ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় : সত্তর দশকের শুরু। নকশাল আমল। বাংলা জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা। চারদিকে বারুদের গন্ধ। প্রত্যেকদিন খুন। জখম রক্তে রাঙা রাজ্য রাজনীতি। সিপিএম বনাম নকশাল খুনোখুনির খবর রোজ সংবাদের শিরোনামে। সদ্য আশুতোষ কলেজে ভর্তি হয়েছি। সেই সময় নাকতলা বাসস্ট্যান্ডে নিয়মিত আড্ডা দিতাম কয়েকজন। হঠাৎ একদিন সেখানে ট্যাক্সি থেকে নামলেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। বললেন, তুই ছাত্র পরিষদ কর। তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলাম। সেই শুরু। ছাত্র রাজনীতির জন্য সময়টা কঠিন তখন। চারদিকে পুলিশি ধরপাকড় চলছে। এই অস্থির অবস্থার মধ্যেই আশুতোষ কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচন হল। আর সেই প্রথমবার জয়ী হল ছাত্র পরিষদ। সবাই চাইছিল আমি সাধারণ সম্পাদক হই। কিন্তু বাইরের জেলার কিছু নেতার কলকাঠি নাড়ানোয় আমি আর সাধারণ সম্পাদক হতে পারিনি। তখন আমাদের একজন সিনিয়র অচিন্ত্য মুখোপাধ্যায় একডালিয়ায় থাকতেন। জীবনদার রেশন দোকান— এখন যেখানে বহুতল হয়েছে। সেখানেই দোতলায় সুব্রতদা থাকতেন। সেই প্রথম মুখোমুখি।
আরও পড়ুন-ইন্দিরাজির পুত্র ছিলেন সুব্রতদা
আশুতোষ কলেজে ছাত্র পরিষদ ভোটে জিতেছে শুনে উনি খুব খুশি হলেন। নিজেই উদ্যোগী হয়ে একটা চিঠি লিখে দিলেন। সেই চিঠি নিয়ে আমরা গেলাম গৌতম চক্রবর্তীর কাছে। তিনি ছিলেন পর্যবেক্ষক। আমরা জানতাম সুব্রত মুখোপাধ্যায় মানেই আন্দোলন। একটা সময় ট্রামে, বাসে— ছাত্রছাত্রীদের কনসেশন কমানো নিয়েও আন্দোলন করেছিলেন। কিন্তু আবার এই সুব্রতদাই যখন মন্ত্রী হলেন, নিজেই যেসব দাবি তুলেছিলেন নিজে তা আর পূরণ করতে পারেননি। এটা খারাপ লেগেছিল। একদিন করলাম কী, আশুতোষ কলেজের সামনে সুব্রতদার গাড়ি আটকানো হল। ইস্যু সেই ট্রাম, বাসে ছাত্রছাত্রীদের কনসেশন। যে দাবি নিয়ে একদিন সুব্রতদাই আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেই দাবিতে তাঁর গাড়ি ঘিরেই স্লোগান দেওয়া শুরু হল। ছাত্র পরিষদ করতে এসে অনুভব করলাম তৎকালীন কংগ্রেস রাজনীতিতে দুই শিবির। একটার নেতা প্রিয়দা, সঙ্গে সুব্রতদা, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়, দেবপ্রসাদ রায়, কুমুদ ভট্টাচার্যরা। আরেক শিবিরের নেতা প্রফুল্ল ঘোষ। সেখানে ছিলেন শত ঘোষ, সোমেন মিত্র, প্রদীপ ভট্টাচার্যরা।
আমি মূলত প্রিয়-সুব্রত শিবিরের অনুগামী হয়ে পড়লাম। প্রিয়দা তখন দক্ষিণ কলকাতা থেকে লোকসভার সাংসদ। সঙ্গে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। তাঁর সহযোগী হিসাবে সুব্রতদাও চুটিয়ে রাজনীতি করছেন। প্রিয়-সুব্রত জুটির জনপ্রিয়তা তখন মধ্য গগনে। এই সময় সুরেন ঠাকুর রোডের কাছে একটা বাড়িতে সুব্রতদা থাকতেন। সেখানে আমরা হাজির হতাম মাঝেমধ্যেই। একবার আমি আর সেই সময় শ্যামাপ্রসাদ কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক অরবিন্দ ঘোষ দু’জনকেই কুমুদদা শোকজ করেছিলেন। সেবার আমাদের ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন সুব্রতদা। চাকরি জীবনে প্রবেশের পরেও সুব্রতদার সঙ্গে আমার যোগাযোগ কখনও নষ্ট হয়নি।
