বোন সারকোমা একটি বিরল ক্যানসার যেখানে হাড় বা নরম টিস্যুতে ম্যালিগন্যান্ট কোষ তৈরি হয়। অন্যান্য ক্যানসারের তুলনায় কম দেখা গেলেও এর পরিসংখ্যান খুব কম নয়। জুলাই হল হাড়ের ক্যানসারের (সারকোমা) সচেতনতা মাস। আক্রান্তদের সুস্থ করে তোলার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তোলা এই মাসটি পালনের উদ্দেশ্য। এই নিয়ে জাগোবাংলার প্রতিবেদন
২০০৮ সাল থেকে জুলাই মাস সারকোমা সচেতনতা মাস হিসেবে পালিত হয়। এ-বছরের এই মাসটি পালনের থিম হল— ‘Raising Awareness to Create Survivors’। এর লক্ষ্য হল এই বিরল ক্যানসার আক্রান্তদের সুস্থ করে তোলার সম্ভাবনাকে বাড়ানো। পাশাপাশি খুব দ্রুত শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসা। কারণ প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে সঠিক চিকিৎসায় এই রোগ অনেকাংশে নিরাময় সম্ভব।
আরও পড়ুন-লর্ডসে সবুজ পিচ পাচ্ছে ভারত
সারকোমা একটি বিরল গ্রুপের ক্যানসার। যা শরীরে সংযোগকারী টিস্যু থেকে উদ্ভূত হয়। যা হাড়, পেশি, তরুণাস্থি, রক্তনালির ক্যানসার যা শিশু এবং তরুণ, বয়স্ক সবারই হতে পারে। সারকোমার বেশ কয়েকটা ভাগ রয়েছে যেমন সফ্ট টিস্যু সারকোমা এটা কার্টিলেজ, ব্লাড ভেসেলস, নার্ভ, অস্থিসন্ধি, টেন্ডন ইত্যাদি জায়গায় হয়। অস্টিওসারকোমা বা ইউইং সারকোমা এই দুটো শিশু এবং তরুণদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এছাড়া রয়েছে লিপোসারকোমা যা হয় ফ্যাট সেল বা চর্বি কোষে, রাবডোমিও সারকোমা হয় পেশিতে, হাড় এবং নরম টিস্যুতে। সারকোমা অ্যাওয়ারনেস মান্থ-এর কর্মসূচিগুলোর মধ্যে অন্যতম হল হাড়ের ক্যানসার সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রাথমিক শনাক্তকরণ অর্থাৎ শুরুতেই ধরা পড়ার গুরুত্ব বোঝানো, রোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের এবং তাদের পরিবারের জন্য সমর্থন ও সহায়তা প্রদান, হাড়ের ক্যানসারের কারণ, চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের জন্য যে গবেষণা চলে তার জন্য তহবিল সংগ্রহ করা ইত্যাদি।
প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ যে সারকোমা দেখা যায় তা হল লাইপোসারকোমা, আনডিফারেনশিয়েটেড প্লিওমরফিক সারকোমা এবং লিওমায়োসারকোমা।
আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় চার হাজার হাড়ের ক্যানসারের কেস দেখতে পাওয়া যায়।
এর কারণ কী
কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাড়ের ক্যানসার জেনেটিক বা বংশগত হয়।
যদি কারও আগে ক্যানসার হয়েছে এবং সেই কারণে হাই ফ্রিকোয়েন্সি রেডিয়েশন থেরাপি চলেছে দীর্ঘদিন তাঁর প্রভাবে অনেক সময় হাড়ে ক্যানসার হতে পারে।
কিছু বোন ডিজর্ডার, হাড়ের রোগ যেমন Li-Fraumeni সিন্ড্রোম এবং বংশগত রেটিনোব্লাস্টোমা হাড়ের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। দীর্ঘায়িত হাড়ের সংক্রমণ হাড় ক্যানসারের রিস্ক বাড়িয়ে দেয়।
অনেক সময় স্তন, ফুসফুস বা প্রোস্টেট ক্যানসারের মতো অন্যান্য ক্যানসারের ক্ষেত্রে, ক্যানসার হাড়ে ছড়িয়ে যেতে পারে, যা সেকেন্ডারি বা মেটাস্ট্যাটিক হাড়ের ক্যানসার নামে পরিচিত।
কী করে বুঝবেন
কোনও চোট বা আঘাত পাননি তাও হাড়ে বেশ ব্যথা এবং ফোলাভাব। বিশেষ করে যদি গাঁটের অংশ ফুলে যায় তাহলে তা সাধারণ হাড়ের সমস্যা নাও হতে পারে।
ফুলে যাওয়া অংশে মাংসপিণ্ডের অনূভূতি। হাত দিলে যদি ব্যথার অংশে রক্ত জমাট বাঁধার মতো লাম্প অনুভূত হয়।
রাতে ঘুমোনোর সময়ে ব্যথা-যন্ত্রণা হওয়া। ঘুম থেকে উঠেই গাঁটে-গাঁটে ব্যথা হওয়া।
