প্রতিবেদন : ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’— ভারত ভাবনার মূল সুর এটাই। ভারত সভ্যতার ইতিহাস অতি প্রাচীন। যুগে যুগে, বারেবারে বহির্ভারত থেকে বহু মানুষ ভারতে এসেছেন। কেউ চলে গেছেন, কেউ বা ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপন করে এই দেশেই থেকে গিয়েছেন। ফলে শিল্পকলা, ভাষা-সংস্কৃতির সংমিশ্রণ হয়েছে আমাদের দেশে নানা সময়ে। প্রাকৃতিক বৈচিত্রের পাশাপাশি জনবৈচিত্রে ভরপুর এই দেশ। কবির কথায়, ‘নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান’— আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে এক বহুত্বের দেশে পরিণত করেছে। তথাপি ভারতের একতার সুর চির প্রবহমান। যা কবির ভাষায়, ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।’ এই মিলন, এই একতাই, বহু বৈচিত্রের মধ্যে ভারতকে মহান করেছে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, গান্ধী-নেহরু-প্যাটেল-সুভাষের নেতৃত্বে এই ঐক্যকে আরও মজবুত করেছে।
ভারত ভাবনার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, অহিংসা, ন্যায় সর্বধর্মসমন্বয়, সত্য, সহিষ্ণুতা, বহুত্ব ও শান্তি। প্রতিটি কালান্তরে এই ভারত ভাবনাকে পৌঁছে দিয়েছেন মানুষের দ্বারে দ্বারে। আধুনিক যুগে এই ভাবনার বিস্তার হয়েছে বিশ্বজুড়ে। নারীরাও সেখানে এগিয়ে এসেছে।
১৯৪৭ সালে ভারত নামের যে রাষ্ট্রের জন্ম হল, তার আদর্শ ও প্রতিশ্রুতি ছিল এই ভারত ভাবনা। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, সাম্য, ন্যায়, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আধুনিক বিশ্বদর্শন। যে সব নীতির উপর ভিত্তি করে এদেশের নির্মাণ হল, আরএসএস – দর্শনের লোকেরা মোদি রাজত্বে সেই নির্মাণকে ওলটপালট করে চুরমার করে দিচ্ছে। বিজেপির পূর্বসূরিরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অত্যন্ত প্রান্তিক শক্তি ছিলেন। সাভারকরের মতো হিন্দুত্ববাদী নেতাদের কাছে দেশের স্বার্থের থেকেও নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থের বেশি গুরুত্ব ছিল। কট্টর মুসলিম নেতাদের ভূমিকাও ছিল তদ্রুপ। সেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ধারক ও প্রচারক আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী। তিনি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র, উদারতা, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়ের কথা প্রচার করেন না। তিনি জোর দেন রামমন্দিরে, জোর দেন সংবিধানের ৩৭০ ধারা তুলে দিয়ে একটি রাজ্যকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করে তিন তালাক বন্ধ করে। এই বিপরীত ভাবনায় তিনি সফল।
আরও পড়ুন : পদ্মবাহিনী ‘পদ্মশ্রী’র টোপ দেয় ব্যাপারীকে
আরএসএস-এর এককালের প্রচারক নরেন্দ্র মোদি ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে মুসলিম তোষণকারী বলে গাল দেন। সেক্যুলার শব্দটাই তাঁর কাছে প্রায় বর্জনীয়। নেহরু-আম্বেদকরের কাছে ভারত ছিল ‘কমপোজিট কালচার’ বা বহুত্বের দেশ। মোদি রাজত্বে সংখ্যালঘুবিদ্বেষী হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রভাবনার প্রাধান্য একটা বিরাট নেতিবাচক ফারাক তৈরি করে দিচ্ছে আগের ভাবনার সঙ্গে। মোদি জমানায় সংখ্যালঘু বিদ্বেষী, উগ্রজাতীয়তাবাদের পতাকা হাতে গেরুয়া পরিবার এমন একটা প্রজন্ম তৈরি করছে যারা ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করতে পারে (লিঞ্চিং) মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষকে। কখনও গো-মাংস, কখনও ‘লাভজিহাদ’, কখনও বা ধর্মান্তরকরণ ইত্যাদির নাম করে বহু হত্যা সংঘটিত হয়েছে গত সাত বছরে।
