আবার ফাঁকা কলসি, ফের অমিত শাহ। এবারেও তাঁর আগমন কলকাতায়।
শূন্য কলসির আওয়াজ বেশি। গত এপ্রিলে কলকাতায় এসে অমিত শাহ বলেছিলেন, এরাজ্যে ২০২৪-এর লোকসভায় ৪২টি আসনের মধ্যে ৩৫টি পাওয়ার টার্গেট বিজেপির। বাবু যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ। ঢাল তরোয়ালহীন, জনগণেশ থেকে বিচ্যুত, অচেনা বঙ্গ সংস্কৃতির শরে জর্জরিত বিজেপির নেতারা এরপরই শাহের সুরে তাল মিলিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসকে হারানোর খোয়াব দেখতে শুরু করেন। কিন্তু ভোটে জিততে হলে তো দরকার জনতার আশীর্বাদ, মজবুত সংগঠন আর জন সেবার সদিচ্ছা। সম্ভবত সেকথা তাঁরা বিস্মৃত হয়েছেন।
আরও পড়ুন-অলিম্পিকে ক্রিকেট, উচ্ছ্বাস
ভুলে গিয়েছেন, এ রাজ্যে কয়েক হাজার বুথ এলাকায় এখনও বিজেপির লোকই নেই। জিততে হলে দরকার দৃঢ়চেতা নেতৃত্ব, যাঁরা দলের সকলের কাছেই গ্রহণযোগ্য। বঙ্গ- বিজেপিতে তার অভাবও প্রকট। অনুগামী নির্ভর এই দলটির খোকাবাবু খোয়াব দেখেন, দিল্লি থেকে মোদি-শাহ এসে বুঝি সব ঠিক করে দেবেন, আর রাজ্যে এসে সিবিআই-ইডি কলকাঠি নেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসকে বেকায়দায় ফেলে সব মুশকিল আসান করে দেবে।
আরও পড়ুন-নিঠারিকাণ্ডে ফাঁসির সাজা রদ হল এলাহাবাদ হাইকোর্টে
কিন্তু হায়! তাঁরা একবারও নিজেদের দিকে তাকিয়ে দেখেন না। বঙ্গ-বিজেপি’র নিজেদের ভেতর আকচা-আকচি তো রাস্তায় নেমে এসেছে। পাশাপাশি চলছে গ্রামে গ্রামে জনরোষের স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণ। বিজেপি নেতাদের দেখলেই জনতা ‘ফোন করো, টাকা আনো’ বলে তাড়া করছে। শাহ-নাড্ডার সফরের আগে এটাই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় স্মৃতি বিজড়িত পার্টির হাল। আপাতত হয়তো গদ্দার অধিকারীর নেতৃত্বে গেরুয়া শিবির এর প্রতিষেধক খুঁজতে ব্যস্ত।
আরও পড়ুন-অধিবেশনের অনুমোদন না দিয়ে ফের জটিলতা তৈরি করলেন রাজ্যপাল
পশ্চিমবঙ্গে এই দল ক্ষমতায় নেই। ভবিষ্যতে কবে ক্ষমতায় আসবে বা আদৌ আসতে পারবে কি না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। শোনা যায়, নেতৃত্বের আসন থেকে বঙ্গ-ব্রিগেডকে জেতার ব্যাপারে তাতালেও মোদি-শাহ-নাড্ডারা জননেত্রীর বাংলাকে খরচের হিসাবে ধরে রেখেই অঙ্ক কষেন। এখন রাজ্যে বিরোধী আসনে থেকেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, কাদা-ছোঁড়াছুঁড়ি, ক্ষোভ-বিক্ষোভের যে ধারা অব্যাহত রেখেছে বঙ্গ-বিজেপি, তা ডাবল ইঞ্জিনের যে কোনও রাজ্যের শাসকের লড়াইকেও লজ্জায় ফেলে দেবে। নভেম্বরে নির্বাচন হতে যাওয়া মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ঠেকাতে একাধিক সাংসদ, এমনকী কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকেও প্রার্থী করতে হচ্ছে বিজেপিকে! কিন্তু এ-রাজ্যে বাঁদরের পিঠে ভাগে ব্যস্ত দলকে কোন ফর্মুলায় এক সুতোয় বাঁধা যাবে— তা হয়তো ভেবে কূল পাচ্ছেন না দিল্লির নেতারা। বঙ্গবাসী সবই দেখছে, বিজেপির হাল বুঝছেও।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে রোনাল্ডিনহো, ফুটবল-জার্সি পেলেন ব্রাজিলীয় তারকা
হয়তো ভাবছে, এদের কী করে ভরসা করা যাবে?
