ভারতের প্রথম নাগরিক কে হবেন তা নির্ধারণের সময় উপস্থিত। ১৮ জুলাই রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন হবে। সবাই জানেন এই নির্বাচনে মতদাতা হলেন সাংসদ ও বিধায়করা। সব মিলিয়ে তাঁদের ভোটের মূল্য সাড়ে দশ লক্ষের কিছু বেশি। সাধারণ মতদাতারা এখানে ভোট দেন না। তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ভোট দেন।
ভোটের সংখ্যা, রাজনৈতিক সমীকরণ, বিজেপির কর্মকাণ্ড, বিরোধী নেতাদের বৈঠক এখন সারাদেশে আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু। প্রথমে বিজেপি ভেবেছিল সহজেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন তাদের পক্ষে করে নেবে। বিগত কয়েকদিন আগে রাজ্যসভার দ্বিবার্ষিক নির্বাচনের ফলাফল সঠিকভাবে বিজেপির পক্ষে যায়নি। প্রখ্যাত প্রচারমাধ্যম কর্তা সুভাষ চন্দ্রকে প্রার্থী করেও বিজেপি জেতাতে পারেনি। এবার রাজ্যসভায় বিজেপির সদস্যসংখ্যা বাড়ার বদলে কমে গেছে। ১০০ তো নয়ই। ৯৫ থেকেও সংখ্যাটা কমেছে বিজেপির। বরং কংগ্রেসের সদস্যসংখ্যা কয়েকটি বেড়েছে। বিজেপি অর্থের প্রলোভন, ইডি, সিবিআই লাগিয়েও নিজেদের প্রার্থী জেতাতে পারেনি। ফলে অঙ্কের হিসাব এখন হয়েছে খুবই চিত্তাকর্ষক। বিজেপি-বিরোধীর মোট ভোট এখন ২ শতাংশ বেশি। ১৮ হাজার ভোট নিজের শিবিরের বাইরে থেকে জোগাড় করতে হবে। বিজেপি মরিয়া হয়ে উঠেছে।
এরই মধ্যে ভারতের রাজনীতিতে বর্তমানে গুণগত পরিবর্তন এনেছে একটা চিঠি। যে চিঠিটা বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন দেশের অবিজেপি ২২ জন নেতাকে। বিষয়— আসুন, সবাই মিলে আলোচনা করে, বিজেপি-কে উচিত শিক্ষা দিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিরোধী প্রার্থী দিই। বিজেপির বিরুদ্ধে তিনি বরাবর যুদ্ধং দেহি। বারবার বলেছেন দেশ বাঁচাতে মোদি সরকারকে হঠাতে হবে। নিজের রাজ্যে তিনি বিজেপিকে ঠেকিয়ে তাঁর অপরিসীম যোগ্যতা প্রমাণ করে দিয়েছেন। তিনিই বলেছেন, ছোট-ছোট বিষয়ে মতপার্থক্য ভুলে জাতীয় স্তরে সবাই বিজেপির বিরুদ্ধে যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারেন তাহলে বিজেপিকে বড় ধাক্কা দেওয়া যাবে।
বিজেপি জানে সর্বভারতীয় স্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একজন অপ্রতিরোধ্য নেত্রী। তার সঙ্গে সিংহভাগ নেতা/নেত্রীর সম্পর্ক ভাল। অখিলেশ, কেজরিওয়াল, ফারুক আবদুল্লাহ, মেহবুবা, স্ট্যালিন। তা ছাড়া সোনিয়া গান্ধী তাঁকে ফোন করে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে উদ্যোগ নেবার কথা বলেছেন। শরদ পাওয়ারের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন একাধিকবার। তা ছাড়া নবীন পট্টনায়ক বা নীতীশ কুমারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ নয়। লালুপ্রসাদের সঙ্গে তাঁর বহুদিনের সুসম্পর্ক। এইরকম পরিস্থিতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিরোধী প্রার্থী ঠিক করার উদ্যোগ নিয়েছেন, তখন কপালে প্রথম ভাঁজ পড়েছে বিজেপির। কিন্তু বিজেপির খেলা অন্য। মাঠে নেমে সরাসরি খেলাতে শক্তি পরীক্ষা করার সাহস তাদের নেই। বরাবর মাঠের বাইরে, অথবা গোপনে খেলতে তারা পছন্দ করে। এবং সেটা করে দু’টি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই ও ইডিকে দিয়ে। এখনকার প্রধানমন্ত্রী যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন এই দু’টি সংস্থাকে উঠতে-বসতে গালাগালি করতেন। এখন ভোল পুরো পাল্টে গেছে। এই দু’টো সংস্থাকে দিয়ে বিরোধীদের জব্দ (!) করার ঘৃণ্য মতলব করছেন তিনি। ইতিমধ্যে এক বা একাধিকবার ফারুক আবদুল্লাহ থেকে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়— সবার ডাক পড়েছে অথবা তাঁদের বাড়ি ঘুরে গেছে সংস্থা দু’টি। