লেগেছে।

আরও পড়ুন-কেরলে কমরেডদের কীর্তি কেলেংকারি

দুর্বল চিত্রনাট্য সত্ত্বেও, অভিনেতারা প্রশংসনীয় অভিনয় করেছেন। কয়েকটা নতুন চরিত্র এসেছে বটে, কিন্তু তাঁরা সিরিজে তেমন প্রভাব ফেলেন না। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে স্বাভাবিক দক্ষতা দেখিয়েছেন প্রায় প্রত্যেকেই। সচিবজি চরিত্রে জিতেন্দ্র কুমার, মঞ্জু দেবী চরিত্রে নীনা গুপ্তা, প্রধানজি চরিত্রে রঘুবীর যাদব, ক্রান্তি দেবী চরিত্রে সুনীতা রাজওয়ার, রিঙ্কির চরিত্রে সানভিকা এককথায় অনবদ্য। এছাড়াও চন্দন রায়, ফয়সাল মালিক-সহ বাকিরা তাঁদের নিজ নিজ চরিত্রে সাবলীল। এর মধ্যে বিশেষ করে বলতে হয় বিনোদের চরিত্রে অশোক পাঠকের কথা। আট এপিসোডের মধ্যে শেষ এপিসোডে তাঁর আবেগ, অভিব্যক্তি দর্শকের মনে গেঁথে যায়। এই সিরিজে বিনোদ একমাত্র চরিত্র, যে বাঁচিয়ে রেখেছে পুরনো ফুলেরা গ্রামকে। প্রধানজি এবং তার দলবল এই বোকা অথচ বদমাইশিতে কম না-যাওয়া বিনোদকে নিমন্ত্রণ করে। উদ্দেশ্য একটাই— যদি সে দল বদলায় এবং প্রতিপক্ষের দুর্বলতা ফাঁস করে দেয়। ভরপেট লুচি, সিমুইয়ের পায়েস খাওয়ার পর বিনোদ বুঝতে পারে, ভালবেসে নয় স্বার্থ আছে বলেই তাকে এই আপ্যায়ন করা হয়েছে। ভালো করে দু-বেলা খেতে পায় না। তাই তো রাজি হয়েছে নেমন্তন্ন রক্ষা করতে। বুঝতে পেরে মনখারাপ হয় তার। সে মুখের উপর জানিয়ে দেয়, দলবদল করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। গরিব হতে পারে সে, তবে গদ্দার নয়।
ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। তা সত্ত্বেও ‘পঞ্চায়েত সিজন ফোর’ আগের মতোই এনে দেয় মাটির গন্ধমাখা একটা ঘরোয়া এবং আপন অনুভব। তবে এবার হাসির তুলনায় রাজনীতির ছাপ বেশি। যাঁরা গ্রামীণ রাজনীতির গল্প পছন্দ করেন বা আগের সিজনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের এই সিজন ভাল লাগবে। কিন্তু যাঁরা শুধু হালকা-ফুলকা কমেডি খুঁজছেন বা প্রথমবার দেখছেন, তাঁদের কাছে সিরিজটা তুলনায় কম আকর্ষণীয় হতে পারে।
দীপককুমার মিশ্র ও অক্ষত বিজয়বর্গীয় পরিচালিত সিরিজটি লিখেছেন চন্দন কুমার। এরমধ্যেই সিরিজ ফাইভের খবর ভেসে এসেছে। জানা গেছে, শুরু হয়েছে প্রস্তুতি। আশা করা যায়, পরের সিরিজ এই ভুলভ্রান্তিগুলো দূর করবে। আনবে গতি। সেইসঙ্গে ফিরিয়ে আনবে চেনা গ্রামের
চেনা পরিবেশ।

Latest article