মাত্র দু’দিন হল ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কলকাতায় এসেছে তাতাই। কলকাতায় বাংলা নববর্ষ উদযাপন দেখবে বলে। এর আগে বাঙালির যৌথ পরিবারের গল্পও শুনেছে। রায়বাড়িতে এখন সন্ধ্যা নামলেই তাতাই ভাই-বোনদের নিয়ে গল্প শুরু করে। এদেশের গল্প। বিদেশের গল্প। আর মাঝে-মাঝে ভাই-বোনদের সঙ্গে ডামশারাজ খেলে। সেদিন অবশ্য খেলার নিয়মটা বদলে দেয় তাতাই। প্রায় সমবয়সি বোন বুবুকে বলে, আজ আমরা বাংলা ও বাঙালিয়ানা নিয়ে খেলব। একজন এমন একটা শব্দ বলবে যা দিয়ে শুধু বাঙালিকেই বোঝানো যায়। আর অন্য দলের ভাই-বোনেরা সেই শব্দের ব্যাখ্যা দেবে। খেলাটার কেতাবি নাম দেওয়া হয়েছে ‘ষোলো আনা বাঙালি’। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খেলা জমে উঠল। বুবুও প্রথমেই বাঙালি ও বাঙালিয়ানাকে বোঝাতে শব্দ দিল ধুতি। এবার তাতাইদের পালা বোঝাতে হবে বাঙালির সঙ্গে ধুতির কী যোগ?
ধুতি বাঙালির পোশাক আইকন
তাতাই বাঙালির ধুতিকে জুড়ে দিল সাবেকিয়ানার সঙ্গে। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে এই সাবেকিয়ানাই ছিল বাঙালির সম্পদ। বাংলা সিনেমার পরতে পরতে জুড়ে রয়েছে সেই সাবেকিয়ানার এবং বাঙালিয়ানার দৃশ্য। এমনকী সত্তর এবং আশির দশকেও বাঙালি পুরুষ আইকন ছিল ধুতি-শার্ট-পরা উত্তমকুমার। মঞ্চে ধুতি-শার্ট-পরা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। মুক্তমঞ্চে পাজামা-পাঞ্জাবি-পরা সলিল চৌধুরী।
চাকরি করতে ভাল না বাসেন কোন বাঙালি। বিভিন্ন রাজার দরবারে, সওদাগরি আপিসে, জুটমিলে বড়বাবু, গোমস্তা, নায়েব, ম্যানেজার— সব পদে চাকরি করে এসেছে বাঙালি। সেই মুগল আমল থেকেই। বাঙালির এই কলম পেশার কাজে সঙ্গী হয়ে উঠেছে গায়ে-কোমরে জড়িয়ে থাকা ধুতি। পদমর্যাদা অনুযায়ী ধুতির ধরনও বদলে গেছে। তবে ৯০-এর দশক অব্দিও বাঙালি পুরুষের ফরমাল পোশাকের তালিকা থেকেও বাদ পরেনি ধুতি। সেসময় সাহেবি অফিসে বাঙালিবাবুদের যাওয়ার পোশাক ছিল বাকি পাঁচটা বাঙালিদের মতোই— ধুতির উপর ফুলশার্ট, পায় চকচকে প্যাম্প-শ্যু, মোজা, পকেটে চেন-লাগানো পেতলের ঘড়ি। তবে সেই ধুতি-পরার স্টাইল ছিল একেবারেই আলাদা, বাঙালিয়ানায় ঠাসা। কুঁচি দিয়ে ধুতি-পরার রীতি ছিল আর সেই কুঁচি পকেটে না রেখে সামনে ঝোলানো থাকত। শীতকালে শার্টের উপরে পরা হত গরম কোর্ট। ১৯৭১ সালে ইন্টারভিউ ছবিতে দেখানো হয় ছবির নায়ক ধুতি-পরে ইন্টারভিউ দিতে আসার কারণে সে বিলিতি কোম্পানির চাকরি থেকে বঞ্চিত হন। ৮০-র দশকেও ডালহৌসি চত্বরে কিছু ধুতি-পরা বাঙালি ক্লার্ক দেখতে পাওয়া যেত। আর ৯০-এর দশকে স্কুলশিক্ষকদের একটা বড় অংশ স্কুলে আসতেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরে। আস্তে আস্তে প্রতিদিনের পোশাক হয়ে উঠল বিয়ের এবং পুজোর পোশাক। এই ট্রেন্ড ছড়িয়ে পড়ল শহর থেকে গ্রামে। সেই কারণেই অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধুতি পরে নোবেল নিতে দেখে সমালোচনার ঝড় ওঠে।
