প্লিজ, একটু ভাবুন

পুজো শেষ। আজ কার্নিভাল। বঙ্গ জীবন থেকে আনন্দ উৎসব কেড়ে নেওয়ার প্ররোচনা অব্যাহত। কিন্তু সেই প্রয়াসের ব্যর্থতাও কি অনিবার্য নয়? উত্তর খুঁজলেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

২৭ বছর আগেকার ঘটনা। ঘটনাটা পশ্চিমবঙ্গেরও নয়। রাজস্থানের। তবু একটু পড়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন, কেন পুরোনো কাসুন্দি ঘাঁটতে বসেছি।
এই ঘটনার কেন্দ্রে আছেন ভাঁওয়ারি দেবী। রাজস্থানের ছোট্ট এক গ্রামের বধূ। ছ’বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। মা দুর্গার মতোই চার সন্তানের জননী। সরকারি প্রকল্পে কাজ করা দিনমজুর এবং সমাজের অবক্ষয় নিয়ে সরব হওয়া এক নারী।
শিশু বয়সে বিয়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছিলেন তিনি। ‘নিচু জাতে’র হয়েও গুজ্জর পরিবারের মাত্র ন’মাসের মেয়ের বিয়ে আটকে দিয়েছিলেন তিনি। ফল ভোগ করতে হয়েছিল তাঁকেই। মাঠে কাজ করার সময় পাঁচজন গণধর্ষণ করেছিল ভাঁওয়ারি দেবীকে। তারপর?
পুলিশ এফআইআর নেয়নি। হাসপাতাল স্বাস্থ্যপরীক্ষা করেনি। যতক্ষণে জয়পুরের হাসপাতালে গিয়ে স্বাস্থ্যপরীক্ষার সুযোগ মিলল, ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। নমুনা সংগ্রহ করেও লাভ হল না।
নিম্ন আদালতে মুক্তি পেয়ে গিয়েছিল অভিযুক্তরা। কোর্ট বলেছিল, স্বামী গণধর্ষণ দেখেনি। তথ্য-প্রমাণও নেই। উপরন্তু মহিলা একইসঙ্গে কাকা এবং ভাইপোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। আমাদের দেশের সংস্কার এমন নয়। ভাইপোর সামনে কাকা কখনও ধর্ষণ করতে পারে না। একঘরে হয়ে গিয়েছিলেন ভাঁওয়ারি দেবী। মায়ের সৎকারেও অংশ নিতে পারেননি ।
কিন্তু লড়াই থামাননি। আরও উঁচু আদালতে। আর সমাজেও। তারই ফল ছিল বিশাখা গাইডলাইন। সমাজের নানা স্তরে বাল্যবিবাহ আর মহিলাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রচার। সাহসিকতার জন্য পরবর্তীকালে সরকারি পুরস্কারও। ভাঁওয়ারি দেবী জানতেন, নিজের জন্য লড়ছেন না তিনি। তাঁর লড়াই সিস্টেম, সামাজিক অশিক্ষা এবং অশুভের বিরুদ্ধে। এই যুদ্ধে তাঁকে জিততেই হবে।
অবশেষে সুপ্রিম কোর্ট ‘বিশাখা গাইডলাইন’ ইস্যু করেছিল ১৯৯৭ সালে। লক্ষ্য ছিল, কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যেন যৌন হয়রানির শিকার হতে না হয়। এই গাইডলাইনের ভিত্তিতে আইন প্রণয়ন হতে সময় লেগে গিয়েছিল আরও ১৫ বছর। মাঠেঘাটে হোক কিংবা অফিস, কাজে যাওয়া নারী সমাজের প্রত্যেক প্রতিনিধি আশ্বস্ত হয়েছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, যাক, এবার আমাদের হাতে একটা অস্ত্র এল। সরকার পাশে দাঁড়াল। আইন সঙ্গ দিল। পেছনকার ইতিহাসের কথা কেউ টের পাননি।
আরও আগেকার কথা। চেনা জীবনের নয়, পুরাণের। ভগবান শ্রীবিষ্ণু তখন যোগনিদ্রায়। তাঁর কানের মল থেকে জন্ম নিয়েছিল দুই দৈত্য। মধু ও কৈটভ। দীর্ঘ সময় তপস্যার পর দেবীর বর পেয়েছিল তারা। সুরাসুর কেউ তাদের বধ করতে পারবে না। তারপরই শুরু হয়েছিল মধুকৈটভের উৎপাত। এমনকী স্বয়ং ব্রহ্মাকে হত্যা করতে উঠেপড়ে লেগেছিল তারা। আতঙ্কিত ব্রহ্মা চেষ্টা করেছিলেন স্তব করে শ্রীবিষ্ণুর যোগনিদ্রা ভাঙাতে। কিন্তু পারেননি। তখন তিনি শুরু করেছিলেন মহামায়ার আরাধনা। কারণ, যে যোগনিদ্রা নারায়ণকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিল, তিনি দেবী স্বয়ং।
খড়্গিনী শূলিনী ঘোরা গদিনী চক্রিনী তথা।
শঙ্খিনী চাপিনী বাণভূসণ্ডীপরিঘায়ুধা।।
এবারেও সেই দেবীর পূজা সম্পন্ন হল। কিন্তু দুঃখের কথা, তার সমান্তরালে চলল ডাক্তারবাবুদের আন্দোলন। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সংস্কার চাই। স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নয়ন চাই। দুর্নীতির বিনাশ চাই। আর চাই বিচার। কোনও দাবি উপেক্ষণীয় নয়। কিন্তু কোনও দাবিই রাতারাতি মিটিয়ে দেওয়ার মতো নয়। সবাই জানেন ও মানেন।
