শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী: করোনার প্রকোপ কিছুটা কমতেই গৃহবন্দি মানুষ যেন হাফ ছেড়ে একটু স্বস্তিতে। আর বাঙালির স্বস্তি মানেই রেস্তোরাঁর টেবিল চাপড়ানো বা তোলপি তোলপা নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়ে পড়া। এতগুলো মাস খাওয়া দাওয়া আর বেড়ানো এই দুটোই করতে না পেরে বঙ্গসন্তানেরা কেমন যেন নেতিয়ে পড়েছিলেন। আগের বছর ঘুরতে যাওয়ার অবকাশ তৈরিই হয়নি প্রায়। কিন্তু এই বছর আবার সবকিছু ধীরে হলেও স্বাভাবিক হচ্ছে। নিয়মের কড়াকড়ি রেখেই মানুষকে বেড়ানোর অনুমতি দিয়েছেন আমাদের রাজ্যসরকার। সামনেই দুর্গাপুজো। তাই একেবারে কালীপুজো ,ভাইফোঁটা অবধি পায়ে চাকা ভ্রমণপ্রিয় বাঙালির। সেই কারণেই আবার ট্যুরিস্ট স্পটগুলোও তাঁদের সংসার গুছিয়ে বসে পড়েছেন অতিথি আপ্যায়নে। এই পূজোয় বেড়ানোর তালিকায় একটু ভীড়ভাট্টা মুক্ত জায়গাকেই বেছে নিতে চাইছেন ভ্রমণপিপাসূরা।
আরও পড়ুন-কখনও আক্রমণাত্মক, কখনও স্মৃতিচারণায়, মমতা-আবেগ
তাহলে এ বছর উৎসবের মরশুমে আপনার ডেস্টিনেশন হোক নিরিবিলি, সবুজ, শান্ত, মনোরম প্রকৃতি ও পাহাড়ের কোলে ছোট্ট গ্রাম ‘চুইখিম’। চারদিকে পাহাড় মধ্যিখানে এই হিলিং ভিলেজ সত্যি যেন মন সারাইয়ের কারখানা। মনলোভা, পরমা প্রকৃতির নির্ভেজাল রূপ দেখা যায় এখানে। প্রকৃতি প্রতিনিয়তই রূপ বদলায় । কালিম্পং জেলার চারটে পাহাড় নিয়ে এই ছোট্ট গ্রাম। প্রায় ৩০০ মানুষের বাস। চুইখিম হল লেপচা শব্দ যার অর্থ ‘বিশ্রামের জায়গা’। সত্যি বিশ্রাম আর মানসিক শান্তির নিখাদ, নিটোল আস্তানা এই ছোট্ট জনপদটি।
এই পথটাই একসময় কালিম্পং হয়ে সিকিমে ঢুকে সিল্করুটে মিশত। যদিও সিল্করুট যাবার এই পথ এখন আর ততটা পপুলার নয়। বহুদিন আগে ব্যবসায়ীরা পাহাড় থেকে নেমে চুইখিমে ক্ষণিকের বিশ্রাম নিয়ে তিস্তার ।পাড়ে এসে পার হয়ে চলে যেতেন ব্যবসা বাণিজ্য হেতু। তাই এটা ছিল সবার রেস্টিং প্লেস। বর্তমানে সড়ক তৈরির কাজ চলছে এখানে। কাজ সম্পূর্ণ হলে নাথুলা অবধি পৌছে যাওয়া যাবে এই রাস্তা ধরেই।আমার বহুদিনের পরিচিত পূর্বতন সহকর্মী প্রসূন চক্রবর্তী চুইখিমেই থাকেন বছরের বেশিরভাগ সময়। নিজের জন্য ছোট্ট একটি বাড়িও বানিয়েছেন সেখানে। চুইখিমের অনাবিল সৌন্দর্য ভান্ডারের হদিশ পেলাম তাঁর কাছেই । জানতে পারলাম এখন বহু মানুষই এই জায়গাটির আকর্ষণে ছুটে আসছেন। শুধু পর্যটক নয়, অনেকেই জমি কিনে রাখছেন এখানে ভবিষ্যতের জন্য। তাই রাতারাতি এখানে বেড়ে গিয়েছে জমির দামও।
আরও পড়ুন-করোনায় মৃতের পরিবারকে ৫০ হাজার ক্ষতিপূরণ দিক রাজ্যই, কেন্দ্রের নয়া প্রস্তাব
এবার গন্তব্য
