মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে জর্জরিত জনজীবন

এ-বছর বৃষ্টি যেন নাছোড়বান্দা। ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ চলছেই। একের পর এক নিম্নচাপ এবং ঘূর্ণাবর্ত। বন্ধের নামগন্ধ নেই। সকলেরই কপালে দুশ্চিন্তার ছাপ। কেন আবহাওয়ার এমন মুড! সামনেই দুর্গাপুজো। তবে কি মাটি হবে আনন্দ? কী হতে চলেছে আগামী পরিস্থিতি! পর্যালোচনায় বিশিষ্ট আবহাওয়াবিদ ড. রামকৃষ্ণ দত্ত

Must read

মৌসুমি বায়ু (Monsoon) বলতে প্রতি বছর ভারতের কেরল উপকণ্ঠে সাধারণত জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে দক্ষিণ-পশ্চিমি বায়ুপ্রবাহকে বলা হয়ে থাকে। এটি একটি আন্তঃরাজ্য, অন্তর্দেশীয়, অন্তর্মহাদেশীয় এবং অন্তর্গোলার্ধ ঘটনা। বস্তুত সূর্যের আপাত পৃথিবীর গোলার্ধ পরিক্রমার ওপর নির্ভরশীল। সুনির্দিষ্ট ভারতীয় উপমহাদেশে মৌসুমি বায়ুর জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্ব উপকূলে মাদাগাস্কার দ্বীপে একটি নিরবচ্ছিন্ন উচ্চচাপ যুক্ত অঞ্চল তৈরি হওয়া প্রয়োজন। অন্য বেশির ভাগ বছরে দক্ষিণ আমেরিকার পেরু অঞ্চলে সমুদ্রের তলদেশে তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে বায়ুমণ্ডলের উলম্ব গতি চক্রের (ওয়াকার সার্কুলেশন) ব্যাঘাত ঘটায়। এই ঘটনাকে এল নিনো বলে। এল নিনো ঘটনার পর্যায়কাল ২ থেকে ৮ বছর। ভারতীয় উপমহাদেশীয় আবহাওয়া তথা মৌসুমি বায়ুর ওপর এর ভয়ানক প্রভাব। এই বছর ভারত থেকে ১০ হাজার কিলোমিটার দূরে পেরু অঞ্চলে এল নিনো উৎপন্ন না হওয়ায়, ২০০০ কিলোমিটার দূরে মাদাগাস্কার থেকে মৌসুমি বায়ুর গতিপথে কোনও অসুবিধা সৃষ্টি হয়নি। এক কথায়, এল নিনোর অনুপস্থিতিতে এই বছরের মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি ভীষণভাবে বেড়েছে। এই অতিবৃষ্টি চলবে আগামী দিনেও। এবছর পুজোতেও এই বৃষ্টির সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এই অতিবৃষ্টির ফলে শহর বা গ্রামাঞ্চল, বিভিন্ন জায়গায় জলাশয় উৎপন্ন হয়ে জনজীবনে নানারকম সমস্যার সৃষ্টি করছে। যাতায়াতের অসুবিধা থেকে শুরু হয়ে জলবাহিত রোগ-জীবাণু সংক্রমণ— কিছুই বাদ পড়ছে না। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধানও সম্ভব হচ্ছে না। বিশেষ করে গ্রামে-গঞ্জে। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী থেকে সমস্ত ক্ষেত্রের মানুষ অবলীলায় সহ্য করছে। সমাধান প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু কেন? পশ্চিমবঙ্গের কথা যদি বলা হয় তাহলে কারণ প্রধানত তিনটি : ভৌগোলিক কারণ, সময়কাল ও পরিবেশের পরিবর্তন।

ভৌগোলিক কারণ
ভৌগোলিক কারণ হিসাবে বলতে গেলে প্রথম আসে আবহাওয়া। নদীমাতৃক পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পূর্বে সমুদ্র হওয়ায় আর্দ্রতা ভারতের অন্যান্য জায়গার থেকে অনেক বেশি। তাই কয়েকটি জেলা বাদ দিয়ে খরা হওয়ার সম্ভনা খুব কম। কাজেই প্রাকৃতিক ভাবে জল খুব ধীরে ধীরে বাষ্পে পরিণত হবে। যে কারণে জল ছেটানো বায়ু-ঠান্ডা করার যন্ত্র খুব একটা কাজে আসে না। ঘর ঠান্ডা করতে কম্প্রেসার যুক্ত যন্ত্রের প্রয়োজন। দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে আসা আর্দ্র সমুদ্র অথবা দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর (Monsoon) কারণে পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার বিভিন্ন পাহাড়-সংলগ্ন জায়গায় বৃষ্টিপাতের জল সমুদ্র সমতল থেকে নিচু সমতলের দিকে নেমে আসে। উদহারণ হিসাবে ঘাটাল জলসংকট। এই সংকট নিয়েই সমুদ্র সমতলের উচ্চতার কাছে নিউটউন, রাজারহাট শহরগুলি তৈরি হচ্ছে। এই সংকটে অদূর ভবিষতে বাংলাদেশের নদীগুলির অবদান নিউটউন, রাজারহাট সংলগ্ন জায়গায় আরও সংকটে ফেলে দেবে। জল-জমে-থাকা বাড়তে থাকবে।

