পিনকোড-এর ৫০-এ পা

Must read

(৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক দিবস এবং একইসঙ্গে জাতীয় ডাক দিবস। ১০ অক্টোবর জাতীয় ডাককর্মী দিবস। ১২ অক্টোবর ডাক জীবনবিমা দিবস। সেইসঙ্গে পিনকোড পা দিচ্ছে ৫০ বছরে। সেই উপলক্ষে….)
রাতুল দত্ত

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আজকের দিনে কলম ধরলে নিশ্চয়ই ‘ডাকহরকরা’-র মতো ছোটোগল্প লিখতে সাহস করতেন না। কিংবা কবি সুকান্ত! ‘রানার’ লেখার স্বপ্ন দেখতে ও দেখাতে পারতেন না। কিংবা ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে ১৯১৩ সালের মতো ডালহৌসির অফিস পাড়ায় ‘ক্যালকাটা টেলিগ্রাফ অফিস’ তৈরির পরিকল্পনা নিশ্চয়ই করতেন না কোনও সরকার। কৃষ্ণেন্দু মুখার্জির মতো তরুণ প্রেমিকের দিকে তাকিয়ে আজকাল হয়ত আর রীণা ব্রাউনরা বলবে না, ‘চিঠি লিখে’। ‘শ্রীচরণেষু’, ‘শ্রীচরণকমলেষু’, ‘পূজনীয়’, ‘শ্রদ্ধেয়’, ‘ইতি’-র শব্দগুলি কী দ্রুতই হারিয়ে যাবে চিঠির ইতিহাস থেকে! চিঠি কী চলে যাবে, ই-মেল আর হোয়াটস অ্যাপের যুগে, ইতিহাসের পাতায়!

আরও পড়ুন-হৃদরোগে আক্রান্ত সুব্রত মুখোপাধ্যায়, এসএসকেএমে চিকিৎসাধীন

মানুষ বিশ্বাস করে, ডাক পরিষেবা থাকবে। আজীবন থাকবে। ভীষণভাবে থাকবে। আর তাই ১৯৭২ সালে ভারতে প্রথম চালু হওয়া পিন (PIN) বা পোস্টাল ইনডেক্স নম্বর ধীরে ধীরে পা দিয়ে দিয়েছে ৫০ বছরে। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি বা অভ্যাসের গঠন পাল্টে গেলেও চিঠি পৌঁছে দিতে পিনকোড হল একমাত্র অস্ত্র—একমাত্র চাবিকাঠি। এই পিনকোডই পৌঁছে দেয় অসুস্থ মায়ের কাছে বিদেশে থাকা একমাত্র ছেলের খবর কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা স্বামীর সুস্থ থাকার খবর, ঘরে থাকা তাঁর স্ত্রীর কাছে। পিনকোডের একটি সংখ্যার ভুলে রাজগীরের চিঠি চলে যেতে পারে রাজস্থানে, কিংবা পড়ে থাকতে পারে সংশ্লিষ্ট পোস্ট অফিসে কিংবা মানি অর্ডারের টাকা না-ও পৌঁছতে পারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে। এককথায় বলা যায়, চিঠির প্রাপকের নির্দিষ্ট এলাকা যতটা সম্ভব সূক্ষ্মভাবে নির্দেশ করে, আজকের পিনকোড। পোস্টাল ইনডেক্স নম্বর ছাড়া একটি ঠিকানাই অসম্পূর্ণ।

