‘এমন তরণী বাওয়া’র ভাবনাটা কার মাথায় এসেছিল?
পার্থ ঘোষ ও গৌরী ঘোষের (Partha Ghosh- Gouri Ghosh) আবৃত্তি শুনে বড় হয়েছি। কবিতার প্রতি ভালবাসার পিছনেও পরোক্ষভাবে আছেন এই দুই মানুষ। অবশ্য তাঁদের খুব একটা ঘনিষ্ঠ ছিলাম না। তবে দুজনকে নিয়ে একটা কাজটা করার কথা মনে হয়েছিল। সেটা ২০২০ সালে। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে। একদিন ভাবনাটা জানাই ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তারপর সুমন্ত্র সেনগুপ্তকে। দুজনেই প্রযোজনা করতে রাজি হয়ে যান। তাঁদের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ। ব্রততীদির ‘ব্রততী পরম্পরা’ এবং সুমন্ত্রদার ‘শঙ্খমালা’র ব্যানারে তৈরি হয় ‘এমন তরণী বাওয়া’। এই দুই সংস্থার জন্য পার্থ ঘোষ ও গৌরী ঘোষকে নিয়ে কাজটা করতে পারলাম।
তথ্যচিত্রের প্রস্তাব পেয়ে পার্থ ঘোষ ও গৌরী ঘোষের (Partha Ghosh- Gouri Ghosh) প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
দুজনেই খুব খুশি হয়েছিলেন। প্রথমে গৌরীদি, পরে পার্থদা। বলেছিলেন, হোক কাজটা। ২০২১-এর জানুয়ারি মাসে শুরু হয় প্রি-প্রোডাকশনের কাজ। শুটিং হয় ফেব্রুয়ারি মাসে। ওঁদের পুত্র অয়ন ঘোষ এবং চন্দন মজুমদার যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। সহযোগিতা করেছেন কৃষ্ণশর্বরী দাশগুপ্ত।
শুটিং হয়েছে কোথায়?
পার্থদা-গৌরীদির (Partha Ghosh- Gouri Ghosh) বাড়িতে শুটিং হয়েছে একদিন। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। তার আগেও অবশ্য বেশ কয়েকদিন গেছি। দীর্ঘসময় কাটিয়েছি। অ্যালবাম ঘেঁটেছি, প্রচুর আলোচনা করেছি। পাশাপাশি শুটিং হয়েছে কলেজ স্ট্রিট, ময়দান, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, রবীন্দ্র সদন, একাডেমি অফ ফাইন আর্টসে। দুজন ছেলেমেয়েকে কমবয়সি পার্থ ঘোষ-গৌরী ঘোষ সাজানো হয়েছিল। অতীতটা তুলে ধরার জন্য। আউটডোর শুটিং হয়েছে তাঁদের নিয়েই। ইনডোর, আউটডোর মিলিয়ে মোট ৬ দিন শুটিং। তথ্যচিত্রে পার্থ ঘোষ ও গৌরী ঘোষের নিজেদের কথাবার্তা তো আছেই, পাশাপাশি কথা বলেছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, পবিত্র সরকার, জগন্নাথ বসু, ঊর্মিমালা বসু, বিজয়লক্ষ্মী বর্মন, প্রদীপ মিত্র প্রমুখ। ভাষ্যপাঠ করেছেন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিচালনার পাশাপাশি চিত্রনাট্য, আবহ, সম্পাদনা আমার। তথ্যচিত্রটি ৫৮ মিনিটের।
প্রথম কবে দেখানো হয়েছে?
২০২১-এর ৩০ সেপ্টেম্বর, মধুসূদন মঞ্চে, গৌরী ঘোষের জন্মদিনে। তার আগেই অগাস্টে গৌরীদি চলে গেছেন। ওই অনুষ্ঠানে পার্থদা তথ্যচিত্রটা দেখেছিলেন। প্রশংসা এবং আশীর্বাদ করেছিলেন।
আরও পড়ুন: মোড় ঘোরানো ১১ বছর
তারপর কোথায় দেখানো হয়?
তারপর দেখানো হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কবিতা উৎসবে, একতারা মুক্তমঞ্চে। পরে আন্তর্জাতিক কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবেও দেখানো হয়েছে। নন্দন-৩ প্রেক্ষাগৃহ এবং শিশির মঞ্চে। বড় পর্দায় বহু দর্শক দেখেছেন এবং তাঁদের ভাললাগার কথা জানিয়েছেন।
‘এমন তরণী বাওয়া’ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা?
ছবিটা বিভিন্ন জেলায় বড় পর্দায় দেখানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আশা করি এর ফলে নতুন প্রজন্মের আবৃত্তিশিল্পী এবং কবিতাপ্রেমীরা উপকৃত হবেন। প্রসঙ্গত জানাই, লাসভেগাস-সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক তথ্যচিত্র উৎসবেও ছবিটা প্রদর্শিত হবে।
এত মানুষ দেখবেন, ছবি তৈরির সময় ভেবেছিলেন?
