স্কুল থেকে ফিরেই কি আপনার শিশুটি বলছে চোখে (eye health) ব্যথা? ক্লাসে থাকাকালীন সে কি বোর্ডে টিচারের দেওয়া লেখা খাতায় লিখে আনতে পারছে না? সারাক্ষণ মোবাইল বা ভিডিও গেম খেলছে? প্রবল আসক্তি? এখন ঘরে ঘরে স্মার্ট টিভি, স্মার্টফোন, বিশেষ করে বাচ্চা-কাচ্চাদের মনোরঞ্জনের হরেক সাধন। মাঠে-ঘাটে জলকাদায় খেলাধুলো আর কোথায়! যখন স্মার্টফোন ছিল নিছক কল্পনা। এখন আট থেকে আশি মুঠোফোনে বন্দি। আর মুঠোফোন ব্যাপক আকারে ক্ষতি করেছে শিশুদের।
সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বের যতজন শিশু দৃষ্টিজনিত (eye health) ত্রুটিতে ভুগছে, করোনা-পরবর্তীতে সেই সংখ্যা প্রায় ২৫% শতাংশ বেড়ে গেছে। তার প্রধান কারণ হল, করোনাকালে গৃহবন্দি থাকায় মোবাইল ফোনই হয়ে উঠেছিল শিশুর বন্ধু, তাদের আনন্দের আর কোনও রসদ ছিল না। ফলে এই সময় তাদের স্ক্রিন টাইম দ্বিগুণ হয়েছে। আরও একটি গবেষণা বলছে, বিশ্বে প্রতি ৫০ জন শিশুর মধ্যে একজন শিশু অ্যাম্বলিওপিয়া রোগে আক্রান্ত। সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছর অগাস্ট মাসে পালিত হয় শিশুদের চোখের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও সচেতনতা মাস কারণ একটি শিশুই হল আগামীর কান্ডারি।
শিশুর চোখের বিভিন্ন সমস্যা
নবজাতক জন্মের পর শুধু আলো আর অন্ধকারের তফাত করতে পারে। সাধারণত ৬-৮ সপ্তাহের মধ্যে সে ভাল ভাবে দেখতে পায়। সমস্যা থাকলে তিন মাসের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। এর ব্যতিক্রম ঘটলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। এছাড়া শিশুর বয়স চার বছর হলেই তার চোখের নিয়মিত পরীক্ষা জরুরি।
যদি অ্যাম্বলিওপিয়া, গ্লুকোমার মতো কিছু রোগ থাকে বুঝতে হবে এগুলো বংশগত। পরিবারে আগে কারও চোখের সমস্যা থেকে থাকে তাহলে আগে থেকেই স্ক্রিনিং শুরু করুন এবং লক্ষণগুলি সম্পর্কে সচেতন হন।
শুষ্ক চোখ : এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ল্যাক্রিমাল ফ্লুইড (lacrimal fluid) তৈরি না হলে এই রোগ হয়, যা চোখের শুষ্কতা ও অস্বস্তির কারণ হতে পারে।
ছানি : ছোটদের ছানি যাকে শৈশবের ছানিও বলে। চোখের লেন্স ঘোলা বা মেঘলা হয়ে যাওয়া। এটা শিশুর অন্ধত্বের কারণও হতে পারে।
অ্যাম্বলিওপিয়া : এটিকে অলস চোখও বলা হয়, এক্ষেত্রে একটা চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয় না।
স্ট্র্যাবিসমাস : ক্রসড আই, যাকে স্ট্র্যাবিসমাসও বলা হয়, এক্ষেত্রে দুটো চোখ সঠিকভাবে সারিবদ্ধ হয় না এবং ভিন্ন দিকে দৃষ্টি চলে যায়। কিছু শিশু এই রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।
কনজাংটিভাইটিস : এক্ষেত্রে চোখের রং লাল হয় এবং চোখ চুলকায়। চোখে জল পড়ে। এটি মূলত ভাইরাস এবং ব্যাক্টেরিয়াজনিত রোগ যা ছোঁয়াচে।
অঞ্জনি : অঞ্জনি সাধারণত স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াস (Staphylococcus aureus) নামের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে হয়। এর ফলে চোখের পাতায় গুটির মতো দানা ওঠে। এতে চোখে ব্যথা হয় এবং পুঁজও হয়।
অশ্রুগ্রন্থি বন্ধ : চোখের অশ্রুগ্রন্থি বন্ধ হয়ে থাকা শিশুর চোখের একটি বড় ধরনের সমস্যা। কিছু শিশু এই ভাবেই ভূমিষ্ঠ হয়। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চোখের কিছু মাসাজ রয়েছে যা বন্ধ অশ্রুগ্রন্থি খুলতে সাহায্য করে।
