গানের কবি প্রাণের কবি

কারও কাছে তিনি স্নেহময় অদৃশ্য দাদু, তো কারও কাছে পরম আশ্রয়৷ আবার কারও কাছে জীবনের বোধ তো কারও কাছে মৃত্যুর চেতনা। জানতে, অজান্তে তাঁকে অনুসরণ করে চলেছেন সকলেই। তিনি আমাদের কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর কাব্য থেকে গান আমাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। কখনও বাড়িয়ে দেয় আনন্দের হাত৷ কখনও হয় ক্ষতের প্রলেপ। বিশ্বকবির জন্মতিথিকে স্মরণে রেখে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টরা বললেন অনেক কথা। শুনলেন অংশুমান চক্রবর্তী ও শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

হলুদ হয়ে যাওয়া ছেঁড়া গীতবিতান
সুবোধ সরকার
রবীন্দ্রনাথের প্রায় সব গানই আমার খুব প্রিয়। এই মুহূর্তে মনে আসছে একটি গানের কথা। সেটা হল ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি সর্বনাশের আশায়’। টপ্পা অঙ্গের গান। খুব বেশি শোনা যায় না। ছোটবেলায় অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে শুনেছিলাম। সেই থেকে এখনও পর্যন্ত গানটা আমাকে ভরিয়ে রেখেছে। শুনতে শুনতে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ যেন তাঁর জীবনের সারাংশ এই গানে ধরে রেখেছেন। পরমুহূর্তে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র তাঁর জীবনের কথাই বলেননি, আমাদের সকলের কথা বলেছেন। সেই কারণে গানটা আমি কখনও ভুলতে পারি না। যদি কখনও আমাকে একটি রবীন্দ্রনাথের গান নির্বাচন করতে বলা হয়, আমি এই গানটির কথাই বলব। রবীন্দ্রনাথ আমাকে ভাত দিয়েছেন। ছোটবেলায় কৃষ্ণনগরের মাঠে-ঘাটে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতাম। গেয়েছি রবীন্দ্রভবনেও। পুরো মুখস্থ বলতে পারতাম ‘চিত্রাঙ্গদা’। গান শেখাতাম বাড়ি বাড়ি গিয়ে। আমিই তখন খুব ছোট। আমার ছাত্রছাত্রীরা আরও ছোট। রিফিউজি পরিবারের সন্তান আমি। মা খুব কষ্ট করে আমাদের বড় করেছেন। সেই কষ্টটা ভুলিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শুধু কষ্ট ভোলাননি। উপার্জনের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের গান শিখিয়েই তখন পয়সা পেতাম। সেই পয়সা আমাদের পরিবারের কাজে লাগত। পড়াশোনাও করেছি সেই পয়সায়। তখন আমার খুব প্রিয় গান ছিল ‘দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে’। শেখাতাম ছাত্রছাত্রীদের। গানটা শুনলে আজও আমার পুরনো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু আনন্দের গান আছে। সেই গানগুলো শুনলেও কখনও কখনও বেদনা ছুঁয়ে যায়। কষ্ট ঝরে পড়ে। গীতবিতানের প্রথম গান ‘কান্নাহাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা’। এই গানটার মধ্যে আনন্দ আছে। ধ্বনি আছে। নাচ আছে। স্তব্ধতাকে অতিক্রম করে যাওয়া আছে। একটা হইহই-করা আছে। কিন্তু তার ভিতরে কোথাও একটা তির-তির করে বয়ে চলেছে জীবনের ছোট-ছোট দুঃখ, ছোট-ছোট বেদনা। যেখানেই যাই, রবীন্দ্রনাথের আর-একটা গান আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। সেটা হল ‘তাসের দেশ’-এর ‘এলেম নতুন দেশে’। এটা যতটা আনন্দের গান, ততটাই আবিষ্কারের গান। আবার ভেঙে ফেরারও গান। যেন দু’হাত দিয়ে অনেক কিছু সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্ন জাগে, এটা কি সত্যিই নতুন দেশ, নাকি অন্য কিছু? হয়তো রূপক বা প্রতীকী। দেশে-বিদেশে যেখানেই যাই, এয়ারপোর্টে পা রাখলেই গানটা অজান্তেই গুনগুন করে উঠি। এইভাবে রবীন্দ্রনাথের অজস্র গান আমার ভেতরে আছে। এই বছর পয়লা বৈশাখ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে আমাকে রবীন্দ্র পুরস্কার প্রদান করা হয়। পুরস্কার গ্রহণের মুহূর্তে ছোটবেলার একটা দৃশ্য ভেসে উঠেছিল। আমার ছোড়দি খুব সুন্দর গান গাইতেন। বাড়িতে ছিল হলুদ হয়ে যাওয়া ছেঁড়া গীতবিতান। যখন আমার হাতে রবীন্দ্র পুরস্কারটা এল, মনে হল ওই হলুদ হয়ে যাওয়া ছেঁড়া গীতবিতানটা কেউ যেন আমার হাতে তুলে দিলেন।

