ভারতীয় বিমানবন্দরে তুর্কি সংস্থার উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন

উচ্চ-নিরাপত্তা অঞ্চলে এমন একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জোরালো উপস্থিতি এবং এর কর্মীদের তুর্কি সংযোগ— এগুলো পরোক্ষ নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে

Must read

প্রতিবেদন: সাম্প্রতিক ভারত-পাক সামরিক উত্তেজনার আবহে একদিকে যখন তুরস্কের পক্ষ থেকে সরাসরি পাকিস্তানকে সমর্থন জানিয়ে প্রচুর ড্রোন ও বিশেষজ্ঞ অপারেটর সরবরাহ করা হচ্ছে, তখন তুরস্কেরই এক সংস্থা ভারতের গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দরে উচ্চ-নিরাপত্তা সংক্রান্ত কাজের দায়িত্বে! পহেলগাঁও কাণ্ডের পর পাকিস্তানের কট্টর সমর্থক ও সামরিক সহায়তা প্রদানকারী দেশের সঙ্গে ভারত গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দর সুরক্ষার বিষয়ে কীভাবে যোগাযোগ রাখছে তা নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। পাকবন্ধু তুরস্কের বিষয়ে ভারতের অবস্থান ভারতীয় নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মধ্যেও গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর অংশ হিসেবে গত ৭ মে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের জঙ্গিঘাঁটিতে হামলার পর ভারতীয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা লক্ষ্য করে পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে পাকিস্তান। এই সময়েই তুরস্ক তাদের সামরিক সহযোগিতা বাড়িয়ে পাকিস্তানকে শুধু ড্রোনই সরবরাহ করেনি, সেই ড্রোন পরিচালনার জন্য দক্ষ অপারেটরও পাঠিয়েছে। এমন পদক্ষেপ স্পষ্টভাবে তুরস্কের পক্ষপাতদুষ্ট ভূমিকাকে তুলে ধরে, যা কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের অবস্থানকেই সমর্থন করছে। এই প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে নজরে এসেছে তুরস্ক-ভিত্তিক সংস্থা চেলেবি এভিয়েশনের ভূমিকা। দিল্লি, মুম্বই, চেন্নাই-সহ ভারতের আটটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তুর্কি সংস্থা চেলেবি যে ধরনের কাজ করে— যেমন গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং, কার্গো ম্যানেজমেন্ট, এয়ার সাইড অপারেশনস— সেগুলি সরাসরি বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কাঠামোর অংশ। কর্মীরা যখন এয়ারসাইড অঞ্চলে ঢোকে, যেখানে বিমান পার্কিং, জ্বালানি ভরানো এবং কার্গো লোডিং-আনলোডিং চলে। এইসব এলাকায় কাজ করতে হলে বিসিএএস অনুমোদিত এয়ারপোর্ট এন্ট্রি পাস (এইপি) এবং কঠোর ব্যাকগ্রাউন্ড চেকিং বাধ্যতামূলক। ভারতের ৭,৮০০ জন কর্মী নিয়ে তুরস্কের চেলেবি বছরে ৫৮,০০০-এরও বেশি ফ্লাইট এবং ৫,৪০,০০০ টন কার্গো পরিচালনা করে। ইন্ডিগো, এয়ার ইন্ডিয়া-সহ একাধিক ভারতীয় বিমান সংস্থা তাদের পরিষেবা ব্যবহার করে। ২০০৮ সালে মুম্বই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যৌথ উদ্যোগের মাধ্যমে ভারতে প্রবেশের পর তুর্কি সংস্থা চেলেবি দিল্লি, হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, কোচি, কান্নুর, গোয়া ও আহমেদাবাদেও বিস্তার লাভ করেছে। এই সংস্থার প্রকৃত মালিকানা এবং বিদেশি সংযোগ নিয়ে এই মুহূর্তে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশেষত এমন সময়ে যখন তুরস্ক প্রকাশ্যে ভারতের নিরাপত্তা স্বার্থের পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে যুক্ত। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের নেতৃত্বে তুরস্কের ইসলামিক রাজনীতির দিকে ঝোঁক এবং পাকিস্তানপন্থী অবস্থান— এই প্রেক্ষাপটে ভারতের অভ্যন্তরে তুর্কি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তা-কেন্দ্রিক ভূমিকাকে আর নিছক বেসরকারি কার্যক্রম বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তুরস্কের চেলেবির নিজস্ব ওয়েবসাইট অনুযায়ী, তারা তিনটি মহাদেশের ছটি দেশে ৭০টি বিমানবন্দরে কাজ করে, এবং ১৯৫৮ সালে তুরস্কের প্রথম বেসরকারি গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সংস্থা হিসেবে যাত্রা শুরু করে। ভারতে তাদের কার্যক্রম দুটি আলাদা কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালিত হয়; চেলেবি এয়ারপোর্ট সার্ভিসেস ইন্ডিয়া (গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং) ও চেলেবি দিল্লি কার্গো টার্মিনাল ম্যানেজমেন্ট (কার্গো পরিষেবা)।

আরও পড়ুন-দৌড়ে দিল্লি, বৃষ্টিই কাঁটা কলকাতার, ফাইনাল ক্রমশ পিছু হটছে ইডেনের

‘মানি কন্ট্রোল’-এর প্রতিবেদন অনুসারে, কোম্পানির ব্যবসার ৭৫ শতাংশই বিদেশি ক্যারিয়ার ভিত্তিক এবং ভবিষ্যতে লায়ন এয়ার, লুফথানসা, ক্যাথে প্যাসিফিক, আমেরিকান এয়ারলাইন্সের মতো আরও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে অংশীদারিত্বের পরিকল্পনা রয়েছে। ২০২৩ সালের ভূমিকম্পে ‘অপারেশন দোস্ত’-এর মাধ্যমে ভারত যখন মানবিক সহায়তা পাঠিয়েছিল, তখন তুরস্ক ভারতের পাশে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু তারপর মাত্র এক বছরের মাথায় তুরস্ক যখন পাকিস্তানের হয়ে ভারতীয় আকাশসীমায় হামলা চালানোর জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা দেয়, তখন সেই ‘দোস্তি’র অর্থ রাজনীতির বাস্তবতায় ভিন্নরূপে ধরা পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ভারত সরকারের পক্ষে চেলেবির মতো সংস্থার কার্যক্রম নতুন করে পর্যালোচনা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। উচ্চ-নিরাপত্তা অঞ্চলে এমন একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জোরালো উপস্থিতি এবং এর কর্মীদের তুর্কি সংযোগ— এগুলো পরোক্ষ নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে। গোয়েন্দা ও বিমান নিরাপত্তা সংস্থাগুলির কাছে এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন— এই সংস্থার মাধ্যমে কোনও স্পর্শকাতর তথ্য বা ঘাঁটি কি তৃতীয় পক্ষের হাতে চলে যেতে পারে? সাম্প্রতিক ঘটনাবলি সেই আশঙ্কাকেই নতুন করে জোরদার করেছে। ভারতের স্বার্থরক্ষায় কূটনৈতিক স্তরে যেমন সতর্কতা প্রয়োজন, তেমনি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বিদেশি সংস্থার ভূমিকা নিয়েও সতর্ক পুনর্মূল্যায়ন অপরিহার্য।

Latest article