বাঙালি সেলুলয়েডে এ-দৃশ্যও দেখেছে ধুতি, বাংলা-শার্ট-পরা নায়ক দাঁড়িয়ে রয়েছে, নায়িকার ড্রেসিং ডাউন-পরা বাবার সামনে। কমল মিত্র-মার্কা সেই দুঁদে শ্বশুর দাঁতে দাঁত চিপে অপমান করছেন নায়ককে। এঁরা দু’পক্ষই কিন্তু বাঙালি। একই জিনিস দেখা যায় শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ও পরশুরামের একাধিক ছোট গল্পে। এদিকে স্বয়ং ব্যোমকেশ বক্সিও ধুতি-শার্ট-পরা সভ্যতার প্রতীক। কেউ এদের বাঙালিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে না।
পরনে ঢাকাই শাড়ি
এবারে খেলায় নিয়ম বদল রিভার্স। তাতাই বাঙালিয়ানার নতুন শব্দ দিল শাড়ি। এবারে বলতে হবে বুবুকে। বুবু বলতে শুরু করল— বাঙালি রমণী মানেই শাড়ি সুন্দরী। সুচিত্রাই হন অথবা সুপ্রিয়া বা দূরবিন চোখে মাধবী— কেউই শাড়িকে উপেক্ষা করতে পারেনি। বাঙালি মেয়েদের প্রিয় পোশাক শাড়ির ইতিহাস আজকের নয়। খ্রিস্টপূর্ব প্রায় তিনহাজার বছর বা তারও আগে থেকে রয়েছে শাড়ির উল্লেখ। তবে এখন শাড়ি পরার ধরনে বৈচিত্র রয়েছে। ইতিহাস অবশ্য সেই কথাই বলে। একসময় মেয়েরা ব্লাউস, পেটিকোট ছাড়া শুধু একটুকরো দীর্ঘ কাপড় তাঁদের শরীরে জড়িয়ে রাখতেন। তখন সেটাই ছিল শাড়ি। তবে শাড়ি তখন ছিল নিম্নবিত্ত পরিবারের পোশাক। সেই শাড়িই আস্তে আস্তে হয়ে উঠল বাঙালি নারীর আভিজাত্যের পোশাক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অঞ্চল বেঁধে শাড়ির ধরন বদলেছে, পরার ধরনও বদলেছে।
উনিশ শতকে ভিক্টোরিয়ান যুগে বাঙালি ফ্যাশনের মূল কথাই ছিল সমস্ত শরীর ঢেকে রাখা। এমনকী গোড়ালি দেখাও অসম্মানজনক, তাই শাড়ির সঙ্গে ফুলহাতা ব্লাউস এবং পেটিকোট পরার চল শুরু হয়। এই শাড়ি পরার ধরন বাঙালি নারীর চিরকালীন এক প্যাঁচে শাড়ি পরার ধারণাকে বদলে দেয়।
মুঘলদের আগ্রহের জন্য মসলিনের শাড়ি থাকত জেনানা মহলে। সে-সময় মসলিন কাপড় সংগ্রহের জন্য সরকারি লোক নিয়োগ করা হত। মুঘল আমলেই শাড়ির সঙ্গে ব্লাউস পরার রীতি শুরু হয় তবে তা ছিল উচ্চপদস্থদের জন্য। সর্বসাধারণের জন্য ব্লাউস পরার চল শুরু হয়েছিল ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল থেকেই। মুঘলদের বাংলা জয়ের পর জমিদার গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেই সময় শাড়ির প্রচলনও শুরু হয়। গ্রাম-বাংলার সাধারণ মেয়েরা