 

রবীন্দ্রনাথের গান ফুরিয়ে যায় না
বাণী বসু
রবীন্দ্রনাথের গান আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে গেছে। যেকোনও পরিস্থিতিতে তাঁর গান আমরা গাই। শুনি। মনে করি। যেমন বর্ণপরিচয়, যেমন ফার্স্ট বুকের এ-বি-সি-ডি, তেমনই রবীন্দ্রনাথের গান। ভাললাগার গান প্রচুর আছে। সংখ্যা বলা যাবে না। কোনও কোনও গান একটা সময় হয়তো ততটা ভাল লাগত না। পরবর্তীকালে সেই গানের অর্থ বুঝেছি। বিস্মিত হয়েছি। মনে হয়েছে— গানটা তো আমার মনের কথাই বলে দিল! আমাকে একটা পর্যায় থেকে আর-একটা পর্যায়ে নিয়ে গেল। গানগুলো দৈববাণীর মতো। রবীন্দ্রনাথের ‘অধরা মাধুরী’ আমার খুব প্রিয় একটি গান। দোলানো ছন্দে গভীর কথা বলেছেন। ‘শাঙনগগনে ঘোর ঘনঘটা, নিশীথযামিনী রে।/ কুঞ্জপথে, সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে’ আমার পছন্দের আর-একটি গান। রবীন্দ্রনাথের বহু গান গভীরভাবে ভাবিয়েছে। জাগিয়েছে। আনন্দ দিয়েছে। কাঁদিয়েছে। ছোটবেলায় বেশকিছু গান শিখেছিলাম। সেগুলো মনের মধ্যে অদ্ভুত ছাপ ফেলে গেছে। যেমন, ‘অরূপ তোমার বাণী’, ‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে’। এই গানগুলো বহুশ্রুত। বহুগীত। ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’, ‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর’ গানগুলো কম বয়সে শেখা। এখন অন্য রূপে ধরা দেয়। ‘ঝরঝর বরিষে বারিধারা’ এক অসাধারণ বর্ষার গান। বসন্তের গানের মধ্যে ভাল লাগে ‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে’। মনে পড়ছে, কলেজের অনুষ্ঠানে এক ছাত্রীর নাচের সঙ্গে গানটি আমি গেয়েছিলাম। কয়েকজন ছাত্রী এবং সহকর্মী বলেছিলেন, এই গানের সঙ্গে নাচ ভাল হবে না। আমি হাল ছাড়িনি। শেষ পর্যন্ত ভালই হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে অনেককেই গানটির সঙ্গে নাচতে দেখেছি। গানটির মধ্যে যথেষ্ট নাটকীয়তা আছে। রাজেশ্বরী দত্ত ছিলেন আমার খুব প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। ওঁর কণ্ঠে ‘বাদল দিনের প্রথম কদমফুল’ আমার খুব ভাল লাগত। সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে বেশকিছু গান ভাল লাগে। একটা গানকে নতুন নতুনভাবে আবিষ্কার করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর গান ফুরিয়ে যায় না।

আরও পড়ুন-সংঘর্ষ বিরতি লঙ্ঘন পাকিস্তানের, শহিদ BSF সাব ইন্সপেক্টর

বিশেষ গানের শেষ কথা
নবকুমার বসু
অনেক আগে ‘প্রিয় বই’ প্রশ্নের উত্তরে লিখেছিলাম গীতবিতান আমি যে কোনও সময় যে কোনও পাতা থেকে পড়তে পারি। এবার বিশেষ প্রিয় রবীন্দ্রগান প্রশ্নের উত্তরে মনে হল, প্রথমেই আমার প্রবাসী এবং প্রান্তবাসী দেশ ও গৃহপরিচয়ের বিষয়টি আগে জানানো উচিত। কেননা পরিবেশ প্রকৃতি আবহাওয়া, ভাবনা ও উপলব্ধিকে প্রভাবিত করে। আর ঠিক সেই কারণে এখনও বিলেতের মাটিতে প্রতিদিন ভোরে শুনতে পাই— ‘অন্তরে জাগিছ অন্তর্যামী’ বা ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে’, কিংবা ‘দয়া দিয়ে হবে গো মোর জীবন ধুতে’। যে কোনও ঋতুতেই পরিচ্ছন্ন, শান্ত, সুন্দর এই দেশ রবীন্দ্রগানের মাধ্যমে আমার পিতৃবিয়োগের শোক প্রশমিত করে। আরও মনে আসে, ‘একটু কেবল বসতে দিও কাছে’, ‘নিত্য তোমার যে ফুল’, কিংবা ‘কোলাহল তো বারণ হল’, এমনকী ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে’। কী আশ্চর্য লাগে। যে কোনও শোকের প্রলেপ হয়ে আসে ‘মধুর তোমার শেষ যে না পাই’, অথবা ‘জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’। শোকার্ত মনের বেদনা রূপান্তরিত হয় পূজায়! আবার যার নাম পূজা তারই নাম তো প্রেম! ‘তুমি কোন ভাঙনের পথে এলে, সুপ্তরাতে’, কিংবা ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে’, ‘ভরা থাক স্মৃতি সুধায়’, ‘দিবস রজনী আমি যেন কার’— স্তব্ধ রাতের নির্জনতায় যখন এইসব গান মনে আসে, গুনগুনিয়ে উঠি, মনে হয় শুধু আমার প্রেম না, দেশ-কাল সময়ের সীমানা অতিক্রম করে। ‘কী সুর বাজে আমার প্রাণে’ গানটিকে কোন বিশেষ-এ চিহ্নিত করব! আনন্দ বা উচ্ছ্বাস ছাড়াও, উৎসারিত আবেগের আর কোন পর্যায়ে? আমি তো জানি, তিনি একা মানুষের কণ্ঠে ধারণ করেছেন হাজার পাখির গান। এক নিভৃত, শুনশান ভোরে শুনি, ‘কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্ন দিয়ে যাও’, কিংবা রৌদ্রদগ্ধ দিনের শেষে হঠাৎ ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’, ‘ঝরঝর বরিষে বারিধারা’, কিংবা ‘বাদল দিনের প্রথম কদমফুল’, এমনকী ‘শরতে আজ কোন অতিথি’ ঋতু থেকে ঋতুরঙ্গে এদেশেও ‘বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা’, কিংবা ‘চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে’। তিনিই আমার সব বিশেষ গানের শেষ কথা। তারপরেও জানি, ‘শূন্য হাতে ফিরি হে নাথ, পথে পথে’।

