লালকেল্লায় মোদিজি বলেছেন, স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে (এখানে ভোট চুরির প্রসঙ্গ সৌজন্যের কারণে অনুল্লিখিত) বলেছেন, “পরবর্তী ১০ বছরে, ২০৩৫ সালের মধ্যে আমি জাতীয় সুরক্ষা কবচকে আরও বিস্তৃত, শক্তিশালী এবং আধুনিক করার ব্রত নিচ্ছি। আর সেজন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাপন্ন হয়ে সুদর্শন চক্রের পথই বেছে নিতে চলেছি আমরা। দেশ শীঘ্রই সুদর্শন চক্র মিশন প্রস্তুত করবে।”
তিনি আরও বলেন, “প্রধানমন্ত্রী বিকশিত ভারত রোজগার যোজনায় দু’বছরে সাড়ে তিন কোটি চাকরির সুযোগ তৈরি হবে। বেসরকারি সংস্থা-প্রতিষ্ঠানের প্রথমবারের কর্মীদের দুটো কিস্তিতে এক বছরের জন্য সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকার উৎসাহ ভাতা মিলবে। প্রত্যেক নতুন কর্মীর নিয়োগ পিছু সংস্থা কর্তৃপক্ষও মাসে সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকা করে উৎসাহ ভাতা পাবে।”
ক্ষমতায় আসার আগে তিনি বছরে দু’কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দেশ জানে, যুব সমাজ জানে তার একবর্ণও রক্ষা করা হয়নি। দশ লক্ষ সরকারি পদ ফাঁকা। রেলের একটা বড় কাজ আউটসোর্সিং হয়ে বেসরকারি হাতে। বেকারত্ব ৪৫ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। তাঁর নোট বাতিলের কুনাট্য কালো টাকা খতম করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবু লালকেল্লায় দাঁড়িয়ে তিনি জেনেশুনে আবার একটা গুল দিলেন। বললেন, আগামী দিনে কেউ বেসরকারি চাকরি পেলে এবং তার নাম ইপিএফওতে নথিভুক্ত হলেই ১৫ হাজার টাকা দেবে সরকার। এই টাকা দেওয়া হবে দুই কিস্তিতে। প্রথমটা ইপিএফওতে নথিভুক্তির ৬ মাস পর আর দ্বিতীয়টি বছর ঘুরলে। যিনি চাকরি দেবেন তাঁর জন্যও কিছু সুবিধার কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এই প্রকল্পের গালভরা নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রধানমন্ত্রী বিকশিত ভারত রোজগার যোজনা’। সবচেয়ে তাজ্জবের ব্যাপার, এতে নাকি দু’বছরে সাড়ে তিন কোটি নতুন চাকরি হবে।
অপূর্ব সব কথাবার্তা! অতুলনীয় স্বপ্ন সব!
এবং মিথ্যের ফানুস উড্ডীয়ন, নির্দ্বিধ চিত্তে।
কারণ, ইতিমধ্যেই ঘোষিত এমপ্লয়মেন্ট লিঙ্কড ইনসেনটিভ স্কিম (ইএলআই)। এটা ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের বাজেটে ঘোষণা করেছিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। ১ জুলাই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভাও তাতে অনুমোদন দিয়েছে। লালকেল্লার ভাষণে প্রধানমন্ত্রী প্রকল্পের নতুন নাম দিয়েছেন শুধু।
মোদ্দা কথা, ফের এক লক্ষ কোটির জুমলা! ১১ বছর পরেও মোদিজি সেই পুরনো জুমলা আঁকড়ে। পিএম ইন্টার্নশিপ স্কিমে সাড়া মেলেনি। মাত্র সাড়ে ৯ হাজার ইন্টার্ন যোগ দিয়েছেন। অথচ মোদি সরকার কর্মসংস্থানের ঘোষণা করেই চলেছেন।
এসব মিথ্যাচার তো প্রায় সর্বজ্ঞাত বিষয়। এবার লালকেল্লায় মোদির ভাষণে নয়া সংযোজন আরএসএস (RSS)।
আরএসএস (RSS) এদেশের বৃহত্তম এনজিও। মোদির বক্তব্য।
আরএসএসের শতবর্ষ সমাগত। আর, রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিষ্ঠা ১৮৯৭ সালের ১ মে। ২০২৫-এ প্রতিষ্ঠানের ১২৮ বছর চলছে।
সেই প্রেক্ষিতে আমাদের জিজ্ঞাসা, ঝড়, তুফান, বন্যা, ধস, ভূমিকম্প-সহ যে কোনওরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলায় এদেশে রামকৃষ্ণ মিশনের আগে কেউ নেই। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের প্রসারেও আজ স্বামী বিবেকানন্দের এই প্রতিষ্ঠান অপ্রতিদ্বন্দ্বী। শিব জ্ঞানে জীব সেবার যে ধ্রুবপদ বেঁধে দিয়ে গিয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ, শতবর্ষ পেরিয়েও তা আজও সঞ্চারিত সংগঠনের রক্তে মজ্জায়। অথচ সেই রামকৃষ্ণ মিশন অনুলেখিত প্রধান মন্ত্রীর লালকেল্লার ভাষণে।
কেন?
