কবি তো কবিই। পুরুষকবি এবং নারীকবির তফাত এই যুগে অর্থহীন। কেউ কেউ লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। পেয়ে যান নারীবাদী তকমা। আবার কেউ কেউ অক্ষরের পাশে অক্ষর সাজিয়ে নিভৃতে বোনেন নিজের কথা। আঁকেন নারী-জীবনের ছবি। বিজন থেকে আলোয় আনেন ছোট ছোট সুখ, দুঃখ, হাসি-কান্না। মেলে ধরেন আলতোভাবে। নিচু স্বরে। কখনও সোচ্চারে। এঁরাও নারীবাদী। এমনই চার কবির চারটি কবিতার বইয়ের উপর আলোকপাত করা যাক।
আরও পড়ুন-রবিবার সকালে সন্তোষপুর স্টেশনে ভয়াবহ আগুন
মাইক্রো ক্রিয়েটিভ পাবলিকেশনস থেকে প্রকাশিত হয়েছে সুব্রতা ঘোষ রায়ের কবিতার বই ‘তুমি কখন আসবে সুদর্শন’। পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে দুই লাইন, চার লাইনের কবিতা। প্রতিটি কবিতাই ছন্দোবদ্ধ। শিরোনামহীন। প্রথম কবিতায় লিখেছেন, ‘নরম মাটি আঘাত করা সোজা,/ খাক হয়ে যায় উচাটনের মন…/ ঝাপসা চোখে তবুও চেয়ে থাকি…/ তুমি কখন আসবে সুদর্শন?’ একজন ক্ষতবিক্ষত নারী প্রার্থনা করছেন কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে। গোপনে নয়, সোচ্চারে। নিজের ইচ্ছাকে আড়ালে না রাখাও এক ধরনের নারীবাদ। যদিও কাঙ্ক্ষিত পুরুষের সঙ্গে নিত্যমিলনে অনীহা তাঁর। লিখেছেন, ‘যোজন দূরেও দগদগে ঘা! চাই না দেখা রোজ…/ অনেক হল, তাই কখনো… নিও না আর খোঁজ…’। ঝরে পড়ে অভিমানী সুর। সেইসঙ্গে প্রকট হয় নারী-মনের দোলাচল। নানা বিষয়ের কবিতাগুলোয় দেখা যায় ভাবনার বিস্তার। এই ভাবনা কিন্তু বাস্তবতা-বহির্ভূত নয়। নিজের জীবন থেকে অর্জিত, যাপন থেকে প্রাপ্ত। প্রচ্ছদ রূপায়ণে শ্যামল মজুমদার। দাম ১৫০ টাকা।
সায়ন্তন পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে সুস্মেলী দত্ত-র কবিতার বই ‘ইয়ে সিরিজের পদ্যগুলো’। এই কবির ছন্দের হাত অসাধারণ। পছন্দ করেন শব্দ নিয়ে খেলতে। তুমুল প্রেমে বিশ্বাসী তিনি। ‘জলজ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘সমস্ত দিন তোমার জন্য, সমস্ত রাত তুমি/ ইত্যাদি মন চাঁদ চকোরের অলক্ষ্যে দুষ্টুমি।’ এই প্রেম আস্তিক, আমিষ, বাঁধনহারা। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ঊর্ধ্বে। বেপরোয়া নয়, তবে সাহসী। ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূর অজানায়। এখানে লুকিয়ে রয়েছে সূক্ষ্ম নারীবাদ। সহজ-সরল কবিতা, তবে তরল নয়। কুয়াশা ছড়িয়ে রয়েছে কিছু অংশে। ফুটে উঠেছে সময়ের ছবি। বুনে দেওয়া হয়েছে জটিল সমস্যার কথা। ‘খুঁত’ কবিতায় কবি লিখেছেন, ‘নিটোল আগুনে জ্বলছে পৃথিবী আজ/ কেন রাত জুড়ে প্রশ্নের মাখামাখি/ অযথা শরীর দেবদারু হয়ে ওঠে/ ঈশ্বরী মেঘ সাজছে হাভাত নাকি!’ শেষ পঙক্তিতে এসে থমকে যেতে হয়। হয়তো এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে কোনো অশনিসংকেত। ‘দুর্গাকথা’, ‘বৈধ অথবা অবৈধ’, ‘স্বজন’, ‘গেছো’ প্রভৃতি কবিতাগুলো ভাবায়। প্রচ্ছদ দীপশেখর চক্রবর্তী। দাম ১৯০ টাকা।