আরও পড়ুন-ফের বিজেপিতে ধস তৃণমূলে যোগদান

তিনি প্রতিমুহূর্ত ফেরেন নতুন রূপে
বিজয়লক্ষ্মী বর্মন
আমার বয়স যখন খুব অল্প তখন রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়ে আমার প্রথম কবিতা বলায় হাতেখড়ি হয়েছিল। বাবার খুব প্রিয় ছিল রবীন্দ্রনাথের কবিতা। বেশ অনেকটা বড় পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান, নাটক, গল্প— এগুলোই জুড়েছিল আমার জীবনে। অনেক পরে অন্য কবি, সাহিত্যিকদের লেখা এবং কবিতা পড়েছি। আর এখন আমি এমন একটা কাজের মধ্যে রয়েছি সেই কাজে আবার নতুন করে সর্বক্ষণের জন্য তাঁকে নিয়ে চলা শুরু হয়েছে। ভাবনা রেকর্ডস রবীন্দ্র রচনার ওপর পুরো একটা আর্কাইভ তৈরি করছে।
আমি সেই প্রোজেক্টটার সঙ্গে বেশ অনেকখানি জুড়ে আছি ফলে রবীন্দ্রনাথের গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-সহ বিভিন্ন লেখা পড়ছি নতুন করে এবং নতুন করে আবার উপলব্ধি করছি। যেখানে রবীন্দ্রনাথ খুব বেশি আলোচিত ছিলেন না, সেটা হল তাঁর প্রবন্ধ। কী অসাধারণ সেইসব প্রবন্ধ কত ধরনের বিষয় নিয়ে লেখা, কী যে তার মাধুর্য— এক অদ্ভুত ভাল লাগার রেশ থেকে যাচ্ছে। পড়ে মনে হচ্ছে এ যেন একেবারে তাঁর এই মুহূর্তের জীবন থেকেই নেওয়া। অথচ সেগুলো কত আগে লেখা। অর্থাৎ তিনি প্রতিমুহূর্তে আমাদের কাছে নতুন রূপে ফিরে ফিরে আসেন। ছোটবেলায় ছিল তাঁকে না বুঝে জানা বা পড়া। হাসির ছলে, মজার ছলে— কিন্তু বড় হতে হতে উপলব্ধি বদলেছে ধাপে ধাপে। এখন বুঝতে পারি যে সমস্ত বিষয় সম্পর্কে কতটা স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তাঁর, গূঢ়ভাবে এবং বিশদভাবে। এত পরিমিতি বোধ, এত জ্ঞান ছিল তাঁর যে প্রতিটা মানুষ তাঁর দর্শন থেকে কিছু না কিছু মণিমুক্তো পেয়েছেনই আমিও তার বাইরে নই।

আরও পড়ুন-নিউজ চ্যানেলে সাইরেন বাজানো বন্ধ করার নির্দেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের

