প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেননি, তাঁকে ব্রিটিশ পুলিশ হত্যা করে

বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে যে-সকল তথ্য ও সংবাদ পাওয়া গেছে তার বিশ্লেষণে প্রফুল্লর আত্মহত্যার তত্ত্বটি সমর্থিত হয় না, বরং তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল এটাই নির্দেশিত হয়৷ লিখছেন দেবু পণ্ডিত

Must read

ডাকাবুকো যুবক প্রফুল্ল চাকী কি সত্যিই আত্মহত্যা করেছিলেন?
প্রচলিত ইতিহাস যা বলে, সেটি এরকম—
উল্লাসকর দত্তের বানানো বোমা নিয়ে প্রফুল্ল চাকী মুজফফরপুর যান। সেখানে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল কিংসফোর্ডের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন। ১৯০৮-এর ৩০ এপ্রিল সন্ধেয় তাঁকে হত্যা করার পরিকল্পনা করা হয়। ইউরোপিয়ান ক্লাবের প্রবেশদ্বারে তাঁরা কিংসফোর্ডের ঘোড়ার গাড়ির জন্য ওঁৎ পেতে থাকেন। একটি গাড়ি আসতে দেখে তারা বোমা নিক্ষেপ করেন। দুর্ভাগ্যক্রমে ওই গাড়িতে কিংসফোর্ড ছিলেন না, ছিলেন দুইজন ব্রিটিশ মহিলা। ব্যারিস্টার কেনেডির স্ত্রী ও কন্যা। তাঁরা মারা যান।

আরও পড়ুন-আরজি করের নিরাপত্তায় গঠন হল বিশেষ বাহিনী, দায়িত্ব নিয়ে কড়া পদক্ষেপ নতুন অধ্যক্ষের

প্রফুল্ল ও ক্ষুদিরাম তখনই ওই এলাকা ত্যাগ করেন। দু’জনে আলাদা পথে পালানোর সিদ্ধান্ত নেন। প্রফুল্ল ছদ্মবেশে ট্রেনে করে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা হন। ২ মে ট্রেনে নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক পুলিশ দারোগা সমস্তিপুর রেল স্টেশনের কাছে প্রফুল্লকে সন্দেহ করেন। মোকামা স্টেশনে পুলিশের মুখে পড়ে প্রফুল্ল পালাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোণঠাসা হয়ে পড়ে তিনি ধরা দেওয়ার বদলে আত্মাহুতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি নিজের মাথায় পিস্তল দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন।
এটা সত্যি নয়। এটা মিথ। এটা ইংরেজদের রটনা।

