বিজেপি শাসিত রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী বদলটাই দস্তুর। মুখ বদলে ভোটে বাঁচার চেষ্টা। এ রাজ্যে ওসব হয় না। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখানে উন্নয়নের অন্যতম কারণ। লিখছেন মইনুল হাসান
রাজ্য নির্বাচনের আগে আর একবার মুখ্যমন্ত্রী পাল্টানো হল গুজরাটে। আগামী বছর এই রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হবে। ২০১৭ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে এমনই ঘটনা ঘটেছিল। আনন্দীবেন প্যাটেলকে পাল্টে রাজ্যসভার সাংসদ বিজয় রূপাণীকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছিল। তিনি ছিলেন জৈন সম্প্রদায়ের মানুষ। নতুন মুখ্যমন্ত্রী পতিদার সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করেন। যাঁরা সংখ্যায় গুজরাটে ১৩ শতাংশ। মুখ্যমন্ত্রী দু’টি পতিদার সংগঠনের নেতা।
আরও পড়ুন-অসম পুলিশের বর্বরতার নিন্দা দেশজুড়ে
বিভিন্ন রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী বদল করাকে বিজেপি নিয়মিত ঘটনায় নিয়ে গিয়েছে। একটা রাজ্যে মাত্র তিন মাসের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী পাল্টানো হয়েছে। ৬ মাসে বিজেপির ৫ জন মুখ্যমন্ত্রীকে পাল্টানো হল। প্রধান কারণ রাজ্য ও দেশ শাসনে ব্যর্থতা। এ-ব্যাপারে রাজ্য ও কেন্দ্র নেতাদের চাপান-উতোর চলছেই। করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থতা, অনুন্নয়ন এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতি বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে দগদগে ঘা-এর মতো দেখা যাচ্ছে। কেন্দ্রের শাসনও তা থেকে আলাদা কিছু নয়। সুতরাং, মুখ্যমন্ত্রী পাল্টে মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার খেলাতে মত্ত হয়েছে বিজেপি। কিন্তু মানুষ এটা বুঝে নিয়েছে।
আরও পড়ুন-১৪৪ ধারার অপব্যবহার, তৃণমূলকে বাধা, অথচ সভা করছে শাসকদল
বিজেপি সবসময় জাতপাতের খেলা খেলে থাকে। প্রত্যেকটা মুখ্যমন্ত্রী তৈরি করা এবং পাল্টানোর পিছনে সেটাই বড় কারণ হয়ে ওঠে। এবার গুজরাটের ঘটনাটির সামান্য বর্ণনা দিলে পরিষ্কার বোঝা যাবে। আরএসএসের ব্রাহ্মণ্যবাদী আদর্শের ভিত্তিতে যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি অনুসরণ করে, সেক্ষেত্রে বিজেপির ভোটে সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা কম। মনুবাদী ভাবনায় বর্ণহিন্দুই শ্রেষ্ঠ। সেখানে দলিত, আদিবাসী, ওবিসি মহিলাদের অধিকার ও মর্যাদা নেই। এইসব ভাবনা-চিন্তা থেকে বিজেপি জানে যে সরকারি নীতি যাদের স্বার্থে তারা তৈরি করে, তাতে আমজনতার সমস্যা কমার সম্ভাবনা কম বরং সেটা আরও বেড়ে যায়। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই সরকার-বিরোধী ক্ষোভ ও আন্দোলন বাড়বে। সেটা সারা দেশেই বাড়ছে।
আরও পড়ুন-ভুল চুল কাটার খেসারত ২ কোটি
ভোট পাবার জন্য বিজেপি দুটো কৌশল গ্রহণ করে থাকে। প্রথম, সম্পূর্ণ সংঘ পরিবারকে সক্রিয়ভাবে কাজে লাগিয়ে পরিকল্পিতভাবে ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক ও জাতপাতের বিদ্বেষ-ঘৃণা-হিংসা ছড়িয়ে মেরুকরণের ক্ষেত্র তৈরি করে, যাতে সেখান থেকে বিজেপি তাদের রাজনৈতিক ফসল তৈরি করতে পারে। এই কাজটি সঙ্ঘ পরিবার বহুদিন থেকেই করে আসছে। ফলে তার ধার বা গ্রহণযোগ্যতা অনেক কমে গিয়েছে। দ্বিতীয়, আর-একটি রাস্তা খুলেছে। এই প্রক্রিয়ায় জাতপাতের সমীকরণকে মাথায় রেখে মু্খ্যমন্ত্রী পাল্টানো হয়। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষকে মন্ত্রী বানানো হয়। ভাব করছে যে তারা কাউকে বঞ্চিত করছে না। কিন্তু প্রকৃত বঞ্চনা যে হচ্ছে নীতিতে সেটা ধরতে দিতে চায় না।