তিনি আমার অনুপ্রেরণা
সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়
আমার জীবনের প্রতিটা স্থরেই তিনি বিদ্যমান। বিশেষ করে আমরা যাঁরা শিল্প বা সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ তাঁদের বড় অনুপ্রেরণা রবীন্দ্রনাথ। ছোটবেলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত আর রাবীন্দ্রিক নৃত্য দিয়ে আমার রবিঠাকুরের সঙ্গে পরিচয়। মূলত নাচেরই মেয়ে আমি। পঁচিশে বৈশাখ বলে নয় আমার কাছে প্রতিটা দিন তাঁকে উদযাপনের দিন। এখনও প্রচুর জায়গায় আমি অনুষ্ঠান করতে যাই। রবীন্দ্রনৃত্য পরিবেশন করি। আসলে ওঁকে নিয়ে বলতে গেলে শেষ হবে না। উনি কীসে নেই! প্রেমে, অপ্রেমে, হাসিতে, কান্নাতে, বিচ্ছেদে, ব্যর্থতায়…। জীবনের সব অনুভূতিতেই কোথাও না কোথাও রবীন্দ্রনাথ আছেন। আমি আমার বরানগর এলাকায় পঁচিশে বৈশাখের বর্ণাঢ্য আয়োজন করেছি। একটা বড় পদযাত্রা করেছিলাম। এখানে আমরা একটা কালচারাল সেল তৈরি করেছি— নতুন। এই এলাকাটা সাংস্কৃতিকভাবে খুব সমৃদ্ধ। ফলে গান, গল্প, অনুষ্ঠান, নাচের মধ্যে দিয়ে আমরা সবাই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সারাক্ষণ কোনও না কোনও ভাবে জুড়েই থাকি।

আরও পড়ুন-ডবল ইঞ্জিনের সরকারের বিহারে বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন পড়ুয়া!

তাঁর দর্শন পথ দেখায় আমাকে
অম্বরীশ ভট্টাচার্য
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার জীবনে অনেক ছোটবেলায় এসেছিলেন এক অদ্ভুত ঘটনার মধ্যে দিয়ে। আমার দাদু অর্থাৎ মায়ের বাবা দেবব্রত রায়, বিশ্বভারতীতে পড়তেন আর তাঁর বাবা অর্থাৎ আমার মায়ের দাদু বরদাকান্ত রায় ছিলেন একজন খুবই বিখ্যাত আই সার্জন। একবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে অনুরোধ করেন সেই সময়কার বোলপুরের গ্রামের সাঁওতালদের চোখের ছানি অপারেশন করতে। সেই সময় থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার মায়ের দাদুর হৃদ্যতার শুরু। ফলে বরদাকান্ত রায় আমার দাদুকে অর্থাৎ তাঁর পুত্রকে শান্তিনিকেতনে রেখে আসেন পড়াশুনো করতে। আমার দাদু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কাছে শান্তিনিকেতনেই পড়েছেন। আর আমার শৈশবের অনেকটা পর্ব মামাবাড়িতে কেটেছে দাদুর সান্নিধ্যে। ফলে তখন থেকেই রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবিঠাকুরের গান, কবিতার সঙ্গে আমার নিবিড় যোগ। প্রথম প্রথম ওঁকে শুনতাম। পরে আরও একটু বড় হয়ে তাঁর প্রবন্ধ, চিঠিপত্র ইত্যাদি পড়তাম। রেকর্ডে প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা হল দেবব্রত বিশ্বাসের কণ্ঠে ‘আকাশভরা সূর্যতারা’। একটা অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ তৈরি করত সেই গান। আমার সঙ্গে দিনে দিনে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক আরও গভীর হতে থাকল। নিজে যখন থেকে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প পড়লাম তখন নতুন করে আবার উপলব্ধি করলাম। আসলে রবীন্দ্রনাথ যতবারই পড়ি নতুন নতুন চেতনার জাগরণ ঘটে। এরপর যত বয়স বেড়েছে বুঝেছি উনি কতবড় শিল্পী। ওঁর প্রতিটা সৃষ্টি আমাকে কতরকম ভাবে অণুপ্রাণিত করেছে। বিশেষ করে মৃত্যু চেতনা। আপনজনকে হারিয়ে ফেলেও যেভাবে উনি জীবনকে আঁকড়ে ধরেছেন বারবার। ওঁর দর্শন আমাকে পথ চলতে শিখিয়েছে। পীযূষকান্তি সরকারের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার আবার অন্যরকমভাবে রবীন্দ্রনাথকে চিনেছি। নাটকের গান নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছি কেতকী দত্তের সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথের থিয়েটারের গান নিয়ে অনেক জ্ঞান অর্জন করেছিলাম কেতকী দত্তের কাছে। উনি বলতেন উদাত্ত কণ্ঠে গাও, কোনও বাধা রেখো না। রবীন্দ্রনাথ স্বাধীনতা পছন্দ করতেন। রবীন্দ্রজয়ন্তী নয় আমি নিত্য ওঁকে যাপন করি।

