আলসারেটিভ কোলাইটিস
অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং অসংযমী খাদ্যাভ্যাস সঙ্গে নানা কারণে শরীরে বাসা বাঁধে নানান রোগ যার মধ্যে অন্যতম হল কোলাইটিস। এই রোগ জীবন তছনছ করে দিতে পারে। কোলন বা বৃহদন্ত্রের ভিতরে জ্বালাভাব বা ফুলে যাওয়া বা আলসার অর্থাৎ ঘা হলে কোলাইটিস দেখা দেয় একে ‘আলসারেটিভ কোলাইটিস’ও বলে। এই রোগকে পেটের সমস্যা ভেবে অনেকেই অবহেলা করেন। গ্যাস বা অ্যাসিডিটি হয়েছে মনে করেন। এখানেই বাধে বিপদ। সাধারণত জলঘটিত সংক্রমণের কারণে আলসারেটিভ কোলাইটিস হয়। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, এই রোগে শরীরের নিজের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাই অন্ত্রকে আক্রমণ করে। ফলে অন্ত্রে আলসার হয়। তাই সতর্ক থাকা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই বললেই চলে।
আলসারেটিভ কোলাইটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যাধি যা বৃহদন্ত্র অর্থাৎ লার্জ ইনটেস্টাইনকে আক্রমণ করে। বৃহদন্ত্রে প্রদাহ হয়ে অন্ত্রের মিউকাস মেমব্রেনে ক্ষত সৃষ্টি করে। ছোট ছোট আকারের ঘা হয় যা একে অন্যের সঙ্গে আটকে থাকে। এই রোগের উপসর্গ চেনা খুব মুশকিল তাই সতর্কতা জরুরি।
আরও পড়ুন-খুন-ধর্ষণে রেকর্ড সময়ে চার্জশিট, এসপিকে সংবর্ধনা ফরাক্কাবাসীর
ধরন
শরীরের কোন অংশে হয়েছে এবং রোগের মাত্রার উপর নির্ভর করে কোলাইটিসের বিভিন্ন ধরন হয়।
আলসারেটিভ প্রক্টাইটিস : রেক্টাম বা মলদ্বার পর্যন্তই সীমিত থাকে।
প্রক্টসিগময়েডাইটিস : রেক্টাম ও সিগময়েড আক্রান্ত হয়।
লেফট সাইডেড কোলাইটিস : বাঁ দিকের কোলনটি আক্রান্ত হয়।
প্যানকোলাইটিস এবং অ্যাকিউট সিভিয়ার আলসারেটিভ কোলাইটিস : দুটো ক্ষেত্রেই পুরো কোলনকেই আক্রান্ত করে।
এই রোগের কারণ
জিনগত বা পারিবারিক ইতিহাস।
অত্যধিক মানসিক দুশ্চিন্তা।
সংক্রমণজনিত কারণ।
গ্যাসট্রোএন্টেরাইটিসজনিত কারণ।
অনিয়ন্ত্রিত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়া।
কিছু নির্দিষ্ট গ্রুপের ওষুধ অত্যধিক গ্রহণ।
আরও পড়ুন-আসানসোলে জমি-মাফিয়াদের তাণ্ডব জেলাশাসককে চিঠি খোদ আইনমন্ত্রীর
উপসর্গ
আলসারেটিভ কোলাইটিসের প্রাথমিক উপসর্গ দেখলে অনেকেই বদহজম, অ্যাসিডিটি বলে ভুল করেন। ডায়ারিয়া হয়। মলের সঙ্গে রক্ত বা পুঁজ নির্গত হয়। স্বাভাবিক স্টুলেও রক্ত আসতে পারে। পেট ফেঁপে এবং শক্ত হয়ে থাকে। বমিভাব। ক্ষুধামান্দ্য হয়। ওজন কমে যায়। পেট ব্যথা হয়। মলত্যাগের জরুরি চাহিদা। মানসিক অবসাদ আসে।
গাঁটের ব্যথা। পেশিতে যন্ত্রণা। মুখের মধ্যে ঘা। চোখ জ্বালা, লাল- লাল ফুসকুড়ি বেরয় সারা শরীরে। কোলাইটিস গুরুতর হলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। জ্বর আসে। শরীরে ডিহাইড্রেশন হয় অর্থাৎ জলের ঘাটতি দেখা যায়। দ্রুত এবং অনিয়মিত হৃদ্স্পন্দন। দিনে ছবারের বেশি মলত্যাগ হলে সঙ্গে মলে রক্ত বেরলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।
পরীক্ষানিরীক্ষা
রোগী প্রথমে আসেন নানা উপসর্গ নিয়ে। সেই লক্ষণ দেখে চিকিৎসক টেস্ট দেন। কোলোনোস্কোপি ও বায়োপসি করতে দেওয়া হয়। এই দুই টেস্টের মাধ্যমে খুব সহজেই রোগ নির্ণয় করে ফেলা সম্ভব হয়।
চিকিৎসা