সেই ধারা থেকে ছিল বহু দূরে। ব্রিটিশ-মুক্ত ভারতে চল্লিশের দশকে সেই দিক থেকে বাঙালি ফ্যাশনের আইকনরা শাড়ি ব্যাবহার করতেন। ছোট আর্তিন এবং লম্বা গলার ব্লাউসে বাঙালি নারী সুচিত্রা সেন। কিন্তু আজকের দিনে লাল পাড়, সাদা শাড়ি বাঙালিয়ানার অন্যতম সূচক হয়ে উঠেছে। এখন বাঙালিয়ানার ট্রেডমার্ক হয়ে উঠেছে ‘পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর’।
থাকে দুধে ভাতে
রাত যত বাড়ছে বুবু আর তাতাইদের খেলা ততই জমে উঠছে। রাতের মধ্যেই দু’জনকে প্রমাণ করতে হবে বাঙালিয়ানার শ্রেষ্ঠ লক্ষণ কী! তাই এবারে বুবু নতুন শব্দ দিল ‘ভেতো বাঙালি’। শব্দটা শুনেই তাতাই রে-রে করে উঠল। বলল সারা পৃথিবীতে অনেকেই তো ভাতের প্রেমে হাবুডুবু খায়। অন্যদিকে, বুবু বোঝাল বাঙালির ভাত- প্রেমে ভাত-ঘুম আছে। আছে পান্তা ভাতে অতিরিক্ত বাঙালি প্রেম। ভাতের সঙ্গে আমাদের খাদ্যাভাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে খাবারের মধ্যে ভাত থাকে সেটাই আমাদের প্রিয়, সেটাই আমাদের অভ্যাস। বাঙালির মতো ভাত-পাগল জাতি পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি নেই। বাঙালিই তো বলতে পারে— ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’ দু’বেলা পেটভরে ভাত খেতে পারাটাই বাংলার রীতি। সম্প্রতি অবশ্য আর্থিক সচ্ছল বাঙালিদের ভাতপ্রেম দিন দিন কমছে। তবে যতই স্বাস্থ্য সচেতন হোক না কেন, আগামীর বাঙালি আজকের বাঙালির মতোই ভেতোই থেকে যাবে। রুচি বদলে দেবে জল দেওয়া পান্তা ভাত, এক টুকরো পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা। ভাতই হল বাঙালির ফার্স্টহ্যান্ড লাভ— এক কথায় বাঙালির প্রথম প্রেম। সেই ভাতকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে নানা উপাদেয় রেসিপি। তাতে রয়েছে ঘি-ভাত, ভাতে-ভাত (আলু সেদ্ধ), ভাত-ভাজা (ফ্রাইড রাইস), দুধ-ভাত (পায়েস)। ১৮৮৮ সালের ১০ অক্টোবর পিবি ক্লার্ক (বোন্টানিচ) ইংল্যান্ডে তার বন্ধুকে একটি চিঠিতে বাঙালির ভাত-প্রেম নিয়ে লিখেছেন। বুঝিয়েছেন গরম ভাত, ঠান্ডা ভাত, ভাতের ফ্যান— সবই বাঙালির জীবনের এক রোজনামচা।
মৎস্য মারিব খাইব সুখে
তাতাই ভেতো বাঙালির কথা বলতে বলতেই বুবু বলে উঠল বাঙালির অন্যতম প্রিয় অলঙ্কার ‘মেছো বাঙালি’। বাঙালি নাকি মাছ ছাড়া মুখে ভাত তুলতে পারে না। মাছ না-হলে ভাত বাঙালির চলে না। তাই বাঙালি গানে বলে— ‘তালৈ যাইলা বাজারে তার গাঁটিক নাইরে কড়ি/ মাইয়োর পরাণে মাগে বোয়াল মাছের মুড়ি।’ মাছ প্রেমে বাঙালিকে শুধু মাত্র হারাতে পারে গ্রিক দেশের বাসিন্দা। বাঙালির মৎস্য প্রেমের কথা সবাই জানলেও সমীক্ষা অবশ্য অন্য কথা বলে। সবচেয়ে বেশি মাছ খেয়ে রেকর্ড করেছে লাক্ষাদ্বীপ। সেখানকার বাসিন্দারা মাথাপিছু বছরে ১০৫ কেজি মাছ খান। দ্বিতীয় স্থানে অবশ্য অন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ। তাদের বার্ষিক মাছ খাবার পরিমাণ ৬৯ কেজি। প্রতিবেশী রাজ্য ত্রিপুরা গড়ে মাথা-পিছু ২৫.৪৫ কেজি মাছ খান। অবশ্য ত্রিপুরার একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বাঙালি। বাঙালির মাছ প্রেমের সঙ্গে রয়েছে নদী, হ্রদ কিংবা পুকুরের ইতিহাস। সমুদ্রের নোনা জলও বাঙালিকে নানা বৈচিত্রের মাছের জোগান দেয়। এমনকী যেসব বাঙালি বাংলার বাইরে থাকেন তাঁরাও মাছের লোভে অসাধ্য সাধন করেন, কারণ, বাঙালির মাছের প্রেম বড় নিবিড়। বাঙালির মাছভক্তিকে অনেকেই পছন্দ করতেন না। সর্বানন্দ তার টিকা সর্বস্বে দুর্নাম করেছেন। তিনি বাঙালিকে ‘শুঁটকি খেকোর বাচ্ছা’ বলেছেন। বাংলায় যে মুঘল কর্তারা থাকতেন তাঁদের কাছেও বাঙালির এই মাছ প্রেম ছিল না-পাসন্দ। কিন্তু এইসব বাঙালিকে দমাতে পারেনি। আজও বাঙালি আছেন বাঙালিয়ানাতেই— মাছে ভাতে।
রসের নাগর রসগোল্লা
এবারে তাতাই অনেক বেশি আবেগপ্রবণ। পেটুক বাঙালির কথা বললে তাতাইয়ের গায়ে লাগবেই। তাতাই তাই দার্শনিকের ঢঙে বলে উঠল— রসের গোলক, এত রস তুমি কেন ধরেছিলে হায়! ইতালির দেশ ধর্ম ভুলিয়া লুটাইল অবপায়। এসব শুনে বুবু বলল, ‘‘আরে কী হল তোর? এতেই তোর বাঙালিয়ানা শেষ?’’ তাতাই তখন আরও গম্ভীর হয়ে বলল— ‘‘আরে এ আমার কথা নয়, একথা বলছেন সৈয়দ মুজতবা আলি।’’ রসগোল্লা নিয়ে এত বড় কীর্তি একমাত্র বাঙালিই করতে পেরেছে। কলকাতার অনামী ময়রা নবীনচন্দ্র দাস পৃথিবীর মিষ্টির ইতিহাস বদলে দিয়েছিল। রসগোল্লা আবিষ্কার করে। পরে অবশ্য বাঙালির এই কৃতিত্বে ভাগ বসাতে চেয়েছেন ওড়িয়ারা। কিন্তু ২০১৭-র ১৪ নভেম্বর বাঙালির রসগোল্লা জিতেছে জিআই ট্যাগ। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যগুলোতে প্রচুর পরিমাণে খাবারদাবারের উল্লেখ থাকলেও রসগোল্লার উল্লেখ নেই। ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ কিংবা ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এর মতো বইয়ে যখন সন্দেশের কথা উল্লেখ থাকলেও রসগোল্লার কথা উল্লেখ থাকে না, তখন বুঝতে হয়, রসগোল্লা আসলে বাংলা অঞ্চলে নতুন খাবার। অথচ বৈদিক যুগ থেকে দুধ, দুধ থেকে তৈরি ক্ষীর, দই, ঘি, মাখন শুধু বাংলা অঞ্চলে নয়; বরং পুরো ভারত উপমহাদেশে শ্রেষ্ঠ খাবার হিসেবে পরিগণিত ছিল। এ জন্য হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন দেবতার ভোগেও এই খাবারগুলো নিবেদন করা হত। বাঙালিয়ানায় তাই নিজের জায়গা পাকা করে রয়েছে রসগোল্লা। পেটপাতলা বাঙালির উপাদেয় পথ্য গরম রসগোল্লা। যেকোনও খাবারের শেষে মিষ্টিমুখে রসগোল্লা তার জায়গা অটুট রেখেছে বাঙালিয়ানাকে ব্র্যান্ড হিসেবে।