কিন্তু তাতে কী? আন্দোলনের নামে অরাজকতা বহাল না থাকলে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ হবে কীভাবে? সুতরাং, অনশন ও অনিবার্য অসুস্থতা। সুতরাং, অরাজকতা তৈরির চেষ্টায় আংশিক সাফল্য। কিন্তু বাংলা কি থমকে থাকল। মানুষ কি উৎসবে ফিরল না? এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর হয় না। এর উত্তর অনুভবের বিষয়বস্তু।
দুর্গাপূজার সমারোহ নিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতেই নানা কথা উঠেছিল। কথা উঠেছিল শহর কলকাতার হুজুগেপনা নিয়েও। এবারের মতোই। কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর হুতোম প্যাঁচার নকশায় ‘কলিকাতার বারোইয়ারি পূজা’র রংদার বিবরণ দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, সেইসময় কেবল পূজা হত না, আমোদ-আহ্লাদের নানা আয়োজন থাকত। শুধু যে কলকাতায় বারোয়ারিতলা জমে উঠত তা নয়, কলকাতার বাইরেও কলকাতার দেখাদেখি নানা আয়োজন। হুতোম উবাচ: চুঁচড়োর মত বারোইয়ারি পুজো আর কোথাও হইত না। ‘আচাভো’ ‘বোম্বাচাক’ প্রভৃতি সং প্রস্তুত হইত। ‘সহরের ও নানা স্থানের বাবুরা’ ‘বোট’, ‘বজরা’, ‘পিনেস’ ভাড়া করিয়া সং দেখিতে যাইতেন। গুপ্তিপাড়া, কাচড়াপাড়া, শান্তিপুর, উলো— কলিকাতার নিকটবর্তী এইসকল জায়গাতেও বিশেষ আমোদ জমিত। শান্তিপুরওয়ালারা পাঁচলক্ষ টাকা খরচ করিয়া এক বারোইয়ারি পূজা করেন। সাত বৎসর ধরিয়া সে পূজার উদ্যোগ গ্রহণ করা হইয়াছিল। ষাট হাত উঁচু প্রতিমা, বিসর্জনের দিন ‘পুতুল’ কাটিয়া কাটিয়া জলে নিরঞ্জন করিতে হইল। তাহাতে গুপ্তিপাড়াওয়ালারা মাতার অপঘাত মৃত্যু উপলক্ষে গণেশের গলায় কাছা বাঁধিয়া পূজা বসাইয়াছিলেন— তাহাতেও বিস্তর খরচ হইল। খরচের উত্তর খরচ। হুজুগের উত্তর হুজুগ। এ বলিতেছে আমায় দেখ, ও বলিতেছে আমিই বা কম কী! কলিকাতায় পূজা ঘিরিয়া বাবুতে বাবুতে ঠোকাঠুকি, মোসাহেবদের পারস্পরিক তরজার শেষ নাই। শরৎকালের শহর যেন উল্লাসে টগবগ করিয়া ফুটিতেছে। আর সেই হুজুগে গা না ভাসালেও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ হিন্দুর পৌত্তলিকতার ঘোর বিরোধী হয়েও নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেননি দুর্গোৎসব থেকে।
১৮ মার্চ, ১৯১২-তে কাদম্বিনী দেবীকে লেখা পত্রে আরও অকপট রবীন্দ্র-ভাবনা। ‘প্রতিমা সম্বন্ধে আমার মনে কোনও বিরুদ্ধতা নেই। অর্থাৎ যদি কোনও বিশেষ মূর্তির মধ্যেই ঈশ্বরের আবির্ভাবকে বিশেষ সত্য বলে না মনে করা যায় তাহলেই কোনও মুশকিল থাকে না। তাকে বিশেষ কোনও একটি চিহ্নদ্বারা নিজের মনে স্থির করে নিয়ে রাখলে কোনও দোষ আছে, একথা আমি মনে করি না। কিন্তু এ সম্বন্ধে কোনও মূঢ়তাকে পোষণ করলেই তার বিপদ আছে।’
১৮৯৪ এর ৫ অক্টোবর ভাইঝি ইন্দিরা দেবীকে একটা চিঠিতে লেখেন, ‘কাল দুর্গাপুজো আরম্ভ হবে, আজ তার সুন্দর সূচনা হয়েছে। ঘরে ঘরে সমস্ত লোকের মনে যখন একটা আনন্দ হিল্লোল প্রবাহিত হচ্ছে, তখন তাদের সঙ্গে সামাজিক বিচ্ছেদ থাকা সত্ত্বেও সে আনন্দ মনকে স্পর্শ করে।’ অর্থাৎ, ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বী, নিরাকারবাদী, একেশ্বরের উপাসক রবীন্দ্রনাথও সনাতন হিন্দুধর্মের প্রাণঢালা উৎসবে নিজেকে বিযুক্ত রাখতে পারেননি।
যেমন পারল না প্রতিবাদী সাজার নাটক করে একালের রাজনীতিকরা। বাঙালিকে পই পই করে উৎসব বিমুখ করার চেষ্টা চলল। কিন্তু সে চেষ্টা সফল হল কই!
রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, ‘একদিকে সত্য, অন্যদিকে আনন্দ, মাঝখানে মঙ্গল। তাই এই মঙ্গলের মধ্য দিয়েই আমাদের আনন্দলোকে যেতে হয়।’
সেই আনন্দলোকে যাত্রা এবারেও অব্যাহত রইল। এই দুর্গাপুজোতেও।

Latest article