ভারী কোনও জিনিস তোলার পর যন্ত্রণা বা হাঁটার ফলে হাড়ে ব্যথা হওয়া— এই সবই হাড়ের ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে।
হাড়ে যন্ত্রণার পাশাপাশি প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়াও কিন্তু ক্যানসারের উপসর্গ হতে পারে।
হাড়ের ক্যানসার শরীরে বাসা বাঁধলে হাড়ের ক্ষয় শুরু হয় এবং ভঙ্গুর হয়ে যায়। এর ফলে ওঠা বা বসা বিশেষ করে হাঁটু ভেঙে বসার সময় বা এমনি নিতান্ত সাধারণ কারণেও হাড়-ভাঙা বা ফ্র্যাকচারের মতো ঘটনা ঘটতে পারে।
মেরুদণ্ডের হাড়ের ক্যানসার মেরুদণ্ড থেকে বেরিয়ে আসা স্নায়ুগুলির উপর চাপ দিতে পারে। এর ফলে টিউমারটি কোথায় হয়েছে তার উপর নির্ভর করে শরীরের বিভিন্ন অংশে অসাড়তা এবং ঝিনঝিনানি শুরু হয়।
ক্যানসারের কারণে খিদে কমে যাওয়ায় ওজন খুব হ্রাস পেতে পারে।
ক্যানসার যদি জয়েন্টের কাছাকাছি হয়, তবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালনে সমস্যা হতে পারে।
ক্যানসারটি যখন অন্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে যেমন ফুসফুস— সেক্ষেত্রে কাশি বা শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
পরীক্ষানিরীক্ষা
একাধিক ইমেজিং পরীক্ষার রয়েছে। হাড়ের স্ক্যান যা রেডিওঅ্যাক্টিভ উপাদান ব্যবহার করে হাড়ের অস্বাভাবিকতা শনাক্ত করে। এটি প্রাথমিক পর্যায়ে হাড়ের ক্যানসার শনাক্ত করতে সহায়ক। কম্পিউটারাইজড টমোগ্রাফি বা সিটি স্ক্যান, এটি ক্যানসার শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়েছে কি না তা জানতে সাহায্য করে। ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং বা এমআরআই, এটি হাড় এবং নরম টিস্যুর বিস্তারিত ছবি তুলে ধরে। এই পরীক্ষা টিউমারের আকার, অবস্থান এবং শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা নির্ধারণে সাহায্য করে। পিইটি স্ক্যান বা পজিট্রন এমিশন টমোগ্রাফি। এই পিইটি স্ক্যান শরীরের বিপাকীয় কার্যকলাপ দেখায় এবং ক্যানসার কোষ শনাক্ত করতে সাহায্য করে। ক্যানসারের পর্যায় জানার জন্য বায়োপসি করার পরামর্শও দেন। এছাড়া রক্ত পরীক্ষা করেন চিকিৎসক। রক্ত পরীক্ষা সরাসরি হাড়ের ক্যানসার নির্ণয় করে না, তবে এটি রোগ নির্ণয়ের পরে সহায়ক হতে পারে। কিছু রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যানসারের অগ্রগতি বা শরীরে অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। কোন কোন টেস্ট হবে সবটাই রোগীর শারীরিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে চিকিৎসক করান।
এই পরীক্ষাগুলি ছাড়াও চিকিৎসক শারীরিক পরীক্ষা এবং রোগীর মেডিক্যাল ইতিহাস পর্যালোচনা করেন।
চিকিৎসা
অস্ত্রোপ্রচার
অস্ত্রোপ্রচারের মাধ্যমে ক্যানসারযুক্ত হাড়ের অংশ আংশিক বা সম্পূর্ণ অপসারণ করা হয় এবং প্রয়োজনে ধাতব ইমপ্লান্ট বা কৃত্রিম হাড় প্রতিস্থাপন করা হয়।
কেমোথেরাপি
ক্যানসার কোষ ধ্বংস করতে বা টিউমার সঙ্কুচিত করতে কেমোথেরাপি ব্যবহার করা হয়।
রেডিওথেরাপি
ক্যানসার কোষ ধ্বংস করতে বা টিউমার সঙ্কুচিত করতে রেডিয়েশন ব্যবহার করা হয়।
ইমিউনোথেরাপি
শরীরের রোগ প্রতিরোধ শক্তি ব্যবহার করে ক্যানসার কোষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ইমিউনোথেরাপি ব্যবহার করা হয়।
টার্গেটেড থেরাপি
কিছু কিছু ক্ষেত্রে, ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি এবং বিস্তার রোধ করতে টার্গেটেড থেরাপি ব্যবহার করা হয়।
হাড় মজবুত করা
যাতে সহজে হাড় ফ্র্যাকচার বা ভেঙে না যায় সেক্ষেত্রে হাড় মজবুত করার চিকিৎসা করা হয়।