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কর্মসূচিতে আগরতলায়। সেদিনই একদিনের নোটিশে তাঁর বাড়িতে ইডির আধিকারিকরা হাজির। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রীকে জেরা করার জন্য তাঁরা গেছেন।
আরও পড়ুন- ত্রিপুরায় গেরুয়া সন্ত্রাস! আক্রান্তদের দেখতে হাসপাতালে তৃণমূল নেতৃত্ব
আসলে বিজেপি ভয় পেয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তারা বরাবর ভয় করে। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে এখন ভয় পাচ্ছে। কারণ তারা জানে মানুষ আছে তাঁর সঙ্গে। প্রতিবাদে সেই মানুষ যে কোনও সময় রাস্তায় নামে। ভারতের রাজনীতিতে সাফল্যের মাপকাঠি এটাই। কার সঙ্গে মানুষ আছে। এটাতে তৃণমূল কংগ্রেস বহু পরীক্ষায় পাশ করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সেই দলেরই নেতা। সুতরাং তাদের ভয় পাবে বিজেপি সে-ব্যাপারে বাড়তি কথা বলার কোনও মানে হয় না।
ষোড়শ রাষ্ট্রপতির দিকে তাকিয়ে আছে দেশ। সব ঠিক ছিল। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোলটেবিল বৈঠক বিজেপির রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। সমস্ত বিরোধী প্রধান নেতা এই বৈঠকে যোগ দিয়েছেন। অনেক দোদুল্যমানতা দেখিয়ে, (যেটা তাঁদের সহজাত) বামপন্থী নেতারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা সভাতে যোগ দিয়েছেন। কংগ্রেসের, সমাজবাদী পার্টির প্রধান নেতারা এসেছেন। অখিলেশ যাদব বরাবর বলে আসছেন মমতাদি যাঁকে প্রার্থী করবেন তিনি ও তাঁর দল তাঁকেই সমর্থন করবেন। বিরোধীরা এমন বড় সংখ্যায় বহুদিন মিলিত হননি। যা এবার হলেন। বিজেপির চাপ বাড়তে বাধ্য।
আরও পড়ুন- ‘ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা উচিত নয়’ দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিয়ে বার্তা মুখ্য়মন্ত্রীর
নীতীশ কুমার আরও খানিকটা চাপ বাড়িয়েছেন। অমিত শাহের ইতিহাসচর্চা তিনি পছন্দ করেননি। তিনি সঠিক কথা বলেছেন— ইতিহাস ইতিহাসই হয়ে গেছে। তাকে পাল্টানো যায় না। বিজেপি ইতিহাস পাল্টানোর খেলায় মেতেছে। এমন অবস্থায় বিরোধীদের মহাসম্মেলন এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। চাপের মুখে বিজেপি।
রাজ্যসভায় গত দ্বিবার্ষিক নির্বাচনে তদন্তকারী সংস্থাগুলোকে নগ্নভাবে কাজে লাগিয়েও সর্বাংশে সফল হয়নি বিজেপি। কিন্তু এবার তারা আটঘাট বেঁধে নেমেছে। যেমন করে হোক সাংসদ ও বিধায়কদের ভোট আদায় করতে হবে। দেশ জুড়ে সিবিআই ও ইডির দাপাদাপি আরও বাড়বে বুঝতেই পারা যাচ্ছে। সম্প্রতি কলকাতা ও দিল্লিতে তাদের কার্যকলাপ দেখে সেটাই বোঝা যাচ্ছে। মানুষ কিন্তু অন্য রাস্তা ধরছে। বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানির দামবৃদ্ধিতে দেশবাসী দিশেহারা। তারা রাস্তায় নামছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন একটি ঘটনা। বিরোধীরা আরও ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন। নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— যিনি লড়াই-এর অপর নাম। তিনি অকুতোভয়।