পার্কিনসনস

মানসিক চাপ, উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা যত বাড়বে ততই বাড়বে পার্কিনসনস ডিজিজ। এটি একটি জটিল স্নায়বিক অসুখ। আগামী ১১ এপ্রিল বিশ্ব পার্কিনসনস দিবস। গবেষণা বলছে বিশ্বের এক কোটির বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

দিনে দিনে হাঁটার গতি কমছে ঠাম্মির। নীতু রোজ লক্ষ্য করে। আগে সইটা খুব সুন্দর করত ঠাম্মি। এখন সই করতে গেলে বেশ কয়েকবার প্র্যাকটিস করিয়ে নিতে হয়। আনন্দ নেই ঠাম্মির মনে একটা ডিপ্রেশন সারাক্ষণ। ইদানীং ঠিকমতো খেতে চাইছে না। হাতটা খুব কাঁপে। জামাকাপড় ছাড়তে একেবারে ল্যাজেগোবরে। এই সবই নাকি পার্কিসনস-এর লক্ষণ। নীতু জানতে চেয়েছিল রোগটা সম্পর্কে। ডাক্তার বলেছেন এই রোগে আক্রান্তেরা ক্রমেই স্বাভাবিক কাজ করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেন। পোশাক পরিবর্তন থেকে বাথরুম যাওয়া— সব কিছুর জন্যই অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে থাকেন দিনে দিনে। এমনই জটিল স্নায়ুর অসুখ।
পার্কিনসনস ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে বিশ্বে এক কোটির বেশি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। ১৮১৭ সালে চিকিৎসক জেমস পার্কিনসন্স চিহ্নিত করেন রোগটিকে। দু’দশক আগেও এই রোগ সম্পর্কে মানুষের তেমন ধারণা ছিল না। এখন দিনে দিনে বাড়ছে এই অসুখ। প্রতিবছর ১১ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে পালিত ‘বিশ্ব পারকিনসনস দিবস’। এই দিনটি পালনের উদ্দেশ্য পার্কিনসনস রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং আক্রান্তদের পরিবারকে সঠিক পথের দিশা দেখানো।

আরও পড়ুন-পার্কিনসনস

কারা বেশি আক্রান্ত
বেশি বয়সের রোগ পার্কিনসনস। মহিলাদের হয় তবে পুরুষদের সংখ্যাই অনেক বেশি। মূলত বয়স্কদের রোগ হলেও আক্রান্ত হতে পারেন কমবয়সিরাও। চিকিৎসার পরিভাষায় একে বলা হয় ‘ইয়ং অনসেট পার্কিনসনস ডিজ়িজ়’ (ওয়াইওপিডি)। সমীক্ষা বলছে, বিশ্বে পার্কিনসনস রোগে আক্রান্তদের দুই শতাংশ এই ওয়াইওপিডির শিকার। কারও পরিবারে মা অথবা বাবা যদি পার্কিনসনসের শিকার হন, তা হলে তাঁদের সন্তানদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা ৩০ শতাংশ।
উপসর্গ
ঘন ঘন পেশি শিথিল হয়ে পড়ে।
বিশ্রামে থাকাকালীন পেশির কম্পন হয়।
পেশি শক্ত হয়ে যায়, স্টিফনেস। নড়াচড়া করা কঠিন হয়ে পড়ে।
হাঁটাচলার সমস্যা হয়। হাঁটার সময় ভারসাম্য বজায় রাখতে অসুবিধা, নড়াচড়ার গতি কমে যায়— একে বলে ব্র্যাডিকাইনেসিয়া।
ফেসিয়াল মাস্কিং অর্থাৎ মুখমণ্ডলে স্বাভাবিক অভিব্যক্তি কমে যায় ফলে মুখ নিষ্প্রাণ দেখায়।
বারবার পড়ে গেলে বুঝতে হবে সমস্যা হচ্ছে।
ঘুমের সমস্যা। রাতে ঘুমাতে অসুবিধা এবং দিনের বেলা অতিরিক্ত ঘুম ঘুম ভাব।
হতাশা এবং উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং মেজাজ পরিবর্তনের প্রবণতা।
স্মৃতিশক্তির সমস্যা, কিছু ক্ষেত্রে স্মৃতিশক্তি কমে যাওয়া বা চিন্তাভাবনায় সমস্যা।
কোষ্ঠকাঠিন্য, হজমে সমস্যা হতে পারে।
গন্ধের অনুভূতি হ্রাস, কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ঘ্রাণশক্তি কমে যেতে পারে।
ক্লান্তি, অতিরিক্ত ক্লান্তি বা দুর্বলতা অনুভব করা।
অস্থির পা, রাতে পায়ে অস্থিরতা বা ব্যথার অনুভূতি।
চিকিৎসা
পার্কিনসনস-এর জন্য কিছু নির্দিষ্ট ওষুধ রয়েছে। পার্কিনসনস সম্পূর্ণ সারে না তবে মেডিকেশনের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। চিকিৎসকেরা প্রথমে সেই চেষ্টাই করেন। দীর্ঘদিন ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। তবে সেই ওষুধ কাজ না দিলে এরপর কিছু থেরাপি রয়েছে পার্কিসনস-এর চিকিৎসায়, যার মধ্যে অন্যতম হল ‘ডিপ ব্রেন স্টিমুলেশন থেরাপি’। এই চিকিৎসায় এখনও পর্যন্ত ভালই সাড়া পাওয়া গেছে। যদিও তা খরচসাপেক্ষ।