আরও পড়ুন-জালে দেশরাজ, সফল পুলিশ

পরিবেশ দূষণ
পরিবেশ দূষণের কারণে মাটির জল শোষণ ক্ষমতা ভীষণ কমে গেছে। কারণ হিসাবে বলা যেতে পারে বায়ুতে (Monsoon) দূষিত ধূলিকণা বৃষ্টির আকারে মাটিতে জমে মাটির জল শোষণ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। শহর-গ্রাম সমস্ত জায়গায় ব্যাপক ভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। গ্রামে কৃষিক্ষেত্রে বেশি ফলনের জন্য রাসায়নিক সারের ব্যবহারে এই সমস্যা আরও ব্যাপক হয়েছে। শহরে অপরিকল্পিত অট্টালিকা ও রাস্তা তৈরির ফলে উন্মুক্ত মাটির দেখা মেলাই ভার হয়ে যাচ্ছে। কাজেই জল না হচ্ছে বাষ্পীয় তো না হচ্ছে শোষিত। জমা জায়গার জল জমেই থাকছে। এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে মাটির নিচে জলস্তরের উচ্চতার ওপর। মাটির নিচের পানীয় জলও পাম্পের সাহায্যে তোলার ফলে ক্রমশই জলস্তর, নলকূপের আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে। পানীয় জলসংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া মুশকিল। পুনরায় মাটির নিচে জল প্রবেশ করতে পারছে না। পরিভাষায় বলে, মাটির নিচের জল রিচার্জিং হচ্ছে না। এর পরিণাম মারাত্মক, কলকাতার মাটির নিচে গহ্বর তৈরি হচ্ছে। যে কোনও সময় ধস নামতে পারে। যে-কারণে কলকাতা ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় পরিণত হচ্ছে। এও দেখা যাচ্ছে এল নিনো নয়, এমন বছরগুলি, যেমন এই বছর, বৃষ্টিপাতের স্থায়িত্ব বেশিদিন ধরে হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাষ্পায়নের ক্ষমতা যেমন কমছে তেমনি মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে মাটির জল শোষণের পরিমাণ ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে। তাই ওই সময়গুলিতে জল জমে থাকার প্রবণতা বাড়ছে। আবার পরিকল্পিত রিচার্জিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় জলমগ্ন জায়গার জল দুর্যোগের মতো জর্জরিত করে দিচ্ছে। ঠিক একই ভাবে নদীর জল কলুষিত হয়ে মাটির শোষণ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে রিচার্জিং হতে দিচ্ছে না।

প্রতিকার
প্রদূষণ সৃষ্টি করতে পারে এমন সমস্ত ঘটনার ওপর সীমাবদ্ধতা আনতে হবে। প্রতিটি শহরের জনঘনত্ব, অট্টলিকা ঘনত্ব, মোটরযান ঘনত্বের ওপর সংশ্লিষ্ট রাজ্যের ওপর শুল্ক বসাতে হবে। প্রয়োজনে রাস্তার সম্প্রসারণ, নতুন শহর প্রণয়নের ওপর জোর দিতে হবে। পাকা বাড়ি তৈরির ক্ষেত্রে, বাড়ি তৈরির নকশাতে বৃষ্টির জল রিচার্জিং ব্যবস্থা আছে কি না ভালভাবে দেখতে হবে। তেমনি বৃষ্টির জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে সূর্যশক্তির ব্যবহারে বিনামূল্যে সহযোগিতা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মান্যতা বজায় রেখে, আন্তঃরাজ্য জনপ্রবাহের ওপর কেন্দ্রীয় অনুদান প্রচলন করতে হবে। অর্থাৎ ক রাজ্য থেকে খ রাজ্যে মানুষ বসবাস শুরু করলে, খ রাজ্যকে কেন্দ্রীয় অনুদান দিতে হবে। তেমনি, কৃষিকর্মে কীটনাশক থেকে শুরু করে রাসায়নিক সার ব্যবহারের দায়িত্ব রাজ্য সরকার অথবা কেন্দ্র সরকারকে নিতে হবে। জলযান ব্যবহারে আলাদা নজর দিতে হবে।

Latest article