আশ্চর্য এক দেশ। দেখা মেলে না কোনও রাষ্ট্র বিরোধীর। কোথাও নেই সামান্যতম প্রতিবাদ। সবাই সুখী। উড়ে বেড়ান। ঘুরে বেড়ান। আপনমনে। প্রত্যেকের কণ্ঠে শোনা যায় রাজা ও তাঁর কাকার জয়গান। যদি কেউ ভুল করেও রাজা ও তাঁর কাকার বিরুদ্ধে মুখ খোলেন, জনগণ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন। দেশটিতে রাষ্ট্র বিরোধিতা এতটাই তলানিতে এসে ঠেকেছে যে, কারাগার থেকে শেষ রাজনৈতিক বন্দিকেও মুক্তি দিতে হয়। সেই বন্দি রাজা ও তাঁর কাকার জয়ধ্বনি দিতে দিতে বেরিয়ে যান। ফলে অস্তিত্ব সংকট দেখা দেয় দেশের পুলিশ বিভাগে। কারাগার শূন্য। অপরাধী নেই। প্রতিবাদী স্বর নেই। যে-কোনও দিন তালা ঝুলে যাবে থানায়। পরিস্থিতি জটিল। বাধ্য হয়ে পুলিশ প্রধান নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে উদ্যোগী হন। বিভাগের এক সৎ অফিসারকে রাজনৈতিক অপরাধ ঘটানোর আদেশ দেন। সিদ্ধান্ত নেন রাষ্ট্রের শত্রু তৈরি করার। ফাঁদ পেতে বন্দি করেন সৎ অফিসারটিকে। অদ্ভুত এই বিষয় ঘিরেই দানা বেঁধেছে পঞ্চম বৈদিক-এর নাটক ‘পুলিশ’।
আরও পড়ুন-ঘন নিশি কৌশিকী
২২ অগাস্ট ছিল প্রবাদপ্রতিম নাট্যব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্রের জন্মদিন। ওইদিন তাঁর স্মরণে কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ মঞ্চস্থ হল নাটকটি। অর্পিতা ঘোষের নির্দেশনায়। মূল নাটকটি পোলিশ নাট্যকার ও রাজনৈতিক সাংবাদিক স্লাওমির ম্রোজেকের লেখা। ১৯৫৮ সালে এই নাটকের হাত ধরেই নাট্যকার হিসেবে ঘটেছিল তাঁর আত্মপ্রকাশ। নাটকটি বাংলায় রূপাদান করেছেন অর্পিতা ঘোষ। বুনে দিয়েছেন মৌলিক ভাবনাচিন্তা। এর আগেও অর্পিতা বেশকিছু বিদেশি নাটক বঙ্গীকরণ এবং মঞ্চস্থ করেছেন। সাফল্যের সঙ্গে। কেমন ছিল সেই অভিজ্ঞতা? ৩ নভেম্বর অবনীন্দ্র সভাঘরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতায় জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যের বিষয় ছিল ‘বিদেশি ফুল স্বদেশি সৌরভ’। অনবদ্য ছিল সেই বক্তৃতা। ‘পুলিশ’ দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল। বিদেশি নাটক বা কাহিনির পাশাপাশি অর্পিতা বাংলা কহিনি থেকেও নাটক রচনা ও মঞ্চস্থ করেছেন। তিনি গভীরভাবে সমাজ এবং রাজনীতি সচেতন। ফলে তাঁর নাটকে অবলীলায় ঢুকে পড়ে রাজনীতি। সমাজের ভুল ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করেন। চোখে আঙুল দিয়ে দেখান। বিনোদনের তুলনায় তাঁর নাটক রেখে যায় বিশেষ বার্তা। দর্শকদের জাগায়, ভাবায়।
‘পুলিশ’ একটি পলিটিক্যাল স্যাটায়ার। আঙুল তোলা হয়েছে দেশের রাজা ও তাঁর কাকার দিকে। নাট্যকার অর্পিতা রূপকের আশ্রয় নিয়ে চতুর শাসককে সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন। দেগেছেন কামান। গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘটেছে বড়সড় রেল দুর্ঘটনা। মারা গেছেন বহু মানুষ। এরজন্য দায়ী দেশের দুর্বল রেলওয়ে ব্যবস্থা। তার বিরুদ্ধে বোনা হয়েছে জোরালো