এর কারণ দুটো হতে পারে।
এক, রামকৃষ্ণ মিশনের হিন্দুধর্ম বিদ্বেষ, বিভাজন, বিভেদের কথা বলে না। ভোটের কথা বলে না। ঠাকুর স্বামীজির আদর্শ সব অর্থেই ‘ইনক্লুসিভ’, সবাইকে নিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করাই একমাত্র লক্ষ্য। ক্ষমতা দখলের ভোটের কড়ি কেনার জন্য নয়। তাই মোদির ‘চৈতন্য’ হয়েও হয় না। অথচ উদার আধুনিক হিন্দু ধর্মের একমাত্র প্রতীক শ্রীরামকৃষ্ণ, তাঁর বাণীই হল, ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’।
দুই, ৫৬ ইঞ্চির ৭৫ বছরে পদার্পণ। ১৭ সেপ্টেম্বর মোদিজির জন্মদিন। সংঘের অনুশাসন মানলে ৭৫ বছরের পর আর সংগঠন কিংবা সরকারের কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা উচিত নয়। সেটা যাতে না হয়, সেজন্য সংঘকে তুষ্টিকরণের আয়োজন। তাই-ই, আরএসএস (RSS) আলোচিত, আর সেই আলোচনায় রামকৃষ্ণ মিশন বর্জিত।
অপূর্ব বন্দোবস্ত লালকেল্লায় বাহারি পুতুলনাচে।
বাহারি পুতুলনাচ ছাড়া আর কীই-বা বলা যায় এটাকে?
ভোট চোর বলে অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদি তো কখনও গেরুয়া বস্ত্র মুড়ে ধ্যানে বসেন কেদারনাথ, কিংবা কন্যাকুমারীতে। কখনও আবার দামি হ্যাট, জংলা টি-শার্ট আর কার্গো প্যান্টে জঙ্গলসাফারিতে গিয়ে ‘ওয়াইল্ডলাইফ ফোটোগ্রাফার’ বনে যান। তিনিই আবার দেওয়ালিতে সীমান্তের সেনাশিবিরে যান পাক্কা ফৌজির বেশে। কখনও তাঁর পরনে দশ লাখি স্যুট। লালকেল্লায় ভাষণ দিলেন গুজরাতি ঘরচোলা কাপড়ের পাগড়ি পরে।
এসব নাটক দেখতে দেখতে, সাজের আর সংলাপের ‘জুমলা’ দেখতে দেখতে, আমরা ক্লান্ত।
ক্লান্তি আমাদের ক্ষমা করো প্রভু।
মিথ্যের তাপে রৌদ্রজ্বালায় শুকায় মালা পূজার থালায়,
সেই ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু॥
আরও পড়ুন-চাকা ঘুরল, ডার্বি ইস্টবেঙ্গলের দিমির প্রত্যাবর্তনে শেষ চারে