আর এই ল্যাজেগোবরে দশা থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘোরানোর অভিপ্রায়ে এখন নানা কুনাট্য রচিত হচ্ছে।
কিন্তু হলে কী হবে, রাজ্যে রাজ্যে গেরুয়া পার্টির যা দশা, তাতে হাল ফেরার চেয়ে আরও বিগড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবলতর।
চার বছর আগে ২০১৯ সালের ৫ অগাস্ট কোনও আলোচনা ছাড়া একতরফাভাবে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ করে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা কেড়ে নিয়েছিল নরেন্দ্র মোদি সরকার। একই দিনে পৃথক রাজ্য জম্মু-কাশ্মীরকে ভেঙে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি করা হয়। একটি জম্মু-কাশ্মীর, অন্যটি লাদাখ। সেইসঙ্গে শুনিয়েছিল ‘উন্নয়নের’ গল্প। এই বিভাজনের পর গেরুয়া শিবির আশা করেছিল, একটি পৃথক অস্তিত্বের মর্যাদা পেয়ে লাদাখের মানুষ বোধহয় তাদের আশীর্বাদ করবে। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। গত চার বছর প্রশাসনের দমনপীড়ন ও প্রতিশ্রুতি পালনে ব্যর্থতার বদলা নিতে প্রথম সুযোগ পেয়েই মোদির দলকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে কার্গিল, লাদাখের মানুষ। লাদাখ স্বশাসিত পার্বত্য উন্নয়ন পরিষদের ভোটে কার্যত ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছে পদ্মশিবির। মোট ২৬টি আসনের লড়াইয়ে তারা পেয়েছে মাত্র ২টি আসন। বাকি ২২টি আসনের মধ্যে ১২টিতে জিতেছে ন্যাশনাল কনফারেন্স ও ১০টিতে কংগ্রেস। বলা বাহুল্য, এই দুটি দলই ‘ইন্ডিয়া’ জোটের শরিক। ফলে এই ফল গেরুয়া শিবিরের বেহাল দশা আরও স্পষ্ট করল। চলতি বছরে ইতিমধ্যে কর্ণাটক ও হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা ভোটে হেরেছে বিজেপি। এবার লাদাখের স্বশাসিত পরিষদের ভোটেও তরী ডুবল। সামনেই পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন। পরের বছর মোদির অগ্নিপরীক্ষা লোকসভা ভোট।
আরও পড়ুন-৩৩ পল্লির মণ্ডপে মূর্তিতে ধরা পাহাড়ের কান্না
এমতাবস্থায় একের পর এক পরাজয়ে কার্যত দিশা হারিয়ে মোদি-অমিত শাহরা বারবার কৌশল বদলে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছেন। সিবিআই ইডি কে নামিয়ে বাজিমাত করার চেষ্টা করছেন। বিভেদের বীজ বুনছেন। ওদিকে নির্বাচনী ফলাফল স্পষ্ট করছে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়ছে, পায়ের নীচের মাটি সরছে গেরুয়া শিবিরের। মানুষ বুঝে ফেলেছে আর একটু জোরে দড়ি ধরে টান মারলেই রাজা খানখান হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়বে, এ এক অনিবার্য সত্য।