প্রতিবাদ হোক নৈরাজ্য নয়

পশ্চিমবঙ্গ মা মাটি মানুষের সরকারের সুশাসনে নারী সুরক্ষার পীঠস্থান রূপে স্বীকৃত। একই সঙ্গে এই রাজ্যের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস দৃষ্টান্ত স্বরূপ। সেই বাংলাকে কালিমালিপ্ত করার কোনও চক্রান্ত আমরা সফল হতে দিচ্ছি না, দেব না। আজ প্রথম পর্বে আমাদের সকলের মনের কথা লিখলেন অধ্যাপক ড. প্রদীপ্ত মুখোপাধ্যায়

Must read

ভারত এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে আজ অবধি কোনও সামরিক অভ্যুত্থান বা রক্তক্ষয়ী বিপ্লব বা গরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়নি। শাসকের অন্যায় অবিচারের বিরোধিতা বা গুণগান ভারতবাসীগণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার তথা ভোটাধিকার তৎসহ বাক-স্বাধীনতার ও অন্যান্য স্বাধীনতা ও অধিকারের সাংবিধানিক এক্তিয়ারের মধ্যে থেকেই করে গিয়েছে। তার মূল কারণ ভারতবাসীর ঐতিহ্য ও পরম্পরা। ভারতের সাংস্কৃতিক ও পরিচয় বিভিন্নতা তথা বহুসংস্কৃতিবাদ এবং নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধানের যে চলমানতাকে লালন পালন করার সক্ষমতা।

আরও পড়ুন-ধর্ষণ রুখতে বিধানসভায় আসছে কঠোর বিল, আজ শুরু বিশেষ অধিবেশন

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে আরজি কর হাসপাতালে একটি নারকীয়, মর্মান্তিক, অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায় বিচারের দাবিতে এক শ্রেণির জুনিয়র ডাক্তার-সহ সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। যেখানে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ঘটনার পরদিনেই একটি বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমে টেলিফোন বার্তায় স্পষ্ট ভাবে জানান যে এই ঘটনায় তিনি একজন পরিবারের সদস্য হারিয়েছেন বলে মনে করছেন। সেখানে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন এবং তাঁদের দাবি যথার্থভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলেও তিনি অভিমত পোষণ করেন। রাজ্য সরকার সেইসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি মেনে নানাবিধ ব্যবস্থা নেওয়ার পরেও যেভাবে তাঁরা কর্মবিরতি সম্পাদন করছেন তাতে জনমানসে একটা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসছে যে একটি নির্মম ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ন্যায়ের দাবির জন্য তাঁদের আন্দোলন কোনওভাবে কোনও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছে না তো? কারণ গরিব মানুষেরা সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল।
উক্ত নারকীয় ঘটনার পরবর্তী কালে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে নানান ব্যবস্থা নেওয়া হয় যাতে আরজি করে স্থিতাবস্থা ফিরে আসে। কিন্তু সেখান থেকেই শুরু হয় অদ্ভুত এক সরকার বিরোধিতা। এই সরকার বিরোধিতার ক্ষেত্রে যে আন্দোলন সেখানে কিছু বেসরকারি স্থানে কর্মরত বা প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা ডাক্তারদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্ব পায়। বৈদ্যুতিন গণমাধ্যম রোজ সান্ধ্যকালীন ন্যায় পঞ্চায়েত বসিয়ে সরকারের বাপ-বাপান্ত তো করা শুরু করে। সেখানে একশ্রেণির অধ্যাপক, প্রাক্তন পুলিশ কর্তা, উকিল এবং ডাক্তার তথা সমাজের এলিট শ্রেণির প্রতিনিধিগণ পশ্চিমবঙ্গের শার্লক হোমস হিসেবে তদন্ত প্রক্রিয়ার নানান ঘাটতি ও সরকারের ভুল খোঁজার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। যার মূল উদ্দেশ্য মনে হয় ম্যানুফাকচারিং ডিসেন্ট তৈরি করা অর্থাৎ জনমানসে সরকার বিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা! এখানে আন্দোলনের যে স্বতঃস্ফূর্ততা তা লাইনচ্যুত হয় বলে উল্লেখ করা যায়।