বাঙালির মুড়ি প্রেম
এই মাঝরাতে তাতাই যখন রসগোল্লার সাতকাহন তুলে ধরল, বুবু তখন বাঙালির মুড়ি প্রেমের কথা জানান দিল সদর্পে। বলল মুড়ি ছাড়া বাঙালির চলেই না। কোথাও সকাল-সকাল মুড়ি-ঘুগনি-চপ দিয়ে বাঙালি তার দিন শুরু করে। কোথাও আবার জল মুড়ি। তবে ট্রেনযাত্রার ঝালমুড়ি বাঙালির ট্রেনের আড্ডায় নতুন মশলা যোগ করে। ভিন রাজ্যে ভিন দেশে বাঙালি চোখে হারায় মুড়িকে। আজও অনেক বাঙালি পরিবারে অফিস-ফেরতা টিফিন মুড়ি, চানাচুর, পেঁয়াজ, লঙ্কা। গ্রামবাংলায় যখন মোমো চাউমিন আসেনি। বাঙালির সন্ধ্যার খাবারে রাশ ছিল মুড়ির হাতেই। তাই মুড়ি ছাড়া বাঙালির কথা ভাবাই যায় না। জলখাবার থেকে সন্ধ্যার খাবার— অবাধ বিচরণ এই মুড়ির। মুড়ি-বিলাসী বাঙালি তাই এখন বাঙালির ট্রেড মার্ক।
বাঙালিয়ানার সাতকাহন
সন্ধ্যা থেকে খেলা শুরু হয়েছে বাঙালিয়ানা প্রমাণের ট্রেড মার্ক কী? এখন মাঝরাত। এক রাতে এই খেলা শেষ হবে না। তাই এবারে খেলার ধরন বদল হল। রাত পোহালেই বাংলা নববর্ষ। তাই ষোলো আনা বাঙালির সব দিক তুলে ধরতে হবে খেলা শেষ হওয়ার আগেই। এবারে এককথায় বাঙালিয়ানা। বুবু আর তাতাইয়ের মুখোমুখি লড়াই। বুবু বলছে বাঙালিয়ানা মানে ইলিশ মাছ। বাঙালিয়ানা মানে পদিপিসির হাতে তৈরি কাঁচের বয়মে আচার। তাতাই কথা শেষ না হতেই বলে উঠল— বাঙালিয়ানা মানে দুর্গা পুজোর অষ্টমীর সকাল। বাঙালিয়ানা মানে বিসর্জনের নাচ আর সিঁদুরখেলা। এবারে বুবু। তার বিশ্বাস বাঙালিয়ানা মানে বাংলা নববর্ষের হালখাতা, ক্যালেন্ডার আর নতুন পঞ্জিকা। বাঙালিয়ানা মানে কলাপাতা আর মাটির ভাঁড়ে খাবার। তাতাইয়ের বাঙালিয়ানা মানে প্ল্যানিং ছাড়া বেরিয়ে পড়া। কখনও পাহাড়, কখনও সমুদ্র, কখনও জঙ্গল, তবে তাতাই বলে বাঙালির প্রেম আসলে ‘কম পয়সায় পুষ্টিকর’-এ। হাটে, বাজারে, ফুটপাথে বাঙালি অপ্রতিরোধ্য কেনাকাটার দরদামে। সাবলীল ভঙ্গিতে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ৫০০ টাকার জিনিসের প্রথম দাম বলে ৫০ টাকা। দরদামকে শিল্পের স্তরে নিয়ে গেছে বাঙালি। বুবু অবশ্য বাঙালি বলতে বোঝে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, পঁচিশে বৈশাখ। বাঙালি বলতে বোঝে জন্মকবি। দু’কলি প্রেমের কবিতা।
সব খেলার সেরা ফুটবল