জনস্বার্থ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত হয়েছে শিবাণী মুখার্জী পাণ্ডে-র প্রথম কবিতার বই ‘চোরকাঁটা’ পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, এই কবির কবিতা নিবিড় অনুভবে জারিত। সংবেদনশীল মনে খোঁজ রাখেন সারা পৃথিবীর। তুলে ধরেছেন ভাঙা সময়ের কথা। কবিতায় ধরা পড়েছে বিচিত্র বিষয। মনুসংহিতার বিধানের প্রসঙ্গ যেমন এসেছে, তেমন এসেছে ফুল্লরার বারোমাস্যার কথা। সদ্য প্রেমের পাশাপাশি চুপিসারে ঢুকে পড়েছে ঝাপসা বন্ধুত্ব। আছে বিরহও। ‘প্রেম’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘মীরাবাই-এর প্রেমিক কৃষ্ণ/ জ্বলতে পারে রাজপ্রাসাদে/ কলির মোহন ঘরে ঘরে/ জ্বালিয়ে চলে ইরা মীরাদের।’ প্রেমিক এখানে ধূর্ত। নারীকে হতে হয় কামনা এবং শেষমেশ বঞ্চনার শিকার। ‘কন্যাভ্রূণ’ কবিতার দুটি মর্মান্তিক পঙক্তি– ‘হেরে যাওয়া পিতা জিতে গেছে/ কন্যাভ্রুণ হত্যার আনন্দে।’ ফুটে উঠেছে লিঙ্গ বৈষম্যের ছবি। সার্থক নারীবাদী কবিতা। ‘প্রতিধ্বনি’, ‘দিবা স্বপ্ন’, ‘স্মৃতি’, ‘পোড়ো শালিক’, ‘রঙিন প্রজাপতি’ কবিতাগুলো মর্মস্পর্শী। দাম ১২০ টাকা।
নান্দীমুখ সংসদ থেকে প্রকাশিত হয়েছে সুপ্তশ্রী সোমের কবিতার বই ‘মেপল পাতায় সুখ দুঃখ’। এই কবি রোমান্টিক, সমাজ সচেতক। কখনও স্মৃতিমেদুর। আঁকেন নারী জীবনের ছবি। ‘রাধাজীবন’ কবিতায় লিখেছেন, ‘জীবনের আনাচ কানাচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে যে অ-নিরুদ্ধ হাওয়া তাকে বাঁধতে গেলেই সে পালিয়ে যায়। অথচ কেমন এক মনকেমনিয়া সুরে বাঁশি বাজিয়ে ডেকে চলেছে। যেন আমি রাধা হবো বলেই তার এই আয়োজন। ঘরের চৌকাঠে লেখা অনুশাসনের লিপি মুছে আমি পা বাড়ালে চৌকাঠে দেওয়ালের কঠিন উপস্থিতি।’ অদৃশ্য অনুশাসনের লিপি মুছে ফেলার কথা বলেছেন কবি। চিৎকার নয়, প্রকাশভঙ্গির মধ্যে মিশে রয়েছে আশ্চর্য সংযম। এও এক নারীবাদ। ছায়া ঢাকা মায়া মাখা। অতীত সামনে দাঁড়ায় ‘বিচ্ছেদের পরে’ কবিতায়। তিনি লেখেন, ‘অনেকদিন পর দেখা হল আমাদের/ বারান্দায় অনেকের মধ্যে তুমি ছিলে/ ফুরোনো কথারাও উড়ছিল এদিক ওদিক/ কথা শেষ হয়ে গেলে শূন্যতাকেই ভিড় মনে হয়।’ শেষ পঙক্তিটি অনবদ্য। তাকে প্রতিষ্ঠা দিতেই যেন আগের পংক্তিগুলোর অবতারণা। ‘বিষাদের ভালো নাম প্রেম’, ‘ভাঙন’, ‘নির্মাণ’, ‘আপোষ’ কবিতাগুলো গভীর, অর্থবহ। প্রচ্ছদশিল্পী যোগেন চৌধুরী। দাম ৮০ টাকা।