১৯৯৮ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি করলেন। সুব্রতদা সেই সময় দলে যোগ দেননি। তিনি দলে এলেন ২০০০ সালে। তারপরেই ২০০১-এ কলকাতা পুরসভার মেয়র হলেন। ২০০৬-এ আবার দল ছেড়ে দিলেন। আবার ফিরলেন ২০১০ সালে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আমরা যখন কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলন করছি তখন আইএনটিইউসির হয়ে আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন সুব্রতদা। আমাদের সঙ্গে রাতও জেগেছেন সেই সময়ে। সুব্রতদার সঙ্গে বহু জেলায় ঘুরেছি, অসংখ্য রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করেছি। সুব্রতদা ভূতে সাংঘাতিক ভয় পেতেন। তাঁর ধারণা ছিল আলো নিভলেই ভূতেরা হানা দেয়। এই ভয়ে সারারাত আলো জ্বালিয়ে ঘুমোতেন। একা শুতে পারতেন না, কাউকে না কাউকে পাশে শুতে হত। সুব্রতদাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম হঠাৎ সিনেমায় নামলে কেন? প্রসঙ্গত, সেই সময় সুব্রতদা ‘চৌধুরী ফার্মাসিউটিক্যাল’ বলে একটা ছবি করেছিল। সুদর্শন সুব্রতদার সঙ্গে সেই সময়ের তারকা অভিনেত্রী মুনমুন সেনকে ঘিরে রোজ নতুন নতুন খবর। কেন সিনেমায় নেমেছিলেন, সেকথার উত্তর অবশ্য আজও জানি না।
এহেন সুব্রতদার নাগাল পাওয়া আবার একেক সময় অসম্ভব হয়ে উঠত। একই সঙ্গে একাধিক লোককে দেখা করার সময় দিতেন। কিন্তু গিয়ে কেউই দেখা পেত না। কেননা তার আগেই তিনি অন্য কোথাও চলে গিয়েছেন। একবার দিল্লির টিকিট নিয়ে লোকজন এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে আছে, সুব্রতদা চলে গেলেন মুম্বই। ইন্দিরা গান্ধীর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র ছিলেন সুব্রতদা। হেলিকপ্টারে ঘুরে বেড়াতেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে।
আরও পড়ুন-ইন্দিরাজির সঙ্গে সেদিন সেই কপ্টারে
সুব্রতদার মাতৃভক্তি ছিল প্রবল। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। তাই পারিবারিক মূল্যবোধের শিক্ষাটা ছোটবেলা থেকেই ছিল মজ্জাগত। কলকাতার গড়িয়াহাটে থাকলেও রবিবার করে যেতেন সারেঙ্গাবাদের বাড়িতে। শেষদিন পর্যন্ত এই নিয়মে খুব একটা ব্যতিক্রম হয়নি। বাঙালি মানেই দুর্গাপুজো নিয়ে আবেগ থাকবেই। কিন্তু সুব্রতদা ছিলেন যাকে বলে পুজো পাগল। রাজনীতির পাশাপাশি এত আবেগ নিয়ে পুজো করতে খুব কম লোককেই দেখেছি। সেই মানুষটা এমন আচমকা কালীপুজোর রাতে আমাদের ছেড়ে চলে যাবে ভাবতে পারিনি। মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে বসেই খবর পাচ্ছিলাম অবস্থার অবনতির। অবশেষে আশঙ্কাই সত্যি হল। দীপাবলির আলো ঝলমলে রাতে সব আলো নিভিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেল সুব্রতদা। তোমাকে আমরা মিস করব সুব্রতদা।