আরও পড়ুন-অভিনব শিক্ষাদান, শিক্ষারত্ন পাচ্ছেন আরামবাগ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক

এক্ষেত্রে একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়। রিক্লেইম দা নাইট বা রাত দখলের অধিকারের নামে যে স্বতঃস্ফূর্ত নেতৃত্ববিহীন গণ আন্দোলন হয় সেখানে এই আন্দোলনের অন্যতম আহ্বায়কদের একজন গত বছর একই দিনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বপ্নের মৃত্যুর পর ক্যাম্পাসে সিসিটিভি লাগানোর চূড়ান্ত বিরোধিতা করে এবং বলে যে এতে তাদের গোপনীয়তা ভঙ্গ হতে পারে। মাথায় রাখতে হবে স্বপ্নের মৃত্যু কিন্তু ক্যাম্পাসের মধ্যেই এক শ্রেণির উন্নাসিক ছাত্রের অত্যাচার ও মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে হয়েছিল। সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে ক্যাম্পাসে নজরদারির জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত বিরোধিতা করে যে বা যারা আন্দোলন করেছিল তাদের বেশিরভাগই আজ নজরদারির কথা বলছে। তারা বলছে শিরদাঁড়া সোজা রাখার কথা কিন্তু স্বপ্নের মৃত্যুতে তাদের শিরদাঁড়া বড্ড কঠিন হয়ে গিয়েছিল! অন্যভাবে বলা যায় এই শিরদাঁড়া প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে সোজা হয় বা বেঁকে যায়। এ সত্ত্বেও একথা অস্বীকার করা যায় না যে উক্ত মর্মান্তিক, নারকীয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গবাসী যেভাবে স্বতঃস্ফূর্ত নেতৃত্ববিহীন আন্দোলনে নেমেছিলেন তা ২০১১ সালের পর গড়ে ওঠা পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এক অন্যতম রূপ বা বহিঃপ্রকাশ। এ ধরনের আন্দোলন ভারতের অন্য কোনও রাজ্যে সম্ভব নয়। তাইতো উন্নাও, হাথরাস, বদলাপুর হলেও সেখানে আন্দোলন অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায় না। কিছু ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে, যেমন ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগের প্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন, জনরোষ ও নেতৃত্বযুক্ত অভিযোগকারীদের আন্দোলন দেখা গেলেও সেখানে পুলিশের নির্যাতন ও দমন ভারতবাসীর সকলেরই জানা। তাই মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে যে গণতান্ত্রিক বাতাবরণ তৈরি হয়েছে তার স্থিতাবস্থার দায়িত্ব আমাদের সকলের।

আরও পড়ুন-সাবিরের পরিবারকে চাকরি, অভিষেকের সাহায্য ৩ লক্ষ

উল্লেখ্য, জুনিয়র ডাক্তারদের উপর সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাঁদের দীর্ঘকালীন কর্মবিরতি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার জন্য যথেষ্ট। জনমানসে তাই স্বাভাবিকভাবেই আর এক ধরনের প্রশ্ন উঠছে যে, যেসব বেসরকারি হাসপাতাল ব্যবসায়িকভাবে বাংলাদেশ থেকে আগত রোগীদের ওপর নির্ভরশীল; সেই সব হাসপাতালে বাংলাদেশের সমসাময়িক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রোগী আসা বন্ধ হওয়ায় এই কর্মবিরতিতে উসকানি দেওয়া তাদের চক্রান্ত নয় তো? কোথাও ব্যবসায়িক লাভের জন্য সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দেওয়ার চেষ্টা নয় তো? উত্তর সময় দেবে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট, মুখ্যমন্ত্রী এবং আপামর সাধারণ জনগণ ডাক্তারদের কর্মবিরতি প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে এসেছেন। যেটা মানবসেবার জন্য অত্যন্ত জরুরি। আমাদের কাছে ডাক্তাররা ভগবানের সমান তাই তাঁদের ওপর ভরসা রাখতেই হবে। তাঁরাই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতিতে সর্বদা দিশা দেখিয়েছেন এবং দেখাবেন।
(এরপর আগামিকাল)

Latest article