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে সাম্য ও সামাজিক ন্যায়ের যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, তা ছিল উদার চরিত্রের। সেই ভারতে যখন মোদি রাজত্বে ধারাবাহিকভাবে দলিত নির্যাতন চলে, গরিবদের বঞ্চনা করে ধনবানদের আরও ধনী করার প্রক্রিয়া প্রকাশ্যে চালানো হয়, সাম্যের অধিকার সেখানে বাতুলতায় পর্যবসিত হয়।
আসলে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠবাদ এবং অন্যদিকে কর্তৃত্ববাদের মিশ্রণে যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উত্থান তা ক্রমশই গণতান্ত্রিক ভাবনার বিপরীতে এক ধর্মাশ্রয়ী স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দিয়েছে। মোদির ‘নতুন ভারত’ এক অধোগতির ভারত, যেখানে গণতন্ত্র, সাম্য, ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে গলা টিপে মারা হচ্ছে। লক্ষ্য ভারতীয় গণতন্ত্রের পুনর্নিমাণের মাধ্যমে এক হিন্দু প্রজাতন্ত্র গড়ে তোলা। যেখানে সংখ্যালঘুরা হবেন নিজদেশে পরবাসী। জম্মু-কাশ্মীরে সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, ত্রিপুরা, অসম তার গবেষণাগার।
ফ্যাব ইন্ডিয়ার সম্প্রীতির বিজ্ঞাপনকে সংঘ পরিবারের লোকেরা হিন্দু উৎসব দীপাবলির ‘ইসলামিকরণ’ বলে দাগিয়ে দিয়ে সংস্থাটিকে বাধ্য করেছে বিজ্ঞাপনটি বাতিল করতে। ওই বিজ্ঞাপনে ছিল ‘জশন-এ রিয়াজ’— একটি উর্দু শব্দবন্ধ। তার অর্থ ‘ঐতিহ্যের উদযাপন’। উর্দুভাষীরা কি ফ্যাব ইন্ডিয়ার জামাকাপড় বা অন্যান্য সামগ্রী ব্যবহার করবেন না? উর্দু ভাষা তো সংবিধানে উল্লিখিত বাইশটি ভাষার তালিকাতে সগৌরবে উপস্থিত। এরকম অনেক ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। সংখ্যাগরিষ্ঠের আধিপত্যবাদ সমাজে সংখ্যালঘুর ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রবণতা সমাজে বড় ধরনের ফাটল ধরাচ্ছে। নাগরিকতা সংশোধনী আইনটিও ভয়ঙ্কর ভীতি সঞ্চারকারী।
বর্তমান সময়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সর্বত্র এক গা-জোয়ারি মনোভাবের রমরমা। সংঘবাহিনী সুসংগঠিত। আজ বিজ্ঞাপন বন্ধ হচ্ছে। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনাসভা বন্ধ করে ছাত্রছাত্রীদের পেটানো হয়েছে। পরশু সংখ্যালঘুদের উপর সমাজ পুলিশি আরও বাড়ানো হবে। বাধানো হবে আরও দাঙ্গা। আরও খুন, আরও রক্তপাত। মানুষকে বিভ্রান্ত করে আমাদের মধ্যেকার সহাবস্থানের সংস্কৃতি ও বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের শক্ত জমিকে এরা নষ্ট করে দেবে। বিবেক-বিবেচনা-বিচক্ষণতাহীন এক নজরদার বাহিনী গড়ে উঠছে গেরুয়া শিবিরের মদতে। যারা সংকীর্ণ ধর্মীয় রাজনীতির বিষ ছড়িয়ে সমাজকে বিষাক্ত করে তুলছে। গত ৭ বছরে আরএসএস অনেক শক্তিশালী হয়েছে। বেড়েছে তার আধিপত্য। এদের চিন্তার আধিপত্য বিস্তারলাভ করছে নতুন নতুন ক্ষেত্রে। গৈরিক চিন্তার আধিপত্য যাদের ‘অপর’ ভাবে তাদের উপরই আক্রমণ হানে। এদের এই চিন্তাভাবনা ও কর্মকাণ্ড ভারত ভাবনার সম্পূর্ণ বিপরীত ও বিপ্রতীপ।
ভারত হল, বৈচিত্রময় ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের দেশ। এই পরিসরটিকে বাঁচিয়ে রাখাটা খুবই জরুরি। নাগপুরের একরৈখিক ধারণার বাইরে বেঁচে থাকে ভারতের আত্মা। একথা ভুললে চলবে না। ভুলতে দেওয়াও চলবে না। এই সংগ্রামকে জারি রাখতে হবে। একমাত্র এই সংগ্রামই পারে ভারতকে রক্ষা করতে।