আলসারেটিভ কোলাইটিস রোগের কোনও চিকিৎসা নেই। এর নিরাময় সম্ভব নয়। কাজেই এই রোগের চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হল মানুষকে সচেতন করা এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলা। এই রোগের কিছু ওষুধ রয়েছে যা প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে তবে এইসব ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। তাই সবার আগে বিশেষজ্ঞ-পরামর্শ নিলে ভাল। এছাড়া আছে বায়োলজিক্যাল থেরাপি। এই থেরাপি অত্যন্ত আধুনিক। তবে রোগ খুব বাড়াবাড়ি পর্যায়ে গেলে আর এভাবে কাজ হয় না। তখন অন্ত্র অপারেশনের মাধ্যমে কেটে বাদ দিতে হয়।
আরও পড়ুন-শিল্পশহর হলদিয়ায় পর্যটন শিল্পের বিকাশে বড় পদক্ষেপ করছে পুরসভা
নিয়ন্ত্রিত ডায়েট
কোলাইটিস একবার ধরা পড়লে তারপর থেকে খাওয়াদাওয়ায় বড়সড় পরিবর্তন আনা জরুরি। ফাইবার এবং হাই-ফাইবার জাতীয় খাবার থেকে দূরে থাকতে হবে। এছাড়া ঝাল-মশলা না খাওয়াই ভাল। সহজপাচ্য খাবার খেতে হবে কোলাইটিসে অন্ত্রে প্রদাহের কারণে ডায়ারিয়া হয় তাই কফি এবং চা আলসারেটিভ কোলাইটিসের রোগীর খাওয়া উচিত নয় কারণ ক্যাফেইনযুক্ত খাবার মলত্যাগকে উদ্দীপিত করার কাজ করে।
ক্রোনস ডিজিজ
ক্রোন ডিজিজও একধরনের অন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগ। এটি আমাদের পাচনতন্ত্রের এক দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা। এটি মুখ থেকে শুরু করে মলদ্বার পর্যন্ত সব অংশকে প্রভাবিত করে। প্রথমে এই রোগ স্মল ইনটেস্টাইনকে প্রভাবিত করে তারপর লার্জ ইনটেস্টাইনকে।
উপসর্গ
ক্রন ডিজিজের উপসর্গও অনেকটাই কোলাইটিসের মতো। ডায়ারিয়া, জ্বর, ক্লান্তি, মলের সঙ্গে রক্ত, হজমের গোলমাল, ওজন কমে যাওয়া, পায়ুপথে ব্যথা, মলদ্বারে ফিসচুলা হয়।
চোখ, গাঁট ও চামড়ায় প্রদাহ। হেপাটিক এবং পিত্তনালিতে প্রদাহ।
কারণ
বংশগত কারণে হয় এই রোগ। পরিবেশের প্রভাব যেমন শহুরে মানুষদের বেশি হয়।
ফ্যাট সমৃদ্ধ, পরিশোধিত খাবার খেলে এই রোগের সম্ভাবনা বেশি হয়।
শরীরে রোগ প্রতিরোধ শক্তি পাচকনালির কোষগুলোকে আক্রমণ করে। ডায়েট এবং স্ট্রেস ক্রোনস ডিজিজ বাড়িয়ে দেয়।
ধরন
ইলিওকোলাইটিস : ক্ষুদ্রান্ত বা স্মল ইন্টেস্টাইনের শেষ প্রান্ত অর্থাৎ ইলিয়ামের শেষ এবং কোলনকে আক্রান্ত করে।
ইলিআইটিস : শুধু ইলিয়ামকে আক্রান্ত করে
গ্যাসট্রোডুওডেনাল ক্রনস ডিজিজ : পাকস্থলি এবং ক্ষুদ্রান্ত বা স্মল ইন্টেস্টাইনের প্রথম দিক অর্থাৎ ডিউডেনামকে আক্রান্ত করে
জেজুনোইলাইটিস : ক্ষুদ্রান্ত বা স্মল ইন্টেস্টাইনের উপরের অর্ধাংশ অর্থাৎ জেজুনাম আক্রান্ত করে
গ্র্যানুলোমাটাস কোলাইটিস : বৃহদান্ত্র অথাৎ কোলনকে আক্রান্ত করে।
আরও পড়ুন-ইডেনে স্ট্যান্ড, ঝুলন বললেন স্বপ্নেও ভাবিনি
পরীক্ষানিরীক্ষা
কিছু বিশেষ এক্সরে রয়েছে যেটা করা হয়। কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি এনডোস্কপি, এমআরআই ইত্যাদি টেস্ট রয়েছে। চিকিৎসক রোগীর উপসর্গ বুঝে পরীক্ষা করতে বলেন।
প্রতিরোধে খাওয়াদাওয়া
প্রাণিজ খাদ্য কমিয়ে উদ্ভিজ্জ খাদ্য খাওয়ার অভ্যাস করুন। ধূমপান এবং মদ্যপানের অভ্যাস ত্যাগ করুন। রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তোলার জন্য নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করুন। গবেষণায় দেখা গেছে শিল্পাঞ্চলের আশেপাশে ক্রোন রোগ বেশি হয়। তাই, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা দরকার। নন স্টেরয়েডাল অ্যান্টি ইনফ্লামেটরি ওষুধ ক্রোন রোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
চিকিৎসা
রোগীর উপসর্গ বুঝে চিকিৎসক ওষুধ প্রয়োগ করেন। ড্রাগ থেরাপি এবং অস্ত্রোপ্রচারের দরকার পড়ে রোগ গুরুতর হলে। এ ছাড়া খাদ্য এবং জীবনধারার পরিবর্তন ভীষণভাবেই জরুরি।