প্রতিবাদ। যে-দেশে এখনও বহু মানুষ প্রায় অভুক্ত থাকেন, সেই দেশে মন্দির নির্মাণ নিয়ে দেখা যায় অকারণ মাতামাতি। ওড়ানো হয় ধর্মের ধ্বজা। আওয়াজ তোলা হয়েছে তার বিরুদ্ধেও। নাটকটি দেখতে দেখতে দাম্ভিক রাজা ও তাঁর ধূর্ত কাকাকে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না। উচ্চারিত হয়েছে জরুরি কিছু কথা। এমন এক স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, যেখানে রাজার বিরুদ্ধে কোনও প্রজা টুঁ শব্দটি করতে পারেন না। কারণ রাজা কৌশলে বন্ধ করে দিয়েছেন রাষ্ট্র বিরোধিতার সমস্ত পথ। খর্ব করেছেন স্বাধীনতা। কথা বললেই কঠিন শাস্তি। সেই কারণেই কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। ঘুরে বেড়ান মুখে হাসি ও বুকে ভয় নিয়ে। রাজা পুষে রেখেছেন একদল স্তাবক। তাঁরা রাজার নামে জয়ধ্বনি দেন। চতুর্দিকে ভেসে বেড়ায় সুখের বিজ্ঞাপন। যদিও একদিন রাজার বিরুদ্ধে ওঠে স্বর। ঘোষণা হয় জেহাদ। মুক্তির স্বাদ পান বন্দি। হাতের মুঠোয় আসে কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। দেড় ঘণ্টার নাটক। এককথায় নিটোল। চোখাচোখা সংলাপ। সরাসরি বিঁধে যায়। নেই অতিরিক্ত মুহূর্ত। নেই অপ্রয়োজনীয় চরিত্রের উপস্থিতি। ফলে টানটান। নির্মেদ।
আরও পড়ুন-ঋতুরঙ্গে নারী
দুর্দান্ত অভিনয়। প্রত্যেকের। সেরাটা আদায় করে নিয়েছেন নির্দেশক। পুলিশ প্রধানের চরিত্র দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রাহুল সেনগুপ্ত। বন্দি সূর্যর চরিত্রে অভ্র মুখোপাধ্যায়। দুটি পর্বে মঞ্চে এসেছেন। প্রথম পর্বে বন্দি হিসেবে। দ্বিতীয় পর্বে পুলিশ। দুটি পর্বেই নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। পুলিশ অফিসারের ভূমিকায় দুর্দান্ত কোরক সামন্ত। শুরুতে তাঁর অভিনয় ছিল কিছুটা কৌতুক মেশানো। শেষে হয়ে ওঠেন বিদ্রোহী, বিপ্লবী। তখন তাঁর অভিনয় আলাদা মাত্রা পায়। অফিসারের স্ত্রীর চরিত্রে মাধবী বিশ্বাস যথাযথ। ডেপুটি জেনারেল অফ পুলিশের ভূমিকায় দেখা গেছে দেবকমল মণ্ডলকে। এছাড়াও জেল অ্যাটেন্ডেন্ট হিসেবে ছিলেন রীতা মণ্ডল, রাজদীপা কর্মকার, পায়েল সাহু, শ্রীজাতা ভট্টাচার্য। জেলরক্ষী স্বরূপ সরকার, রাহুল মজুমদার, সুপ্রভাত কয়াল, অমিত দাস, রোহন ঘোষ, মোনা মোল্লা। নেপথ্যে অনীক, রুদ্রদীপ, অনুপ, বিহান, কেকা, সুস্মিতা, অর্পিতা, রুমেলা, সংযুক্তা, মালবিকা ও অনির্বাণ। নাটকের দৃশ্যপট রচনা করেছেন দেবেশ চট্টোপাধ্যায়। সেট নির্মাণে মদন শর্মা। সঙ্গীত পরিচালনায় অনিন্দ্য নন্দী। আলো পল্লব জানা। মেকআপ মোঃ আলি।
‘পুলিশ’-এ আঁকা হয়েছে এক টালমাটাল রাষ্ট্র, এক অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের ছবি। যে-সময় সারা দেশে কণ্ঠরোধের নিদারুণ চেষ্টা চলছে, সেই সময় এই ধরনের একটি বিস্ফোরক নাটক উপহার দিয়ে অর্পিতা ঘোষ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন প্রবল পরাক্রমশালী শাসকের প্রতি। নির্ভীক নাট্যকার-নির্দেশককে স্যালুট জানাতেই হয়।