আড্ডা ছাড়া বাঙালি হয় না। মাঝরাতে আড্ডা কিছুতেই শেষ হতে চাইছে না। তাতাই আর বুবুর মাঝখানে হঠাৎ করে নাক গলিয়ে দিল বাবি। বলল— কিছু মনে করিস না, সব কাজে নাক গলানো বাঙালির অভ্যেস। অনাধিকার চর্চাকে বাঙালি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এবার আসল কথাটা বলি। তোরা যে এত বাঙালিয়ানা নিয়ে মাঝরাতে পড়েছিস, একবারও তো বাঙালির প্রিয় ফুটবলের কথা বললি না। পৃথিবীতে বাঙালি এমন একটা জাতি যে ফুটবলের প্রেমে শহিদ হয়েছে। ফুটবল-আবেগ আমাদের রক্তে মিশে আছে। ফুটবল আর রাজনীতি ছাড়া বাঙালিকে চিনবে কে? মোহনবাগান থেকে ইস্টবেঙ্গল অথবা ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড থেকে বার্সেলোনা অথবা রিয়াল মাদ্রিদ এবং লিভারপুল প্রতিটি জায়গায় বাঙালি থাকবেই। পাড়ার চায়ের দোকানে, অফিসে বসের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত রুমে, রাতে ডিনার টেবিলে, স্কুল-কলেজের ক্লাসরুম, স্টাফরুমে আলোচনার কেন্দ্রে ম্যাচের বিশ্লেষণ, তর্ক আর বাঙালির ফুটবল। বাঙালিই পারে বিশ্বকাপের আগে নিজের প্রিয় দলের রঙে বাড়ি রাঙিয়ে নিতে, গাড়ি রাঙিয়ে নিতে। বাঙালির বুকের একদিকে মেসি, মারাদোনা, রোনাল্ডো থাকলেও বুকের বাঁদিকটাতে চুনি গোস্বামী, সুব্রত ভট্টাচার্য, সুভাষ ভৌমিক, মানস ভট্টাচার্য, সুরজিৎ সেনগুপ্ত পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে। বাঙালি জাতির অস্তিত্ব যতদিন থাকবে, থাকবে বাঙালির সব খেলার সেরা ফুটবলও। আর ফুটবল বাঁচলেই বাঁচবে আকাশবাণীর ধারাভাষ্য।
কল্পনাবিলাসী বাঙালিয়ানা
বাঙালিয়ানার এই খেলা শেষ না হতেই মনে পড়ল অ্যান্ডারসন সাহেবের কথা। তাঁর কাছে জাতিসত্তার ব্যাপারটাই ছিল ঘোটালা। পুরোটাই ইমাজিনেশন। আর বাঙালির কল্পনাবিলাসের কেন্দ্রে রয়েছে বাঙালিয়ানা। এটাই বাঙালির ফ্যান্টাসি। এই ফ্যান্টাসির মাপকাঠিতেই বাঙালি মাপে তার বাঙালিয়ানাকে। মাপে টাকা-পয়সা আনা দিয়ে। ষোলো আনা না হলে আবার বাঙালি কীসে? বাঙালিকে গাল শুনতে হয়েছে ব্যবসা-বিমুখ অলস বলে। ষোলো আনা বাংলার তত্ত্বে আমরা ভুলতে পারি না ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসকে গিরিশ ঘোষের দেওয়া ষোলো আনার কথা। বাঙালির ষোলো আনা কথা রয়েছে বৈষ্ণব রসতত্ত্বেও। রাধিকা সুন্দরীকে নদী পার করতে কানাই মাঝি ষোলো আনাই নিয়েছিল। ফলে বাঙালির জীবনে এই ষোলো আনার হিসেব বেশ গোলমেলে। নববর্ষের সকালে তাই সব পাঠক বাঙালি আরও একবার বুবু, তাতাই, বাবির মতো হিসেব কষতে বসবে ষোলো আনা বাঙালির। হিসাব মিলুক না মিলুক ভগ্নাংশ থাকবে বাঙালিয়ানায়।
ষোলো আনা বাঙালি
বাঙালি ইতিহাস-বিস্মৃত জাতি। বাঙালি ব্যবসা-বিমুখ। বাঙালির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। কিন্তু তার পরেও আজও সারা পৃথিবীতে বাঙালি আছে বাঙালিয়ানাতেই। নববর্ষের সকালে বাঙালির সেই বিশেষত্ব তুলে আনলেন বিশ্বজিৎ দাস