আরও পড়ুন-রাম-বামের লাগাতার অপপ্রচারের বিরুদ্ধে লাভপুরে বিধায়কের উদ্যোগে অঞ্চলসভা

কেন হয়
চিকিৎসকদের মতে, দিনে দিনে পার্কিনসনস বেড়ে চলার অন্যতম কারণ মানুষের ক্রমবর্ধমান গড় আয়ু। এছাড়া রয়েছে অন্য কারণ যেমন, চাষে কীটনাশকের ব্যবহার, প্লাস্টিক-দূষণ, বায়ুদূষণ, জলদূষণ এবং কমসংখ্যক হলেও জেনেটিক মিউটেশন। কমবয়সিদের মধ্যেও এই রোগ দেখা যাচ্ছে, যার কারণ জেনেটিক মিউটেশন। ডোপামিন নামক একটি রাসায়নিক আমাদের মন-মেজাজের উপর প্রভাব ফেলে। মস্তিষ্কের যে অংশ থেকে ডোপামিন নিঃসৃত হয়, তা অকেজো হলে পার্কিনসনস হতে পারে।
সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে পার্কিসনস-এর উৎস হল পেট। ইজরায়েলের একদল পেট। ইজরায়েলের একদল স্নায়ু চিকিৎসক দেখিয়েছেন পেটেই প্রথম হানা দেয় পার্কিনসনস। সেখানেই দীর্ঘসময় ঘাপটি মেরে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বিশেষ একরকম প্রোটিনে ভর করে স্নায়ু বেয়ে বেয়ে লাফিয়ে ওঠে মস্তিষ্কে। পেটের গোলমাল, হজমের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, গ্যাস-অম্বল থেকে শুরু হয়। অন্ত্রের ক্ষতি যদি বেশি মাত্রায় হয়, তা হলে সেখানকার স্নায়ুও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্নায়ু মারফত সঙ্কেত মস্তিষ্কে পৌঁছতে পারে না। মানসিক সমস্যা দেখা দিতে থাকে। সেখান থেকেই মস্তিষ্কে প্রভাব খাটাতে শুরু করে পার্কিনসনস। কাজেই সুস্থ খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম, প্রাণায়াম সবার জন্যই খুব জরুরি।

আরও পড়ুন-বাগান সদস্যদের জন্য বাড়তি সময়

যে মহিলা পারকিনসনস শুঁকতে পারেন
তিনি গন্ধ শুঁকেই বলে দিতে পারেন পারকিনসনস হবে কি না! শুনলে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি। বিরল প্রতিভার এই মহিলাকে নিয়ে চলছে গবেষণা। কয়েক বছর আগে জয় মেলর এই বিশেষ ক্ষমতা দেখে হতবাক হয়ে যান চিকিৎসকেরা। ৭৩ বছরের জয় স্কটল্যান্ডের পার্থের বাসিন্দা। পেশায় নার্স। তিনি তাঁর অতি সংবেদনশীল ঘ্রাণশক্তির (হাইপারসমিয়া) মাধ্যমে শনাক্ত করতে পারেন পারকিনসনস। জয়ের স্বামী লেসের বয়স তখন ৩৩ বছর। ওই বয়সে পারকিনসনস-এর কোনও লক্ষণই ছিল না লেসের। সেই সময় থেকেই জয় কেমন যেন গন্ধ পেতেন স্বামীর গায়ে। পরে ধরা পড়ে তাঁঁর এই রোগ। ‘যে মহিলা পারকিনসনস শুঁকতে পারেন’— এই নামে জয় পরিচিতি পান। বিজ্ঞানীরাও খুঁজতে শুরু করেন, ঠিক কোন গন্ধ পান তিনি পারকিনসনস রোগীদের মধ্যে। শুরু হয় গবেষণা।
অনেক বছর পর ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা জয়ের এই গুণকে কাজে লাগিয়ে আবিষ্কার করেন পারকিনসনস নির্ণয়ের পরীক্ষা। ঘাড় থেকে রস (সোয়াব) সংগ্রহ করা হয়। সেই নমুনা পরীক্ষা করে জানা যায়, ওই ব্যক্তি পারকিনসনস আক্রান্ত কি না। তবে এই নিয়ে এখনও পর্যন্ত চলছে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

Latest article