(গতকালের পর)
১৪ অগাস্ট রাত দখলের নামে ডিওয়াইএফআই এবং একদল গুন্ডা আরজি করে গাজোয়ারির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকার সরকারি সম্পদের ক্ষতি করে। সেই সময় গণমাধ্যমে প্রশ্ন তোলা হয় কেন পুলিশ কুড়ি মিনিট ধরে তাদের আরজি কর হাসপাতালে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ ভাঙতে দিতে সাহায্য করলেন? কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে ওই দিন পুরো বাংলা তথা কলকাতাব্যাপী নাগরিকদের আন্দোলন চলছিল, যা মোটেও সরকার-বিরোধী ছিল না। কিন্তু এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্ব হতে চাওয়ায় যখন ডিওয়াইএফআই ব্যর্থ হয় তখন তাদের চক্রান্ত শুরু হয়। পুলিশ কলকাতাকে স্বাভাবিক ও সাবলীল রাখতে সর্বব্যাপী আন্দোলনের ব্যবস্থাপনায় যখন ভূমিকারত; তখন আরজি করের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে তারা গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে হিংসাত্মক রূপ দেয়। যেহেতু পুলিশ সারা কলকাতায় সুরক্ষার কাজে ব্যস্ত অর্থাৎ ছড়িয়ে রয়েছে এবং আন্দোলন শহরের রাস্তাকে বিশেষভাবে আরজি করের আশেপাশের রাস্তাকে চক্রব্যূহের মতো আটকে রাখে স্বাভাবিকভাবেই ঘটনাস্থলে নতুন পুলিশ বাহিনী পৌঁছাতে কিছু সময় লেগে যায়, যেটা সাধারণ মানুষের বুঝতে অসুবিধা হয় না। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ডিওয়াইএফআই হিংসাত্মক আন্দোলন করল এবং উল্টে তারা সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা শুরু করল। বলা হল পুলিশ নাকি ভাঙচুর করতে সহায়তা করেছে! মারমুখী জনতা সামলানোর ক্ষেত্রে পুলিশ অবশ্যই টিয়ার গ্যাস বা লাঠিচার্জ করতে পারে কিন্তু সেদিন তো কোনও হিংসাত্মক আন্দোলনের কথা ছিল না বা কোনও রাজনৈতিক দলের উদ্যোগের কথাও ছিল না। তাছাড়া বর্তমান সময় ট্রিগার হ্যাপি যুগ নয়। তাই পুলিশের সাময়িক ভাবে নিজেদের তৈরি করার সময়ের জন্য যেটুকু দেরি হয় তাতেই পুলিশের উপর আক্রমণ আসে। এক লেডি কনস্টেবলের চোখে গুরুতর আঘাত লাগে এবং এক পুলিশ কর্তার মাথা ফাটে; কিন্তু সারা কলকাতা জুড়ে পুলিশ আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিয়ে এসেছে সেকথা সকলেই ভুলে যায়!
আরও পড়ুন-হিলি রেল প্রকল্পের জন্য ৮১ একর জমি দিল জেলাপ্রশাসন
ঠিক একইভাবে পরবর্তীকালে ছাত্র সমাজের নামে একটি নিরপেক্ষ জন-আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে বাংলার বিরোধী দলনেতা শ্রীযুক্ত শুভেন্দু অধিকারী মহাশয় ঘোষণা করে দিয়েছেন যদি মুখ্যমন্ত্রী তার আগে পদত্যাগ না করেন তাহলে গুলি চালানোর দায় তাঁকে নিতে হবে। অর্থাৎ ইঙ্গিত, অশান্তি হবে। গুলি চলবে লাশ পড়বে অর্থাৎ লাশের রাজনীতি হবে। পুলিশ যথাযথ ব্যবস্থা নেয় যাতে তথাকথিত নবান্ন অভিযান শান্তিপূর্ণ হয়। ইতিমধ্যে ছাত্র সমাজের অন্যতম আহ্বায়ক যিনি বিজেপির যুব ও মিডিয়া সেল-এর নেতা তিনি দামি গাড়ি করে শহরের অন্যতম পাঁচতারা হোটেলে প্রবেশ করেন। যার সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়া যায়, কিন্তু তিনি কেন ওই স্থানে গিয়েছিলেন তার কোনও উত্তর পাওয়া যায় না। দেখা যায় ছাত্র সমাজের সকলে আন্দোলনে একই ধরনের টি শার্ট পরে যোগ দেয়। একদিনের মধ্যে কীভাবে ওই টি-শার্ট জোগাড় করলেন এবং তার টাকাই বা কে বা কারা দিলেন, সেটাও প্রশ্নের অতীত নয়। আর নবান্ন অভিযানের উদ্দেশ্যটাই কী? মামলা তো সিবিআই-এর হাতে, আদালত নজরদারি করছে! দেখা গেল ছাত্র সমাজের নামে বেশ কিছু বিজেপি নেতা ও তাদের সাকরেদগণ পুলিশের উপর নির্মম অত্যাচার শুরু করলেন, কারণ সুরক্ষা প্রদানকারী পুলিশই এদের সফ্ট টার্গেট। ২৫ জনের উপর পুলিশ আহত হন। এক পুলিশের চোখ প্রায় নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু তাদের দাবি, আন্দোলন নাকি শান্তিপূর্ণ ছিল! ঠিক তার পরেই কেন্দ্রের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও অভিসন্ধি প্রমাণ হল; মানবাধিকার কমিশন তথাকথিত শান্ত (!) গণ-আন্দোলনের উপর পুলিশি অত্যাচারের (!) হিসাব চাইল। কিন্তু বদলাপুর-এর ক্ষেত্রে কোনও হিসাব চাওয়া হয়নি!
আরও পড়ুন-মানুষখেকো নেকড়ে ধরতেও ব্যর্থ যোগীর বনদফতর
ছাত্র আন্দোলন ও তার আগে পরে, বনধের ডাক-সহ, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির দাবি মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। বিরোধীদল হিসেবে বিজেপির নেতারা রাজ্যপালের কাছে ৩৫৬ জারি করার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু অবাক লাগে একই সময়ে মহারাষ্ট্রের বদলাপুরে মাত্র চার বছরের বাচ্চার সঙ্গে, তার নিজের স্কুলের মধ্যে, ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ৭০০ জনের উপর পুলিশ ব্যবস্থা নিয়েছে। সেখানেও আন্দোলনের ওপর নানান নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। সরকার আদালতে গিয়েছে। আদালত বিরোধীদের ডাকা বন্ধকে অন্যায্য বলেছে। আবার উন্নাও, হাথরাস কিংবা সামগ্রিকভাবে মণিপুর, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান প্রভৃতি জায়গায় ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক নারকীয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার ডবল ইঞ্জিন সরকারের বিজেপি ৩৫৬ ধারা জারি করার জন্য কেন্দ্র সরকারের কাছে দাবি করেনি কিংবা পদত্যাগও করেননি সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০২১ সালে লিঙ্গজনিত হিংসার (সেক্স্যুয়াল ভায়োলেন্স) সংখ্যা ছিল ৪২,৮২৭৮; যা ২০২২-এ হয় ৪৪,৫৮৫৮। উল্লেখ্য ২০২২ সালেই প্রতিদিন ৮৬টি ধর্ষণ হয়, বর্তমানে তার সংখ্যা ৯০, এক বছরের সংখ্যা ৩১,৫১৬। এ-বিষয়েও তারা চুপ। তাহলে এখানে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি কেন? আসলে সম্প্রতি মাত্র ২৪০ আসন পেয়ে সহযোগিতার ভিত্তিতে সরকার চালাচ্ছে বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গে মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ভারতের যে বৈচিত্র্য এবং তার মধ্যে ঐক্যকে বজায় রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির ‘‘আবকি বার ২০০ পার” কিংবা ‘‘৩৫ পার” -এর স্বপ্ন রুখে বিধানসভা ও রাজ্যসভার ভোটে বিজেপির রথ আটকেছেন। মনুবাদী ও পুরুতান্ত্রিক বিজেপি, যাদের আজ অবধি কোনও মহিলা সভাপতি নেই, তারা এক মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বারবার হেরে তাকেই মহিলার সুরক্ষার পরিপ্রেক্ষিতে আক্রমণ করে হারাতে চাইছে। (এরপর আগামীকাল)