আরও পড়ুন-জঙ্গলমহলে হর্টিকালচার হাব তৈরির পরিকল্পনা নিল রাজ্য

আসল ঘটনা এরকম :
বোমা নিক্ষেপের পর ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল (তাঁরা তখনও জানেন না গাড়িটি কিংসফোর্ডের নয় এবং তিনিও সেখানে ছিলেন না) জুতো খুলে খালি পায়ে ধর্মশালার দিকে দৌড়ে পালাতে থাকেন৷ একটু পরেই তাঁরা আলাদা হয়ে যান৷ ক্ষুদিরাম রেল লাইন ধরে খানিকটা এগিয়ে সমস্তিপুর রোড ধরলেন, আর প্রফুল্ল অন্য পথ ধরলেন৷ আশেপাশের সম্ভাব্য সমস্ত স্টেশনের রাস্তা সিল করে দেওয়া হল৷ ১ মে ভোররাত ১টার সময় দশজন কনস্টেবল নিয়ে মোকামা স্টেশনের দিকে এসআই রামাধার শর্মা এগোতে থাকলেন এবং সন্দেহজনক স্টেশনগুলিতে দু’জন করে কনস্টেবল নামাতে থাকলেন৷ ওয়েনি স্টেশনে (এখন নাম ক্ষুদিরাম বোস পুশা স্টেশন) ফতে সিং এবং শিউপ্রসাদ এই দু’জন কনস্টেবল নেমেছিলেন৷ ইতিমধ্যে, পায়ে হেঁটে মজফ্ফরপুর থেকে ওয়েনি স্টেশনে (দূরত্ব ৩৯ কিমি) এসে পৌঁছলেন ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল সকাল ৮টা নাগাদ৷ ক্ষুধার্ত ক্লান্ত ক্ষুদিরাম স্টেশনের নিকটের এক দোকানের মুড়ি-জল খেতে গিয়ে ধরা পড়লেন কনস্টেবল দু’জনের হাতে৷ সেই মুহূর্তে প্রফুল্ল সেখানে না থাকায় তিনি তখনকার মতো বেঁচে গেলেন৷
প্রফুল্ল ক্ষুধাকাতর অবস্থায় হাঁটতে শুরু করলেন ১৩ কিলোমিটার দূরের সমস্তিপুরের দিকে৷ যখন পৌঁছলেন তখন দুপুর হয়ে গেছে৷ এক বাঙালি নতুন জামাকাপড়-জুতো দিয়ে রাত্রের ট্রেনে মোকামার টিকিট কেটে দেন৷ এদিকে সিংভূমের এক এসআই নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সময়ে স্টেশনে ছিলেন৷ প্ল্যাটফর্মে এক যুবকের পরনে নতুন জামাকাপড়, জুতো দেখে তাঁর কেমন সন্দেহ জাগে৷ গায়ে পড়ে ভাব জমালেন তিনি সেই যুবকের সঙ্গে এবং কিছুক্ষণ কথা বলে নন্দলালের আর কোনও সন্দেহ থাকে না, এই সেই অন্যতম যুবক যে বোমা ছুঁড়েছিল৷ সমস্তিপুর থেকে ট্রেনে উঠলেন প্রফুল্ল, তাঁকে অনুসরণ করে জনা তিনেক কনস্টেবল সঙ্গে নিয়ে নন্দলালও উঠলেন ট্রেনে৷ প্রফুল্ল আগেই বুঝে গিয়েছিলেন নন্দলাল তাঁকে অনুসরণ করছেন তাই তিনিও চেষ্টা করতে থাকেন নিজেকে আড়ালে রাখার৷ মোকামাঘাট স্টেশনে এসে প্রফুল্ল কলকাতায় আসার টিকিটি কিনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন৷ সেই সময়ে নন্দলাল, রামাধার শর্মা, শিবশঙ্কর, জামির আমেদ ও আরও কয়েক জন কনস্টেবল মিলে প্রফুল্লকে ধরার চেষ্টা করেন৷ ধরা পড়ে গিয়েছেন বুঝতে পেরে প্রফুল্ল দৌড়তে শুরু করেন৷ কিন্তু সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে এঁটে ওঠা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি৷ একেবারে শেষ পর্বে গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়৷ এখন প্রশ্ন হল, গুলি কে করেছিল? ব্রিটিশ পুলিশের বয়ানে লেখা হয়েছে, প্রফুল্ল নিজের দিকে বন্দুক তাক করে আত্মহত্যা করেছিলেন৷ কিন্তু পুলিশ রেকর্ডে রাখা তাঁর মৃতদেহের ছবি অন্য কথা বলে৷

আরও পড়ুন-কেজরি জেলে, স্বাধীনতা দিবসে পতাকা তোলার অনুমতি মিলল না অতিশির

প্রফুল্লর শরীরে যে-দু’টি গুলির ক্ষতস্থান দেখা যাচ্ছে, ফরেনসিক ও বিভিন্ন সমীক্ষার প্রেক্ষিতে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে খুবই বিরল ঘটনা বলে মনে করা যেতে পারে৷ কেননা, তিনি ডান-হাতি ছিলেন এবং ওই দু’টি স্থানে অর্থাত্ শরীরের বাঁ দিকে পিস্তলে নল ঘুরিয়ে নিজে-নিজে একটি নয় দু’টি গুলি করা রীতিমতো অসুবিধাজনক শুধু নয়, তা প্রায় অসম্ভবই৷ এছাড়া গুলির ক্ষতের আকৃতি এবং ব্যাস দেখে মনে হয় না এগুলি near contact অথবা contact shot-এর কারণে ঘটেছে, যা আত্মহত্যার ক্ষেত্রে সব সময় হয়ে থাকে৷ কালো রঙের ছাপও সেখানে অনুপস্থিত৷
তাঁর কাঁধে এক কনস্টেবল সজোরে লাঠির আঘাত করেছিল৷ শুধু একটিই? তা হলে নীচের ঠোঁটের গভীর ক্ষতের কারণ কী? কান-মুখ দিয়ে রক্ত বেরুনোর অস্পষ্ট দাগ? এসব অত্যধিক দৈহিক পীড়নের ফল ছাড়া আর কী হতে পারে?
দু’টি গুলির ক্ষতের স্থান বোঝাচ্ছে একজন বাঁ-হাতির পক্ষেই এই জায়গায় গুলি করে আত্মহত্যা করা সম্ভব৷ প্রফুল্ল স্বাভাবিক ডান-হাতি ছিলেন৷
vital organ-এ একাধিক গুলিতে আত্মহত্যার ঘটনা বিরল, কেননা প্রথমটির পরে শারীরিক ক্ষমতা তেমন আর থাকে না৷ অথচ প্রফুল্ল চাকীর vital organ ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছিল।
অতএব, প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেছিলেন প্রচলিত এই ‘অতিসরল’ কথাটি মেনে নিতে প্রবল আপত্তি রয়েছে৷ বরং হত্যার লক্ষণগুলিই এখানে প্রকট৷

Latest article