পশ্চিমবাংলায় বিগত বিধানসভা নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-সহ অন্য বিজেপি নেতারা মেরুকরণের নীতিই গ্রহণ করেছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন উন্নয়নের কথা বলে মানুষের দরজায় উপস্থিত হয়েছেন, বিগত দশ বছরের ইতিবাচক উন্নয়নের হিসাব দিয়ে সমর্থন চেয়েছেন, ঐতিহ্য, সম্প্রীতি বজায় রেখে মানুষের ঐক্য চেয়েছেন এবং সেই কারণে সমর্থন চেয়েছেন মানুষের। ঠিক উল্টোটা করেছে বিজেপি। মানুষে-মানুষে ধর্মের বিভেদ, জাতপাতের প্রশ্ন, আদিবাসী পরিবারে মধ্যাহ্নভােজের নাটক করে বাংলায় মানুষের মন জয় করতে চেয়েছে। তাদের উচ্চাশা ছিল অনেক। সেটা একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ে এখন দিশেহারা হয়েছে। এমন দিশেহারা যে যাঁরা নির্বাচিত হয়েছেন তাঁরাও আর বিজেপিতে থাকতে চাইছেন না অনেকেই।
আরও পড়ুন-ভ্যাকসিন নিয়ে কেন্দ্রকে কটাক্ষ করলেন ডেরেক ও ব্রায়েন
আসলে এটা সামগ্রিকভাবে বিজেপির জনবিরোধী ও দেউলিয়া-রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ। আর্থিকক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। প্রতি মাসে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। পেট্রোলের দাম সেই যে সেঞ্চুরি করল তারপর তার আর নামার চিহ্ন নেই। ডিজেল পিছন পিছন যাচ্ছে। রান্নার গ্যাস প্রায় ১ হাজারের দোরগোড়ায়। আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রোপণ্যের দাম স্থিতিশীল। তবুও এখানে আমরা বাড়তি দিচ্ছি। আসলে এই ফাঁকে সরকার আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাজেট ঘাটতি মিটিয়ে ফেলেছে। দেশীয় পুজিঁপতিদের পোয়াবরো। তাঁদের মুনাফার পাহাড় তৈরি হচ্ছে। করোনার সময় মানুষ যখন বাঁচার জন্য ত্রাহি-ত্রাহি রব করছে তখন কেন্দ্রের সরকারের আশীর্বাদে আম্বানি ও আদানিরা মুনাফার পাহাড় গড়েছে।
আরও পড়ুন-দলনেত্রীর সমর্থনে দেওয়াল লিখনকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেল তৃণমূল কংগ্রেস ছাত্র পরিষদ
এমন একটা বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী-পাল্টানো বিজেপির বহু পুরনো খেলা। আমার মনে পড়ছে, একবার নির্বাচনের মাত্র ৪০ দিন আগে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী পাল্টেছিল বিজেপি। সুষমা স্বরাজকে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছিল। হেরেছিল বিজেপি। উত্তরাখণ্ড, গুজরাটের মতো রাজ্যগুলিতে একই খেলায় মত্ত বিজেপি। আসলে এ-সবই দেউলিয়া রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ।
আরও পড়ুন-
মুখ্যমন্ত্রী পাল্টানো দেশের সমস্যার সমাধানের পথ হতে পারে না। স্থিতিশীলতা উন্নয়নের পূর্ব শর্ত। যা পশ্চিমবঙ্গে দেখা গেছে বিগত ১০ বছর। এই ১০ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্য যেমন উন্নয়নের পথে গেছে, তেমনই সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় হয়েছে। মানুষের জীবনে প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্য এসেছে। প্রত্যন্ত গ্রামে থাকা মানুষও আজ রাজ্য সরকারের সঙ্গে সর্বোপরি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একাত্ম বোধ করে। সুতরাং মুখ্যমন্ত্রী পাল্টানো কোনও সাফল্যের কারণ হতে পারে না। পশ্চিমবাংলার মানুষ তা দেখিয়ে দিয়েছে। এক-আধবার এ-ব্যাপারে চমক দেওয়া যায়। যেমন পশ্চিমবাংলাতেই হয়েছে। ২০০৬ সালে বামপন্থীরা নির্বাচনে জিতেছিল তার অন্যতম ধনাত্মক কারণ ছিল দীর্ঘদিনের মুখ্যমন্ত্রী পাল্টানো। কিন্তু ২০১১ সালেই সেই চমক একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হলেন। সেই স্থিরতা আজও আছে। সারা দেশ অবাক বিস্ময়ে দেখছে কীভাবে রাজ্য পরিচালিত হচ্ছে। বিদেশি কাগজগুলিও স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে। আগামী ২০২৪ সে- কারণেই দেউলিয়া রাজনীতির পরিবর্তে ইতিবাচক রাজনীতির প্রতিষ্ঠার জন্য দেশ অপেক্ষা করছে।