সাহিত্যচর্চার শুরু ছাত্রজীবনে। চেয়েছিলেন কবি হতে। শেষপর্যন্ত হয়ে গেলেন গল্পকার। ঔপন্যাসিক হিসেবও পেয়েছিলেন বিপুল খ্যাতি। তিনি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের মধ্যবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কথাকার। উনিশ-বিশ শতকের সন্ধিক্ষণে তাঁর সরস গল্পগুলির প্রবল চাহিদা ছিল।
আরও পড়ুন-ধোনি-গড়ে জয়ের হ্যাটট্রিক দিল্লির
জন্ম বর্ধমানের মাতুলালয়ে। ১৮৭৩ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি। আদি বাড়ি হুগলি জেলার গুড়াপে। জামালপুরে শুরু হয়েছিল লেখাপড়া। ১৫ বছর বয়সে এনট্রান্স পরীক্ষা। তিন বছর পর পাটনা কলেজ থেকে এফএ। চার বছর পরে সেখান থেকেই বিএ। তারপর সরকারি ক্লার্কশিপের পরীক্ষা দিয়ে শৈলশহর শিমলায় ভারত সরকারের অফিসে চাকরি। এক বছরের মধ্যে সেখান থেকে বদলি। কলকাতায়। ডিরেক্টর-জেনারেল অব টেলিগ্রাফ অফিসে। স্থায়ী পদে।
কলকাতায় আসার পর আলাপ ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক সরলা দেবীর সঙ্গে। প্রভাতকুমার ততদিনে ‘ভারতী’র নিয়মিত লেখক। ১৯০১ সালের ৩ জানুয়ারি বিলেত পাড়ি দেন। ১৯০৩ সালের ডিসেম্বরে ব্যারিস্টার হয়ে ফেরেন। এফএ পরীক্ষা দেওয়ার ঠিক আগেই হালিশহরের ব্রজবালা দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ। ব্রজবালা দেবী ১৮৯৭ সালে ‘ভারতী’ পত্রিকায় ‘ভূত না চোর?’ নামে গল্প লেখেন। সেই বছরই তাঁর অকালপ্রয়াণ হয়।
‘প্রবাসী’, ‘মানসী’, ‘সাহিত্য’ ইত্যাদি পত্রিকায় ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখেছেন প্রভাতকুমার। তবে তাঁকে সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার পিছনে ‘ভারতী’ পত্রিকার বড় ভূমিকা ছিল। এই পত্রিকায় নিয়মিত ভাবে লিখতে লিখতেই তিনি পাঠকসমাজে জনপ্রিয় হতে শুরু করেন। পত্রিকার একজন বিশিষ্ট লেখক হয়ে ওঠেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য বই ‘ষোড়শী’, ‘গল্পাঞ্জলি’, ‘নবীন সন্ন্যাসী’। ভাষা, বর্ণনাভঙ্গি, বিষয়বস্তুতে তাঁর নিজস্বতা পাঠকদের মন ছোঁয়। বিলেতের বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা তাঁর ‘দেশী ও বিলাতী’ বইটি পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছিল। গল্পগুলো রীতিমতো সবাইকে চমকে দিয়েছিল। নাটোরের রাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়ের উৎসাহে ১৯১৫ সালে মানসী ও মর্মবাণী পত্রিকার সম্পাদনা করতে শুরু করেন।
আরও পড়ুন-প্রথম বাঙালি-মহিলা হিসেবে ইন্ডিয়ান আইডল কি মানসীই
কোনও সংস্কার ভাঙতে চাননি প্রভাতকুমার। সন্ধান করেননি কোনও নতুন সত্য। জীবনকে বিচার ও প্রশ্ন করার দুঃসাহস দেখাননি। বিষয়ের দিক থেকেও স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল ছিলেন না। গভীর দর্শনের কথা শিখিয়ে-ভাবিয়ে যাননি। তবু প্রবলভাবে পেয়েছিলেন মানুষের ভালবাসা। জগৎসংসারের হাল্কা-স্নিগ্ধ-সহজ কৌতুক এঁকে দিয়ে গিয়েছেন। সমসাময়িক অন্য সব গল্পকারের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ছিলেন। লিখতেন চমৎকার প্রসাদগুণমণ্ডিত ভাষায়। গল্পে পরিণত করতেন দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাটো উপাদানগুলোকে। বানাতেন নিপুণ ক্লাইম্যাক্স। গল্পের বুননে এমন সুবিন্যস্ত মুহূর্ত তৈরি হত যে, রোজকার লঘু হাসিকান্নাও পাঠকের মনে দাগ কেটে দিত। ১৯১৩ সালে তাঁকে চিঠি লেখেন রবীন্দ্রনাথ— “তোমার গল্পগুলি ভারি ভাল। হাসির হাওয়ায় কল্পনার ঝোঁকে পালের উপর পাল তুলিয়া একেবারে হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিয়াছে। কোথাও যে বিন্দুমাত্র ভার আছে বা বাধা আছে তাহা অনুভব করিবার জো নাই।” রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন— “ছোট গল্প লেখায় পঞ্চ পাণ্ডবের মধ্যে তুমি যেন সব্যসাচী অর্জুন, তোমার গাণ্ডীব হইতে তীরগুলি ছোটে যেন সূর্যরশ্মির মত।”
সরল, স্নিগ্ধ, মার্জিত, সজীব ভঙ্গিতে অনাবিল হাস্যরস তৈরি করতেন প্রভাতকুমার। কাহিনিসজ্জাও ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বিদেশি সাহিত্যে তাঁর অসামান্য দখল ছিল। জানতেন পাশ্চাত্যের আঙ্গিক। বাংলা কথাসাহিত্যে তা সৃষ্টিও করতে পেরেছিলেন। প্রমথ চৌধুরী তাঁকে প্রবাদপ্রতিম ফরাসি সাহিত্যিক গী দ্য মপাসাঁ-র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। ১৯৬০ সালে ‘দেবী’ ছবি বানিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। এই গল্পের লেখক ছিলেন প্রভাতকুমার। অর্থাৎ বোঝাই যায়, তাঁর গল্প শুধুমাত্র হাস্যরস নির্ভর ছিল না।
মানুষ হিসেবে প্রভাতকুমার ছিলেন আন্তরিক ও সহৃদয়। অধ্যাপনা ছিল পেশা। তবে লেখালিখি করেও কম রোজগার করেননি। ব্যারিস্টারির দিনগুলোতে সেই অর্থবল তাঁর সাহিত্য-সাধনায় সহায়কই হয়েছিল। পরে অধ্যাপনার সময়েও মন দিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। পাঠকের পাশাপাশি বিদগ্ধ মহলেও সম্মানিত হয়েছেন। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ তাঁকে অন্যতম সহকারী সভাপতি নির্বাচন করে। বাংলা সাহিত্যের এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী কথাসাহিত্যিক ১৯৩২ সালের ৫ এপ্রিল, মাত্র ৫৯ বছর বয়সে প্রয়াত হন। তাঁকে নিয়ে আরও বেশি চর্চা প্রয়োজন।