দেখতে না পেলেও গ্রিন হাউস যে আছে, এটা বিশ্বাস করতে এখন আর সন্দেহের অবকাশ নেই। এই বায়ুমণ্ডল নানারকম প্রয়োজনীয় ও অপ্রয়োজনীয় গ্যাসের ধূলিকণা নিয়ে গঠিত এবং সুবিশাল শামিয়ানার মতো আকাশে বিস্তারিত হয়ে আছে। তবে সব জায়গাতে, সব সময়ে একভাবে নেই। যেমন কলকাতার মাথার ওপর ঝকঝকে নীল আকাশ দেখা যায় না বললেই চলে। আবার দার্জিলিং পাহাড়ের ওপর বৃষ্টির পর, দিনের বেলায় ঝকঝকে নীল আকাশ কখনও কখনও দেখা যায়। বস্তুত বিষুবরেখার দু’পাশে যেখানে সূর্যের বিচরণকাল বেশি, সেখানে প্রচুর জলীয় বাষ্পের জন্য দিনের বেলায় নীল আকাশের দেখা পাওয়া ভার। বায়ুমণ্ডলে অধিক জলীয় বাষ্প, শারীরিক ভাবে অস্বস্তিকর এবং ঝড়-ঝঞ্ঝার কারণ হলেও এর প্রয়োজনিয়তা সুদূরপ্রসারী। উল্কাপাত, আগ্নেয়গিরি ছাড়াও শিল্প ও জন-জীবনে অগ্রগতির জন্য প্রচুর পরিমাণে কয়লা, পেট্রোলিয়াম জ্বালানি ও রাসায়নিকের ব্যবহার নানারকম গ্রিন হাউস গ্যাস উৎপন্ন করে। এই গ্রিন হাউস গ্যাসের প্রভাবে সূর্যের যতটা তাপ পৃথিবীতে আসে ততটা তাপ পৃথিবী থেকে বেরিয়ে যেতে পারে না। পৃথিবী তাই দিন দিন গরম হচ্ছে। এটাকেই বলে বিশ্ব উষ্ণায়ন বা গ্লোবাল ওয়ার্মিং।
আরও পড়ুন-খুনির পরিচয় একই, ফের খুন করা হল গান্ধীজিকে
কেন বিশ্ব উষ্ণায়ন বেড়েই চলেছে
শিল্প উন্নয়ন: শিল্পে একটি কথা আছে, উৎপাদন হবে চাহিদার বর্গানুপাতিক হারে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রায় সমস্ত শিল্প উৎপাদনে তাপের প্রয়োজন এবং বলাবাহুল্য বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউস গ্যাসের সংযোজন। আর মানুষের চাহিদা অসীম। আবার চাহিদা মোটামুটি দুই প্রকার। অপরিহার্য চাহিদা ও প্রাচুর্যের চাহিদা। অপরিহার্য চাহিদা অনিবার্য, এর ওপর সীমিতকরণ অমানবিক ও অন্যায় হতে পারে। কিন্তু প্রাচুর্যের চাহিদা মানুষকে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য করে দেয়। পরিবেশের সহনশীলতা অমান্য করে সাফল্য বড় হয়ে যায়। আর সাথে ক্রমাগত দাবানলের (ফরেস্ট ফায়ার) ঘটনা বায়ুমণ্ডলে প্রচুর গ্রিন হাউস গ্যাসের সরবরাহ করছে।
মিলাঞ্চবিক চক্র : এটি হচ্ছে ২৬ হাজার বছর পর পর পৃথিবীর উত্তর মেরু সূর্যের সাপেক্ষে একই দূরত্বে চলে আসে। অর্থাৎ ১৩ হাজার বছর পর উত্তর মেরু সূর্যের থেকে সবচাইতে দূরে থাকবে, আর পরবর্তী ১৩ হাজার বছর পর উত্তর মেরু আবার সূর্যের সব থেকে কাছে আসবে। একেই বলে মিলাঞ্চবিক চক্র বা মিলাঞ্চবিক ফোর্সইং। অর্থাৎ পৃথিবীর উত্তর মেরু দিক পরিবর্তন করে যখন পোলারিস বা ধ্রুবতারার কাছে আসে (বর্তমান অবস্থা) তখন সূর্য থেকে নিকটবর্তী অবস্থান, আবার যখন ১৩ হাজার বছর পর উত্তর মেরু উজ্জ্বল ভেগা তারার কাছে যাবে তখন সূর্য থেকে দূরবর্তী অবস্থান। অর্থাৎ বর্তমান অবস্থায় সূর্যের নিকটবর্তী হওয়াতে একদিকে যেমন সূর্যের তাপ বেশি আসছে তেমনি পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যে আকর্ষণ বল ও ভীষণ ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিন হাউস গ্যাস বেশি হওয়াতে বিশ্ব উস্নায়ান বাড়ছে। আবার উল্লিখিত আকর্ষণ বল বেড়ে যাওয়াতে, ভূমিকম্পের টেকটোনিক তথ্যের মান্যতা দিয়ে বলা যায় অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবী আরও ভূকম্পপ্রবণ ও অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা বাড়বে। তাৎপর্যপূর্ণভাবে সম্প্রতি আফ্রিকা মহাদেশের ইথিওপিয়ার হেলে গুবি (HELE GUBBI ) আগ্নেয়গিরি ১২ হাজার বছর পর জেগে ওঠা, ১০ থেকে ১৫ কিমি উচ্চতায় বায়ুপ্রবাহের সাহায্য ভারতের, বিশেষ করে কলকাতার শীতের বাধা হয়ে দাঁড়াবার সম্ভবনা আছে।