আরও পড়ুন-জঙ্গি সন্দেহে দু’জন গ্রেফতার নলহাটিতে

অজান্তেই ওঁকে অনুসরণ করছি
দেবশঙ্কর হালদার
আমরা আজকের যুগে দাঁড়িয়ে যখন রবীন্দ্রনাথের কথা বলি আমাদের জীবনে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আলোচনা করি তখন সেটা খুব স্পর্ধিত উচ্চারণ হয়ে যায়। তার কারণ উনি আমাদের এত বড় একটা জীবনের হদিশ দিয়েছেন। প্রতিটি মানুষ তা তিনি যে বর্ণের হন, যে ভাষার হন, শ্রেণির হন বা সংস্কৃতির ও ধর্মের হন তাঁদের প্রত্যেকের জীবনকে প্রতি মুহূর্তে তাঁর শিল্পসৃষ্টির মাধ্যমে ঋদ্ধ করে চলেছেন। ওঁর প্রতিটা কর্ম, প্রতি মুহূর্তে আমাদের জীবনকে, মননকে অনুপ্রাণিত করছে। যে মুহূর্তে আমি নিজে কোথাও প্রাসঙ্গিকতা হারাই তখনই ওনাকে দেখি, পড়ি, শুনি আর দেখি কীভাবে উনি আমাকেও প্রাসঙ্গিক করে তুলছেন। এর উদাহরণ দিয়ে শেষ করা যাবে না। আমার প্রতিটি কর্মে, প্রতিটি চলনে, প্রতিটি যাপনে উনি রয়েছেন। আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কখনও জেনে, কখনও অজান্তেই ওঁকে অনুসরণ করছি। আমাদের বাৎসল্যে, সংসার জীবনে, আমার দাম্পত্যে সর্বত্র রবীন্দ্রনাথই আমাদেরকে সুরক্ষিত করে রাখছেন সেটা কেউ বুঝতে পারছি আবার কেউ হয়তো পারছি না। উনি ওনার কাজ করে চলেছেন।

আরও পড়ুন-পাকিস্তানের মিথ্যাচার ফাঁস ভারতীয় সেনার

তিনি আমার পরম আশ্রয়
ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়
রবীন্দ্রনাথ আমার জীবনে পরম আশ্রয় এবং নির্ভরতা। তাঁর গান, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস— সবকিছুর মধ্যে দিয়েই যে দর্শন আমি পেয়েছি তা আমাকে অণুপ্রাণিত করেছে। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের অজস্র বই। মা খুব রবীন্দ্র অনুরাগী ছিলেন দক্ষিণীতে গান শিখতেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন। বাড়িতে সেইসব গান যখন চর্চা করতেন আমি বসে বসে শুনতাম। মা সেই গানের উৎস, গানের কথা বুঝিয়ে দিতেন ফলে ছোটবেলাতেই রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করতে শিখেছি। একটু একটু করে আমিও রবীন্দ্রচর্চার মধ্যে ঢুকে পড়ি। তখন তো টিভি বা মোবাইলের এত দাপট ছিল না। পড়াশুনোর বাইরে, ছুটির দিনে বা অবসরে তাঁর বই পড়তে পড়তে কবে যে রবীন্দ্রনাথ আমার পরম বন্ধু হয়ে গেলেন তা বুঝিনি। আমার জীবন বোধ বা মৃত্যু চেতনার শিক্ষা তো রবীন্দ্রনাথের থেকেই পেয়েছি। যে-কোনও দুঃখের সময় কীভাবে তা থেকে উত্তরণ ঘটানো যায় এই কথা তো রবীন্দ্রনাথই শিখিয়েছেন। জীবনের সব মন্ত্রই তো রবীন্দ্রনাথের গানে, কবিতায়, গল্পে ছড়ানো রয়েছে। আমার কাছে রবীন্দ্রজয়ন্তী দুর্গাপুজোর চেয়ে কিছু কম ছিল না। কখনও ডাকঘরের অমল হয়েছি, কখনও চণ্ডালিকায় দইওয়ালা হয়েছি। সেইসময় একরকম উপলব্ধি হয়েছিল এখন অন্যরকম উপলব্ধি হয়। রবীন্দ্রনাথের যে কোনও গল্প বারবার পড়তে ইচ্ছে করে, যে কোনও গান বারবার শুনতে ইচ্ছে করে, যে কোনও কবিতা বারবার আবৃত্তি করতে ইচ্ছে করে— কোনওটা পুরনো হয় না। তাই তিনি সবটা জুড়ে রয়েছেন। আর আমার খালি মনে হয় নতুন প্রজন্ম যদি এই উপলব্ধি না করতে পারে তাহলে আমি জানি না ওরা কার ওপর নির্ভর করবে ভবিষ্যতে। আসলে একলা জীবনে তিনি অলক্ষ্য থেকে হাতটা বাড়িয়ে দেন কীভাবে, সেটা যাঁরা বুঝেছেন তাঁরাই জানেন তিনি কত জরুরি।