আরও পড়ুন-এশিয়াটিক সোসাইটিতে নিয়োগ

পোস্ট কোডের ইতিহাস
পায়রার পায়ে চিঠি বেঁধে ছেড়ে দেওয়ার দিনে তো মানুষ দীর্ঘদিন আটকে থাকতে পারে না। ফলে ১৫১৬ সালে অষ্টম হেনরি প্রথম ‘রয়্যাল মেল’ চালু করলেন। এরপর ব্রিটেনেই প্রথম ডাকটিকিট চালু হল, যার নাম হল ‘পেনি ব্ল্যাক’ এবং ১৮৫০ সালে এল ডাকবক্স। কিন্তু পোস্টাল কোড সিস্টেমের মতো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে একটি দেশকে বেঁধে ফেলতে পৃথিবীর সময় লেগে গেল আরও ৯০ বছর। ১৯৪১ সালে প্রথম জার্মানীতে পোস্ট কোড চালু হল। পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এর নাম হল জিপ কোড এবং ভারতে ১৯৭২ সালে এর নাম হল পিনকোড। ১৯৭৪ সালে আর্জেন্টিনায়, ১৯৬৭ সালে ডেনমার্ক ও অস্ট্রেলিয়ায়, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে এবং ব্রাজিলে, ১৯৬৮ সালে জাপানে, ১৯৫০ সালে সিঙ্গাপুরে ইত্যাদি দেশে তাদের দেশের প্রয়োজনের মতো করে পিনকোড চালু হয়। আবার ফ্রান্সে সেডেক্স (CEDEX) নামে একটি পদ্ধতি রয়েছে। মূল উদ্দেশ্য যে সমস্ত সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিপুল সংখ্যক চিঠি পায় বা দেয়, তাদেরকে আলাদা চিহ্নিত করে দেওয়া। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে পিন লিখতে গেলে আরবী সংখ্যা পদ্ধতির প্রতীক ০ থেকে ৯ এবং হাইফেন ব্যবহৃত হয়। পশ্চিমের দেশগুলিতে পোস্ট কোডের মধ্যে লাতিন বর্ণ থাকে। ইংরেজি ভাষা দেশগুলিতে ঠিকানা লেখার সময়ে পোস্টকোডকে শহরের নামের পরে বসানো হয়। কিন্তু অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে আবার ঠিকানা লেখার সময়ে শহরের নামের আগে বসানো হয়।
নানা দেশে, নানা নামে
ভারতে যেমন পিনকোড হিসেবে পরিচিত, তেমনি বিভিন্ন দেশে এর বিভিন্ন নাম রয়েছে। ইতালিতে ক্যাপ (CAP), চেকরিপাবলিক এবং স্লোভাকিয়ায় পিএসসি (PSC), কানাডাতে পোস্টাল কোড (Postal Code), মার্কিন মুলুকে জিপ (ZIP), পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে পোস্টাল ইনডেক্স (Postal Index) (ভারতের মতো নম্বর শব্দটি ব্যবহৃত হয় না), ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডে এনপিএ (NPA) নামে এর পরিচিতি।
পোস্টাল জোন (ডাক অঞ্চল)
ভারতকে আপাতত ৯টি পোস্টাল জোন বা ডাক অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। ১-৮ হল বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জন্য এবং ৯ হল সম্পূর্ণ ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য।
পিনের প্রথম সংখ্যা জোন বা অঞ্চল রাজ্য/ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল
১, ২ উত্তর দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ, জম্মু ও কাশ্মীর, লাদাখ, চণ্ডীগড়, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড
৩, ৪ পশ্চিম রাজস্থান, গুজরাট, দমন ও দিউ, দাদরা ও নগর হাভেলি, মহারাষ্ট্র, গোয়া, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়
৫, ৬ দক্ষিণ তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, কেরল, পুদুচেরি, লাক্ষাদ্বীপ
৭, ৮ পূর্ব পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িষা, অরুণাচল প্রদেশ, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ, অসম, সিকিম, বিহার, ঝাড়খণ্ড
৯ এপিএস আর্মি পোস্টাল সার্ভিস (APS) এবং ফিল্ড পোস্টাল সার্ভিস (FPS)

পিনের গঠন
ভারতীয় যোগাযোগ ব্যবস্থায় শ্রীরাম ভিখাজি ভেলাঙ্কর একটি উল্লেখযোগ্য নাম। মূলত তাঁর আমলেই, দপ্তরের অতিরিক্ত সচিব থাকার সময়ে, তাঁর মস্তিষ্ক প্রসূত হল এই পিন চালু করার কাজ। বিভিন্ন ভাষা, একই নামে একাধিক জায়গা, অসম্পূর্ণ ঠিকানা ইত্যাদির জটিলতা এড়াতেই সেদিন ভারতের প্রতিটি কোণাকে পিন-এর মাধ্যমে বেঁধে ফেলা হয়েছিল, যাতে সেটি দেখেই বলা সম্ভব কোথায় যাবে চিঠিটি।

পিনের প্রথম সংখ্যাটি অঞ্চল, দ্বিতীয় সংখ্যাটি উপঅঞ্চল এবং প্রথম দুটি সংখ্যার সঙ্গে তৃতীয় সংখ্যা যুক্ত হয়ে চিঠি বাছাইয়ের ডাক জেলা নির্দেশ করে। শেষ তিনটি সংখ্যা, ডাকঘরের সংখ্যা। এর মধ্যে চতুর্থ সংখ্যাটি নির্দেশ করে, প্রাপকের ডাক জেলার কোন অফিসে চিঠি পৌঁছবে। শেষ দুটি সংখ্যা একেবারে ডেলিভারি অফিস/ ডাকঘর নির্দেশ করে। সেটি ০১ হলে জেনারেল পোস্ট অফিস বা হেড পোস্ট অফিস বোঝাবে। শেষের দুটি সংখ্যা যত বড় হবে, বুঝতে হবে সেই ডাকঘর তত নতুন। উল্লেখযোগ্য যে, প্রতিটি পিন আবার একটি পোস্ট অফিসের সঙ্গেই ম্যাপিং-এ যুক্ত করা আছে।
ভারতের চিঠির আদান-প্রদান যতদিন চলবে, পিন (PIN) ততই শতবর্ষের দিকে এগিয়ে চলবে।

Latest article