এত জায়গায় দেখানো হবে, এত মানুষ দেখবেন ভেবে কিন্তু আমরা কাজটা করিনি। মূল উদ্দেশ্য ছিল বাচিক শিল্পের এই দুই কিংবদন্তিকে পরের প্রজন্মের জন্য ধরে রাখা। দুজনের কীভাবে আলাপ, তাঁরা কীভাবে কথা বলেন, কবিতা এবং আবৃত্তি নিয়ে কী তাঁদের ভাবনা, আকাশবাণীর সঙ্গে সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে দুজনের কাছে জানতে চেয়েছি। তাঁরা যতটা সম্ভব বলেছেন। যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। কোনও কোনও জায়গায় পার্থদার হয়তো বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল, গৌরীদি তখন বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। শুধু গুরুগম্ভীর কথা নয়, মাঝেমধ্যে এসেছে মজার কথাও। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুজনের আলাপ। তারপর ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে বিভিন্ন জায়গায় একসঙ্গে অনুষ্ঠানে যাওয়া। নন্দীগ্রামে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে ঘনিষ্ঠতা। তারপর একটা সময় একসঙ্গে পথ চলার সিদ্ধান্ত। সব কথাই অকপটে বলেছেন। উঠেছে দুজনের অগণিত ভক্তর প্রসঙ্গও।
মানুষ হিসেবে পার্থ ঘোষ ও গৌরী ঘোষ কেমন ছিলেন?
একেবারেই মাটির মানুষ। যাকে বলে ডাউন টু আর্থ। দুজনেই বাচিক শিল্প জগতে সেলিব্রেটি। যাপন করেছেন কালারফুল জীবন। সবাই তাঁদের চেনেন, জানেন। অথচ তাঁদের দেখলে সেটা বোঝাই যেত না। দুজনেই খুব আন্তরিক। সহজেই আপন করে নিতেন। ফলে কাজটা করতে আমাদের খুব সুবিধা হয়েছে। যেমনটা চেয়েছি, তেমনটা পেয়েছি। পার্থদার বাড়িতে বিশাল বইয়ের সম্ভার। তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। প্রচুর বই পড়তেন। কবিতার পাশাপাশি অন্যান্য বই। পুরোনো লেখা তো বটেই, সাম্প্রতিক সময়ের লেখাও। দুজনেই বলতেন, না পড়লে জানব কীভাবে! পড়াশোনার ব্যাপারে গৌরীদি বিভিন্ন সময় পার্থদার সাহায্য নিতেন। পার্থদার প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী ছিল। আবৃত্তি শেখাতেন। তবে গৌরীদি আলাদাভাবে কাউকে শেখাননি। বলতেন, আমি কতটুকু জানি যে শেখাব? যাঁরা গৌরীদির কাছে শিখেছেন, তাঁরা কোনও বিশেষ প্রোডাকশনের জন্য শিখেছেন। উপমা-র ব্যানারে প্রচুর অনুষ্ঠান করতেন।
অন্য কোনও শখ?
পার্থদার ছিল দেশ-বিদেশের পুতুল সংগ্রহ এবং জমানোর শখ। মৃত্যুর কয়েকমাস আগেও তিনি পুতুল সংগ্রহ করেছেন। সারা পৃথিবীর পুতুল সাজিয়ে রাখতেন ঘরে। আমরা যেটুকু পেরেছি, তথ্যচিত্রে ধরেছি। সবটা রাখতে পারিনি।
পার্থ ঘোষের প্রয়াণ আবৃত্তিশিল্পে কতটা শূন্যতা তৈরি করেছে?
৭ মে পার্থ ঘোষ চলে গেলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘কর্ণ-কুন্তী সংবাদ’ আবৃত্তির মধ্যে দিয়ে জয় করেছিলেন অগণিত মানুষের মন। গৌরী ঘোষের সঙ্গে জুটি বেঁধে। ইংরেজি তারিখ হিসেবে কবিগুরুর জন্মদিনেই চলে গেলেন পার্থদা। বাংলায় পঁচিশে বৈশাখের ঠিক আগে। তাঁর প্রয়াণে আবৃত্তিশিল্পে বিরাট শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই ক্ষতি অপূরণীয়। তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবক। তাঁর শেষযাত্রায় উপস্থিত ছিলাম। রবীন্দ্র সদনে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বহু মানুষ। গৌরী ঘোষের শেষযাত্রাতেও ছিলাম। আজ সন্ধ্যায় কলকাতার গিরিশ মঞ্চে পার্থ ঘোষের স্মরণসভা। আয়োজনে বাচিক শিল্পী সংস্থা। পার্থদার পাশাপাশি স্মরণ করা হবে প্রয়াত চন্দ্রমৌলী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাঁকে নিয়েও একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্র বানানো হয়েছে। সেটা স্মরণ সভায় দেখানো হবে। প্রদীপ ঘোষের উপর একটি তথ্যচিত্র তৈরির কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু উনি তার আগেই চলে গেলেন। হয়তো ভবিষ্যতে কাজটা হবে। একটু অন্যরকম ভাবে। ইচ্ছে আছে আরও কয়েকজন আবৃত্তিশিল্পীকে নিয়ে তথ্যচিত্র করার। ‘এমন তরণী বাওয়া’ সম্ভবত বাচিক শিল্পের উপর তৈরি প্রথম চলচ্চিত্র, যেটা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো হয়েছে।