রাতকানা রোগ : ভিটামিন এ-র অভাবে এই রোগ হয়, যা শিশুদের রাতের বেলায় দেখতে অসুবিধা সৃষ্টি করে।
মায়োপিয়া : শিশুদের মধ্যে মায়োপিয়া বা ক্ষীণ দৃষ্টি একটি সাধারণ সমস্যা, যা চশমা বা কন্টাক্ট লেন্সের মাধ্যমে সংশোধন করা যায়।
সিলিন্ড্রিক্যাল পাওয়ার : এটি চোখের আকারের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি সমস্যা, যেখানে অক্ষরগুলো বিকৃত দেখায়। শিশু বয়সেই আসতে পারে এই পাওয়ার।
এছাড়া চোখের পাতা না খোলা শিশুর চোখের একটি সাধারণ সমস্যা। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে চোখের মণি ঠিক জায়গায় থাকে না। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
আরও পড়ুন-অমিত মূর্খের অমেয় পণ্ডিতি, বিজেপি বাংলা থেকে দূর হটো
শিশুর চোখ সুরক্ষিত রাখতে
কম বয়স থেকেই শিশুর নিয়মিত চোখ (eye health) পরীক্ষা করা দরকার। ছ’মাস বয়সে বাচ্চাকে প্রথম চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এরপর প্রতি বছর পুনরাবৃত্তি করুন : ৬ মাস পর, ৩ বছর পর, স্কুলের আগে এবং তারপর বছরে একবার এইভাবে। শুরুতেই শনাক্ত হলে দৃষ্টির সমস্যা প্রতিরোধ করে।
অনেক অভিভাবকই আছেন ল্যাপটপ বা মোবাইলে কার্টুন বা অন্য কিছু চালিয়ে শিশুদের শান্ত রাখার চেষ্টা করেন। এভাবে দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার বা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকলে তাদের চোখের উপর চাপ পড়ে। চিকিৎসকেরা বলছেন, চোখের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়লে দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে যায়।
এই একই কারণে চোখ লাল হয় কিংবা কখনও কখনও চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ে। অনেক সময়ই বাচ্চা দূরের জিনিস দেখতে পায় না। কিন্তু বাবা-মা সেটা বোঝেন না। শিশুর যদি মাথাব্যথা করে তবে দূরের জিনিস দেখতে অসুবিধে হচ্ছে কি না জানতে চান, প্রয়োজনে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। স্ক্রিন টাইম না রেখে বাইরে শিশুর খেলাধুলো অভ্যেস করুন।
ভিটামিন এ, সি, ই, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, লুটেইন এবং জ়িঙ্ক চোখের জন্য ভাল। শিশুদের খাদ্যতালিকায় এই উপাদানে সমৃদ্ধ খাবার রাখুন, যেমন— গাজর, লেবু, স্ট্রবেরি, বেলপেপার, সামুদ্রিক মাছ, ডিম, দুগ্ধজাত দ্রব্য ইত্যাদি।
সঠিক স্ক্রিন টাইম এবং ঘুম সময়মতো করানোর অভ্যাস করুন। স্ক্রিনে নীল আলোর ফিল্টার ব্যবহার করুন। দৃষ্টিশক্তি রক্ষা করার জন্য স্ক্রিনের সময়সীমা নির্ধারণ করুন, ঘুম যেন পর্যাপ্ত হয়।
প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই চোখ ভাল করে পরিষ্কার করতে হবে। চোখে অযথা হাত দেওয়া, চোখ কচলালে সমস্যা বাড়বে।
খেলার সময় শিশুর চোখ সুরক্ষিত রাখতে পাওয়ার লেস চশমা এবং ১০০% ইউভি প্রোটেক্টেড সানগ্লাস দিন।
খেলার ছলে শিশুকে চোখের ব্যায়াম করতে শেখান। বারবার চোখের পাতা ফেলা ভাল। এতে চোখ শুষ্ক হয় না, চোখের মণি ঘোরানো, দু’হাতের পাতা ঘষে গরম করে সেই ভাপ চোখে নেওয়া কিংবা একবার দূরের জিনিস দেখা, আবার পরক্ষণেই কাছের জিনিস দেখা ইত্যাদি ব্যায়ামে চোখের পেশি মজবুত হয়।