আরও পড়ুন-ফের বিজেপিতে ধস তৃণমূলে যোগদান

নতুন জগতের সন্ধান পাই
সৌমিত্র রায়
রবীন্দ্রনাথের গানের মধ্যে আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের ‘আমায় বোলো না গাহিতে বোলো না’। সব দিক থেকেই প্রিয়। আবেগ আছে। বার্তা আছে। না গাইলে গভীরতাটা বোঝা যাবে না। ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’, ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে’ও আমার খুব পছন্দের গান। রবীন্দ্রনাথের সব গানই ভাল। আমার ছোড়দি গাইতেন। ছোটবেলায় ছোড়দির কাছেই আমি গান শিখেছি। পরবর্তীতে বড় হয়ে রবীন্দ্রনাথের গান শিখেছি শ্রাবণী সেনের কাছে। ভূমি এবং রবি ও নবীন থেকে প্রকাশ করেছি রবীন্দ্রনাথের গানের অ্যালবাম। যত বয়স বাড়ছে ততই রবীন্দ্রনাথের গান আমাকে পাগল করে দিচ্ছে। গানগুলো আমাকে যথেষ্ট ভাবায়। অথচ একটা সময় রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বেশি কিছু জানতাম না। কারণ আমি পড়াশোনা করেছি দার্জিলিং সেন্ট পলসে। ওখানে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বেশি কিছু জানার সুযোগ ছিল না। তাই আবেগটা আমার মধ্যে তেমনভাবে প্রবেশ করেনি। অনেক পরে জেনেছি, বুঝেছি। ভালবেসেছি রবীন্দ্রনাথের গান। ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙামাটির পথ’ আমাকে টেনেছিল। পরবর্তী সময়ে অনেক গান শিখেছি। এখনও শিখছি। সোমালি মুখোপাধ্যায়ের কাছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমি রবীন্দ্রনাথের গান গাই। রাজ্য সরকারের কবিপক্ষের অনুষ্ঠানেও গাইব। সত্যি বলতে, রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে ভয় করে। তবে গাইতে ভালও লাগে। বুঝে গাওয়ার চেষ্টা করি। একটা নতুন জগতের সন্ধান পাই। যে জগৎটা একটা সময় আমার অচেনা ছিল। রবীন্দ্রনাথের গান হল গানের সবচেয়ে আধুনিকতম রূপ। নোট এক চুল সরে গেলে গান নষ্ট হয়ে যাবে। তার ছিঁড়ে যাবে। এটা ভি বালসারা আমাদের বলেছিলেন। আমিও ওঁর সঙ্গে একমত।

আরও পড়ুন-গলসি থেকে পুলিশের জালে অনুপ্রবেশকারী

অনতিক্রম্য কবি
নলিনী বেরা
রবীন্দ্রনাথ একজন অনতিক্রম্য কবি। তাঁর মতো আধুনিক কবি পৃথিবীতে খুব কম এসেছেন। গীতাঞ্জলির বাংলা কবিতাগুলো পড়েছি। সেইসঙ্গে পড়েছি ইংরেজি অনুবাদও। পড়ে মনে হয়েছে গীতাঞ্জলি পুরোপুরি দার্শনিক কবিতা। রবীন্দ্রনাথ একজন দার্শনিক কবি, অসাধারণ কবি। তাঁর উচ্চারণ ঋষিতুল্য উচ্চারণ। যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তা আছে তাঁর কবিতায়। আমার জীবনে নানারকম দুর্ঘটনা ঘটেছে। সেই সময় আমি আঁকড়ে ধরেছি রবীন্দ্রনাথের কবিতা, রবীন্দ্রনাথের গান। তাঁর মধ্যে দিয়েই সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছি। আমার ছাত্রজীবন ছিল দুর্দশাপূর্ণ। নানান প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে, কষ্টের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছি। সেই সময়েও আমাকে উদ্ধার করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর কবিতা এবং গানের মধ্যে দিয়ে। যখন ভালবাসায় পড়েছি, তখনও সঙ্গী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে কোনওভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।

 