সেবক থেকে করোনেশন ব্রিজ পেরিয়ে সোজা জাতীয় সড়ক পথ ধরে এগনো। একদিকে তিস্তা অন্যদিকে পাহাড়। দুধারে সবুজ চা বাগান। বাগরাকোট থেকে বেশ কিছু জনপদ ,আর্মি হেডকোয়ার্টার , জঙ্গলের ধার দিয়ে ছাড়িয়ে অপরূপ প্রাকৃতিক শোভার মধ্যে দিয়ে পৌছে যান ‘চুইখিম ‘। প্রায় সাড়ে তিন হাজার ফিট উচুতে স্হিত চুইখিম পাহাড়ে ঘেরা বলে এর আবহাওয়া সারা বছরই না ঠান্ডা না গরম। শীতকালেও খুব শীত পড়েনা। তাই সব ঋতুতেই চুইখিম আদর্শ বেড়ানোর জন্য। বাঙলাদারা ,বুদ্ধদারা ও স্কুলরোড এই তিনটে জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে এই গ্রাম। এখানকার মানুষদের মূল জীবিকা চাষবাস। বর্তমানে পর্যটনের সঙ্গেও যুক্ত হয়েছেন গ্রামবাসী। দশ থেকে বারোটা হোমস্টে গড়ে উঠেছে। । জৈব পদ্ধতিতেই আর সব পাহাড়ি এলাকার মত ঢাল বেয়ে চাষবাস হয় এখানে । মূলত ধান চাষই হয়। প্রচুর আদা ,তেজপাতা, রাই বা সরষে শাক ,স্কোয়াশের চাষ হয়। সম্প্রতি স্ট্রবেরি চাষ শুরু হয়েছে এখানে।
চুইখিমে বাঁশ ,কাঠ ,বেতের হস্তশিল্পকলার অপূর্ব সব নিদর্শনের পাবেন। এখানকার মানুষের আন্তরিকতা ও আপ্যায়ন , তাঁদের সরল জীবনযাপনের স্পর্শ আপনার মনে জমে থাকা অনেক ক্ষত সারিয়ে তুলবেই। একটি ছোট স্কুল আছে এখানে যেটি একটি এনজিও এবং গ্রামের লোকেরা মিলে চালায়।
চুইখিমে হল্ট করে লাভা লোলেগাও, ঋষভ,কালিম্পং , চারখোল,পাবং , গাজলডোবা,মানাবাড়ি দিনের দিন গিয়ে ঘুরে আসতে পারেন। আর কটাদিন শুধু বিশ্রাম করার ফাঁকে দেখে নিন পাহাড়ের উপর বুদ্ধদারার বুদ্ধ মূর্তি । একটি অপূর্ব মনাস্ট্রিও তৈরি হচ্ছে ওখানে । মেঘ নেমে আসা চুইখিমের আকাশে রামধনু রঙের মেলা যেন তুলিতে আঁকা চিত্রপট। এখান থেকে ৮ কিলোমিটার উপরে ভিউ পয়েন্ট থেকে দেখা মিলবে কাঞ্চনজঙ্ঘার। অ্যাডভেঞ্চার ট্যুরিজমের শখ যাঁদের তাঁরা ইয়ালবং এ নদীর ধারে ট্রেকিং পয়েন্টে গিয়ে ট্রেক করতে পারেন।বর্ষাকাল বাদে সারাবছর চুইখিম বেড়ানোর জন্য আদর্শ।
হোম-স্টেতে নিজেরাই পর্যটকদের রেঁধে বেড়ে খাওয়ান গ্রামবাসী। গরমভাত আর দেশি মুরগির ঝোল স্কোয়াশের সবজি জমিয়ে দেবে ছুটির আনন্দ। এর সঙ্গে পাহাড়ের সবরকম খাবারেই আপনার রসনার পরিতৃপ্তি ঘটবে। হোম- স্টেগুলো বুকিং করে যেতে পারেন আবার গিয়ে বুকিংও করতে পারেন।
আরও পড়ুন-বায়ুসেনা প্রধান
কীভাবে যাবেন
হাওড়া বা শিয়ালদহ থেকে এনজেপি গামী যে কোনও ট্রেনে এনজেপিতে নেমে। সেখান থেকে গাড়ি বা লোকাল বাসে বাগড়াকোট মোড়ে নেমে ওখান গাড়ি করে বা এনজেপি থেকে সরাসরি গাড়ি ভাড়া করে চুইখিম যেতে পারেন। মোটামুটি ৫৫ কিলোমিটার।
কাঞ্চনকন্যায় এসে মালবাজার স্টেশনে নেমে গাড়িতে ২৫ কিলোমিটার চুইখিম।
প্লেনে করে যেতে হলে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে নেমে থেকে গাড়ি ভাড়া করে চুইখিম পৌছনো যায় ।