রাজনৈতিক হত্যা?

পঞ্চম বৈদিকের প্রযোজনা। জঁ পল সার্ত্র-র 'লে ম্যাঁ সাল' অবলম্বনে 'রাজনৈতিক হত্যা?' রূপান্তর ও নির্দেশনায় অর্পিতা ঘোষ। কাল্পনিক দেশ ইলিথিয়ার প্রেক্ষাপটে নির্মিত নাটকটি এককথায় অনবদ্য। দেখে এসে লিখলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ফরাসি নাটককার-সাহিত্যিক জঁ পল সার্ত্র। তাঁর বিখ্যাত নাটক ‘লে ম্যাঁ সাল’ অবলম্বনে পঞ্চম বৈদিকের প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছে ‘রাজনৈতিক হত্যা?’ (Political assassination?) রূপান্তর ও নির্দেশনায় অর্পিতা ঘোষ। পঞ্চম বৈদিক এর আগে বেশকিছু ক্লাসিক উপহার দিয়েছে। নাটকটি নতুন সংযোজন। এককথায় মাস্টারপিস। কুড়ি বছর আগেও এই নাটক দর্শকদের সামনে এসেছে। শাঁওলী মিত্রের নির্দেশনায়। এবার মঞ্চস্থ হল নতুনভাবে।
আদর্শের জন্য একাকী মানুষের লড়াই। নাটককার দেখিয়েছেন, একজন ব্যক্তি যখন কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করেন, তখন তাঁর কাজ ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক উভয় উদ্দেশ্যেই চালিত হতে পারে। এটা অস্তিত্ববাদ ও নৈতিকতার একটি জটিল দিককে তুলে ধরে।
‘রাজনৈতিক হত্যা?’ (Political assassination?) ১৯৪০-এর দশকের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত, ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে কাল্পনিক দেশ ইলিথিয়ার প্রেক্ষাপটে নির্মিত একটি রাজনৈতিক নাটক। কাহিনি একজন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে। মূলত ফ্ল্যাশব্যাক আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেখানে খুনি বর্ণনা করেছেন, তিনি কীভাবে তাঁর লক্ষ্য পূরণ করেছিলেন। খুনির পরিচয় শুরু থেকেই প্রতিষ্ঠিত। তবে প্রশ্ন হল তাঁর উদ্দেশ্য রাজনৈতিক ছিল, নাকি ব্যক্তিগত? সুতরাং, কে এটা ঘটিয়েছেন সেটা নাটকটির মূল বিষয়বস্তু নয়, বরং কেন এটা ঘটানো হয়েছিল, সেটাই মূল বিষয়বস্তু।
নাটকটি দেখতে দেখতে বিস্ময় জেগেছে। এটা যে অভিনয়, বোঝা দুষ্কর হয়ে পড়ছিল মাঝেমধ্যেই। এতটাই একাত্ম হয়ে পড়ছিলাম। নিজেকেই মনে হচ্ছিল মঞ্চের একটি চরিত্র। যেন ঘটনার অংশ, কাহিনির অংশ।
কাহিনি জটিল। বাঁকবদল ঘটছিল বারবার। কে যে কোনদিকে, কার পক্ষে, বোঝা মুশকিল। ফেলা যাচ্ছিল না চোখের পলক। চুম্বক-টান এতটাই গভীর। শুরু থেকে শেষ, ফুটে উঠেছে দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব।
তরুণ ইউগো এই নাটকের প্রধান চরিত্র। রাজনীতি প্রিয় নায়ক তিনি। বুকে আগুন। অসীম সাহসী। স্পষ্টবাক। স্বপ্ন দেখেন। প্রকাশ করতে চান নিজেকে। আড়াল থেকে আলোয় আসতে চান। বিশ্বাসভাজন হতে চান রাজনৈতিক দলের উপরমহলের। তার জন্য যে কোনও রকমের ঝুঁকি নিতে তিনি প্রস্তুত। স্বেচ্ছায় একটি হত্যার দায়িত্ব তুলে নেন নিজের কাঁধে। এমন একজনকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হন, যিনি একজন দুঁদে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। নাম হোয়েডেরার। অদ্ভুত আকর্ষণক্ষমতা রয়েছে তাঁর। সবমিলিয়ে সত্য ও মিথ্যার দ্বন্দ্বে ইউগোর সঙ্গে ঘটে চলা নানা সদর্থক বা নঞর্থক ঘটনাপ্রবাহের আঁটোসাঁটো কাহিনি এই নাটক।
ইউগোর স্ত্রী জেসিকা। ঘরোয়া, মধ্যবিত্ত মানসিকতার তরুণী। সুন্দরী। নিজের রূপ নিয়ে যথেষ্ট সচেতন। কারণে অকারণে মাঝেমধ্যেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। শেষপর্যন্ত ফল হয় মারাত্মক। তাঁর চরিত্রে অনেকগুলো স্তর।
ইউগো চরিত্রে মনে রাখার মতো অভিনয় করেছেন অর্ণ মুখোপাধ্যায়। এই মুহূর্তে বাংলা রঙ্গমঞ্চে যাঁরা দাপিয়ে কাজ করছেন, অর্ণ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। অসম্ভব দৃঢ়তা তাঁর চোখেমুখে। স্পষ্ট উচ্চারণ। উপস্থাপনা সাবলীল। প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে কাজে লাগিয়েছেন দারুণভাবে। তাঁর ক্ষোভ দেখে ক্ষোভ জন্মায়, তাঁর কান্না দেখে কান্না। এই অভিনেতা লম্বা রেসের ঘোড়া। তাঁর থেকে চোখ সরানো কঠিন। অর্ণর বিপরীতে জেসিকা চরিত্রে অভিনয় করেছেন তূর্ণা দাস। দারুণ স্মার্ট। সাবলীল অভিনয়। প্রশংসনীয় কাজ করেছেন তিনিও।
নির্দেশনার পাশাপাশি দাপুটে রাজনৈতিক নেত্রী ওলগা-র চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন অর্পিতা ঘোষ। তাঁর চরিত্রে আলো-কালো দুটি দিকই রয়েছে। হোয়েডারার চরিত্রে দেখা গেছে বাবু দত্তরায়কে। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন দেবকমল মণ্ডল, অনির্বাণ রায়চৌধুরি, ইন্দ্রনীল গুপ্ত, অনীক ঘোষ, বিহান মণ্ডল, স্বরূপ সরকার, রাহুল মজুমদার, রোহন ঘোষ। প্রত্যেকের কাজ প্রশংসার দাবি রাখে। দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের আলোক পরিকল্পনা আশ্চর্য মায়াজাল সৃষ্টি করে। সবমিলিয়ে অনবদ্য প্রযোজনা। দেখার মতো। ২২ অগাস্ট অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ মঞ্চস্থ হয়েছে। আজ মঞ্চস্থ হবে মধুসূদন মঞ্চে।

আরও পড়ুন-মণ্ডপে নয় মোদির ছবি, দিল্লির পুজো কমিটিগুলির গণবিদ্রোহ

Latest article