সৌর কলঙ্ক : সৌরজগতে সূর্যই হচ্ছে সমস্ত শক্তি বা তাপের উৎস। সূর্যে প্রতিনিয়ত দুটি হালকা পরমাণুকে সংযুক্ত করে একটি ভারী পরমাণুতে পরিণত (ফিউশন রিঅ্যাকশন) হয়ে তাপ নির্গত করছে। নির্গত তাপ তড়িদাহত কণার বা তরঙ্গের মতো চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে। সূর্য থেকে নির্গত এই তাপ একই হারে সবসময় নির্গত হয় না। কারণ পৃথিবীর মতো সূর্যেরও চুম্বকত্ব আছে। প্রচণ্ড তাপে আয়ন কণাগুলি চুম্বক ক্ষেত্রে আটকে যায়, জায়গাটি কালো বিন্দুর মতো দেখায়, এর নাম সৌর কলঙ্ক (Sun spot ) বলে, আর ওখান থেকে অপেক্ষাকৃত কম তাপ নির্গত হয়। তবে এই ঘটনা প্রায় এগারো বছর বাদে বাদে ঘটে।
এল নিনো : পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের একটি মহাসুদ্রিক ঘটনা। দক্ষিণ আমেরিকার সুগভীর বিপদজনক পেরু-চিলি পরিখা বা খাদের কাছের একটি সমুদ্র সমতলের তাপমাত্রার তারতম্যের ঘটনা। এখনো পর্যন্ত কোনও অজানা ঘটনার কারণে পেরু-চিলি পরিখার তলদেশের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। তার ফলে তলদেশের গরম জল হালকা হয়ে ওপরে উঠে আসে। সমুদ্র সমতলের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এই ঘটনাকে এল নিনো বলে। সঙ্গে তলদেশের প্রোটিন সমৃদ্ধ প্রাণীজগৎ ও গাছপালা মরে গিয়ে ভেসে ওঠে। স্থানীয় মানুষজন ওই প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার সংগ্রহ করে। এই কারণে এই ঘটনাকে ক্রিস্ট-চাইল্ড বলে। এলনিনো ঘটনা ২ থেকে ৮ বছর বাদে বাদে ঘটে। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধি বায়ুমণ্ডলের পূর্ব-পশ্চিম উলম্ব চক্রাকার গতিকে প্রভাবিত করে ও গ্রিন হাউস গ্যাসের সহায়তায় বিশ্ব উষ্ণায়ন ঘটিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটায়। যেহেতু ঘটনাটি পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের প্রভাবে ঘটছে, তাই একে এনসো বলে। আবার বিপরীতভাবে, সমুদ্র তলের তাপমাত্রা কমে গেলে বলে LANINA।
আরও পড়ুন-বিএলএ-দের নিয়ে অভিষেক বৈঠক করবেন রাজ্য জুড়ে
এ-রাজ্যে গ্রিন হাউস গ্যাসের প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গের পূর্বদিকে চাকমা পর্বতমালা, উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা, পশ্চিমে ছোটনাগপুর মালভূমি এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর হওয়াতে উপকূলবর্তী অঞ্চল বাদে বায়ুর অনুভূমিক গতি খুব কম। অধিকাংশ জায়গা সমতলভূমি হওয়াতে বায়ুর উলম্ব গতিও খুব কম। তাই একবার দূষিত গ্রিন হাউস গ্যাস এসে পড়লে সেটি বিলীন হওয়ার সম্ভবনাও খুব কম। তাই বছরের তিন-চার মাস বাদ দিয়ে বেশির ভাগ সময় অস্বস্তিকর গরম। আর্দ্রতা ও ধূলিকণার ছাঁদনাতলা, কলকাতার শীতের ভাঁড়ে মা ভবানীর কারণ।