তাঁর অদৃশ্য কোলেই বেড়ে উঠেছি
অলকানন্দা রায়
জন্মলগ্ন থেকে আমার রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বেড়ে ওঠা। আমি মজা করে সবসময় বলি উনি আমার অদৃশ্য দাদু, যার অদৃশ্য কোলে আমি বড় হয়েছি। ছোট থেকে একেক বয়সে, জীবনের প্রতিটা ধাপে আলাদা করে রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছি ঠিক দাদুর মতো। তো ওই ইনফ্লুয়েন্সটা সবাই ঠিক বুঝবে না কোথায় যেন ভিতরে প্রবেশ করে যায়। সবচেয়ে বড় যেটা ওঁর কাছে শিখেছি তা হল পরিমিতিবোধ আর ভাঙাগড়ার সৎ সাহস। আমি অনেক কিছু প্রথা ভেঙে করি, কতটা ভাঙব, কীভাবে গড়ব সবটাই গাইড করে দেন রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনে যখন বাল্মীকি প্রতিভা করতে গেলাম। আমি তো ছৌ-এরও ব্যবহার করেছি বাল্মীকি প্রতিভায় তো একটু দ্বিধা ছিল ওখানে যারা পুরনো মানুষজন রয়েছেন তাঁর সেটা কীভাবে গ্রহণ করবেন। অবাক হয়েছিলাম শেষ হবার পর তাঁরাই এসে বললেন আজকে এই বাল্মীকি প্রতিভা দেখে সবচেয়ে খুশি হতেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। কমবয়সে যখন ‘আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে’ গাইতাম ভীষণ আনন্দ করে গাইতাম। পরে বড় হয়ে যখন গানের আসল মর্মটা বুঝলাম তখন একেবারে অন্য উপলব্ধিতে চলে গিয়েছিলাম। আমার নাচের স্কুলে কোনও পরীক্ষা নেই। সবটা খোলামেলা, আনন্দ করেই শেখে সবাই। আমি সেটাই শিখিয়েছি। তুচ্ছ কষ্ট, দুঃখ ভুলে এই স্বাধীন আনন্দকেই শিখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এটা তাঁর অনুপ্রেরণা যে আমি বদ্ধ কিছু ভালবাসি না তাই জেলবন্দিদের নিয়ে কাজ করেছি। চেয়েছি তাদের অন্তরের বন্দিত্ব ঘুচে যাক। রবীন্দ্রনাথ আমাকে শিখিয়েছেন পরিমিতি বোধ। আমি রবীন্দ্রনাথের বাইরে কিছু ভাবতে পারি না। ওঁর গান আমাকে মৃত্যুকে অন্যভাবে দেখতে শিখিয়েছে। তাই আমার মধ্যে মৃত্যুভয় বলে কিছু নেই। এ বছরে আমার নাচের, আমার পারফরম্যান্সের ৭০ বছর পূর্ণ হবে। প্রথম আমি জোড়াসাঁকোতে নেচেছিলাম চারবছর বয়সে ‘গহন কুসুম কুঞ্জ মাঝে’ আর এবার নাচলাম ৭০ বছরে সেই জোড়াসাঁকোতেই।

আরও পড়ুন-জাফরাবাদে বাবা-ছেলে খুনে গ্রেফতার মূল পান্ডা

যেন আমার জন্যেই লিখেছিলেন
স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত

২০০৬ সালে ৮৫ দিনে আমি সম্পূর্ণ গীতবিতান রেকর্ড করেছিলাম। নাম ‘একলা গীতবিতান’। ২০১৭ সালে রবীন্দ্রনাথের সুর না-করা দেড়শো গানে সুরারোপ করি। প্রকাশিত হয় দুটি অ্যালবাম ‘এবং গীতবিতান’, ‘এবং গীতবিতান এবং’। তাই পুরো গীতবিতানটাই আমার মস্তিষ্কে থেকে গেছে। তার মধ্যে নির্দিষ্ট কোনও গানকে প্রিয় বলা মুশকিল। তবে এই মুহূর্তে একটি গানের কথা মনে পড়ছে। সেটা হল ‘এরা পরকে আপন করে, আপনারে পর’। এই গানটা রবীন্দ্রনাথ যেন আমার জন্যেই লিখেছিলেন। তিনি আমার অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, বন্ধু এবং ডাক্তার। নানা কারণে মনখারাপ হলে আমি রবীন্দ্রনাথের গান আঁকড়ে ধরি। সামাজিক অস্থিরতা এবং বিপর্যয়ের সময়ও রবীন্দ্রনাথ আমার হাত ধরেন। সম্প্রতি কাশ্মীরে একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে। এই সময় ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’ এবং ‘দিন যায় বিষাদে স্বার্থ কোলাহলে’ গান দুটির কথা খুব মনে পড়ছে। যখন কাছের কেউ আমাকে বুঝতে ভুল করেন, দূরে সরে যান, তখন আপনমনে গেয়ে উঠি ‘ক্ষত যত ক্ষতি যত মিছে হতে মিছে/ নিমেষের কুশাঙ্কুর পড়ে রবে নীচে’। তিনিই বলেছেন, ‘ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে, জোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,/ হাসিতে হাসিতে আলোকসাগরে আকাশের তারা তেয়াগে কায়।’ প্রকৃতি ক্ষণিকের জন্য হাসে। মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে যায়। আমরা কেন সেটা পারি না? পারি না বলেই মনখারাপ ঘিরে ধরে। রবীন্দ্রনাথ আমার শয়নে, স্বপনে, জাগরণে।

আরও পড়ুন-জাফরাবাদে বাবা-ছেলে খুনে গ্রেফতার মূল পান্ডা

তাঁকে যাপন করি রোজ
দেবলীনা কুমার
ছোট থেকে মা-বাবা আমাকে রবীন্দ্রজয়ন্তীতে রবীন্দ্রসদন-চত্বরে নিয়ে যেতেন যাতে রবীন্দ্রনাথের বোধটা আমার তৈরি হয়। কিন্তু তাঁকে কি সত্যি জোর করে ভিতরে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া যায়! বড় হয়ে বুঝেছি তাঁকে আত্মস্থ করেছি। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর দক্ষিণীতে যখন গান শিখতে গেলাম তখন ধীরে ধীরে যেন এক অন্য রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পেতে শুরু করলাম। এটা কেউ চাপিয়ে দেয়নি। ওঁর সময় নাচের কথা কেউ ভাবতে পারত না। ঠাকুরবাড়িতে ব্রহ্মসঙ্গীতের চল ছিল কিন্তু নাচের চল ছিল না। কিন্তু শুধু মঞ্চে উপস্থাপন করার জন্য যে আধুনিক নৃত্যের একটা কনসেপ্ট উনি আনেন তা থেকেই বোঝা যায় আজ থেকে কত যুগ আগে রবীন্দ্রনাথ কয়েকশো বছর এগিয়ে ছিলেন। কাজেই জীবনের প্রতি স্তরে মনে হয়েছে ওঁর থেকে শুধু পেয়েছি। জীবনের বোধ, মৃত্যুর চেতনা সবটা। বিদেশে গিয়েছিলেন ইউরোপীয় সংস্কৃতি ওঁকে মুগ্ধ করেছিল। ওখান থেকে ফিরে তিনি লিখেছিলেন ‘ভানুসিংহের পদাবলী’। পদাবলীর গান শুনলেই বোঝা যায় পাশ্চাত্য সঙ্গীতের একটা প্রভাব আছে। সেই কত যুগ আগে উনি এত বিস্তৃতি নিয়ে ভাবতে পারতেন। উনি আমাদের প্রত্যেক দিনের অনুভবের সঙ্গী। ওঁর বই শুধু শেলফে সাজিয়ে রেখে দেবার নয়। ওঁর প্রতিটা সৃষ্টি অনুভবের। রবীন্দ্রনাথের গান, নাচ, নাটকের একটাই মূল কথা তা হল ভাব। আমি এবং মনোজ মুরলী নায়ার ‘আমোদিনী’ বলে একটা চ্যানেল শুরু করেছি ইউ টিউবে। আমরা সেখানে রবীন্দ্রনাথের গানের উপরে ভিত্তি একটা করে গল্প অভিনয় করে দেখানোর চেষ্টা করি। যেমন একজন ট্রাভেল গাইড এবং একজন ভিজিটার তাঁদের মধ্যে একটা হালকা প্রেম আলাপ। সেই প্রেম পথেই শেষ হয় সেই এপিসোডটার নাম দিয়েছি ‘একটুকু ছোঁয়া লাগে’। আমরা তাঁকে রোজ যাপন করছি জীবনে এবং মননে।

আরও পড়ুন-সংঘর্ষ বিরতি: সন্ধে ৬টায় বিদেশ সচিব বিক্রম মিশ্রির ঘোষণা

রবীন্দ্রনাথ আমার নিঃশ্বাসে, বিশ্বাসে
বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী
রবীন্দ্রনাথ আমার নিঃশ্বাসে, প্রশ্বাসে, বিশ্বাসে, ভালবাসায়, আমার প্রণামে, আমার সম্পূর্ণ অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া একটা পদক্ষেপও কখনও নিয়েছি বলে মনে হয় না। ‘বীরপুরুষ’ থেকে আমার তাঁকে ধরে চলার শুরু। যখন তাঁর সেই কবিতা বোঝার বয়স আমার ছিল না। পরিপক্ব হয়ে উঠিনি তখন থেকে এই বয়স পর্যন্ত প্রতি মুহূর্ত নতুন করে রবীন্দ্রনাথকে উপলব্ধি করেছি। এই তো সেদিন ‘শেষের কবিতা’ পাঠ করব বলে পড়তে গিয়ে আবার দেখলাম অনেকগুলো জায়গার নতুন অর্থ খুঁজে পাচ্ছি। যে অর্থগুলো এর আগে যে কয়েকবার পড়েছি বুঝিনি। প্রতিনিয়ত এটাই চলতে থাকে আমার সঙ্গে। আমি আবৃত্তি শিল্পী হব এটা ভাবিনি। ছোটবেলা থেকে নাটক করতাম। পর্দায় এসেছিও অনেক বেশি বয়সে। নাটক করেই বেড়াতাম।
তখন রবিঠাকুরের লেখা অনেক নাটক মঞ্চস্থ করেছি। তখন ই-টিভিতে রবীন্দ্রনাথের ওপর একটা সিরিজ হত, ওতে কাজ করেছি। আমি রবীন্দ্র কবিতা আবৃত্তি করি। বিভিন্ন জায়গা থেকে আমার ডাক আসে। আমি তাঁর কবিতা পাঠ করে নিজের আত্মিক উন্নতি করার চেষ্টা করি। পঁচিশে বৈশাখ অনেক জায়গায় আমন্ত্রণে যাই সব কাজ ফেলে। দেবব্রত দত্তের একটা কবিতা রয়েছে, ‘যখন আমি হারিয়ে যাই কেউ ধরেনি হাত, তখন যিনি পথ দেখান তিনি রবীন্দ্রনাথ’ এটাই আমার জীবনদর্শন। আমার হাজার ব্যস্ততার মাঝেও রবীন্দ্রনাথের জন্য আমার প্রচুর অবসর।

Latest article