ছোটদের বিরল শীতরোগ

শীতের সময় স্বাভাবিক ব্রঙ্কাইটিস, পেটের সমস্যা কিংবা নিউমোনিয়ার বাইরেও সাধারণ উপসর্গের বেশ কিছু অপরিচিত রোগের শিকার হয় বাচ্চারা। অপর্যাপ্ত সচেতনতার অভাবে সেগুলো উপেক্ষিত হয়, ডেকে আনে জীবন-মরণ সমস্যা। লিখলেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

শীত আরামের হলেও সময়-সময় এবং ব্যক্তিবিশেষে তা বেশ ভয়ের এবং দুশ্চিন্তারও। বিশেষ করে ছোটদের।
এমন কিছু রোগ আছে যা এই শীতে হয়। সাধারণ জ্বর, পেটব্যাথা বমির বাইরে সেই রোগ অপরিচিত তাই এর সম্পর্কে সচেতনতা ও সতর্কতা জরুরি।
কাওয়াসাকি রোগ
ডাক্তারি পরিভাষায় একে মিউকোকিউটেনিয়াস লিম্ফ নোড সিন্ড্রোম বা ভাসকুলাইটিস সিন্ড্রোমও বলা হয়ে থাকে। এটি একধরনের প্রদাহজনিত অসুখ যা শিশুর রক্তনালিতে, বিশেষ করে হৃদয়ের ধমনীগুলোতে প্রদাহ সৃষ্টি করে। উপসর্গ হিসেবে দেখা দেয় জ্বর, লালচে চোখ, সারা শরীরে ফুসকুড়ি, হাত-পা ফুলে যাওয়া, আর জিভে বিশেষ ধরনের দাগ যাকে বলে ‘স্ট্রবেরি টাং’। চিকিৎসা না হলে হৃদযন্ত্রের ধমনিতে অ্যানিউরিজম বা ফুলে যাওয়া অংশ তৈরি হতে পারে, যা প্রাণঘাতী হতে পারে।
ভারতে এ-রোগের প্রকোপ মোটের ওপরই খুব কম— প্রতি এক লক্ষ শিশুর মধ্যে প্রায় ৫-১০ জন আক্রান্ত হয়। এই রোগের কারণ আজও অজানা। ঠান্ডা আবহাওয়ায় ছড়িয়ে পড়া বিশেষ কোনও ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের কারণে শীত এবং বসন্তে বাড়ে। এই রোগ প্রধানত পাঁচ বছরের নিচের শিশু বিশেষ করে ছেলেদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি।
প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
এ রোগের কোনও টিকা নেই। তবে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে শিরায় ইমিউনোগ্লোবুলিন এবং অ্যাসপিরিন প্রয়োগে জটিলতা অনেকাংশে রোধ করা যায়। উপসর্গগুলোর সঙ্গে হামের মিল আছে। তাই পার্থক্য বুঝে চিকিৎসা করতে হবে।

আরও পড়ুন-এসআইআরের আসল লক্ষ্য ভোটারদের বাদ দেওয়া, বিএলওদের অকাল মৃত্যুর দায় কার? লোকসভায় প্রশ্ন তুললেন কল্যাণ

অটো-ইমিউন হিমোলাইটিক অ্যানিমিয়া
চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর নাম কোল্ড অ্যাগ্লুটিনিন ডিজিজ। এটি এক বিরল প্রতিরোধজনিত অসুখ, যেখানে শরীরের অ্যান্টিবডি ঠান্ডা আবহাওয়ায় নিজেরই লোহিত রক্তকণিকাকে আক্রমণ করে ভেঙে দেয়। এর ফলে দেখা দেয় রক্তাল্পতা, ত্বক ও চোখে হালকা হলদে ভাব (জন্ডিস), গাঢ় রঙের প্রস্রাব ও প্রবল ক্লান্তি। অনেক সময় মাইকোপ্লাজমা জাতীয় সংক্রমণ এই রোগকে উদ্দীপিত করে।
যদিও ঠান্ডা তাপমাত্রা এই রোগকে সক্রিয় করে তুলতে পারে, এর প্রকোপ অত্যন্ত কম— মোট অ্যানিমিয়া রোগীর মধ্যে এর হার ০.০১ শতাংশেরও কম। শীতের পরবর্তী ভাইরাসজনিত সংক্রমণের প্রভাবে কিছু ক্ষেত্রে এটি দেখা যায়। গ্রামীণ ভারতে সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভাবে প্রায়ই রোগটি চিহ্নিতই হয় না। সাধারণত ৫-১০ বছর বয়সি স্কুল-পড়ুয়া শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
শরীর উষ্ণ রাখা এবং ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রার সংস্পর্শ এড়ানো জরুরি। প্রাথমিক সংক্রমণ থাকলে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। গুরুতর অবস্থায় রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন হতে পারে।
নোরোভাইরাস গ্যাস্ট্রো-এন্টেরাইটিসের প্রাদুর্ভাব
নোরোভাইরাস সংক্রমণে তীব্র বমি-ডায়রিয়া ও জলশূন্যতা দেখা দেয়, যার ফলে শরীরে লবণ ও তরলের ভারসাম্য নষ্ট হয়। মারাত্মক পর্যায়ে শিশুদের খিঁচুনি বা কিডনি জটিলতাও দেখা দিতে পারে। সব ডায়রিয়ার মধ্যে প্রায় ১-২ শতাংশ ক্ষেত্রে নোরোভাইরাস দায়ী। তবে শীতকালে মাঝে মাঝে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে ছোটখাটো প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
পৃথিবীর অন্যান্য দেশে নোরোভাইরাস সাধারণত শীতকালেই ব্যাপকভাবে ছড়ায়, কিন্তু ভারতে এটি তুলনামূলক কম দেখা যায়— এখানে রোটাভাইরাস বেশি প্রভাবশালী। তবুও শীতল মৌসুমে দূষিত খাবার ও জলের মাধ্যমে, বিশেষত জনবহুল পরিবেশে যেমন স্কুল বা অনাথাশ্রমে, নোরোভাইরাসের সংক্রমণ ঘটতে পারে।
প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
পর্যাপ্ত তরল ও স্যালাইন সরবরাহই প্রধান চিকিৎসা। পরিবেশের হাইজিন ও খাদ্যস্বাস্থ্য বজায় রাখা জরুরি। কোনও নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই— সাধারণত ১-৩ দিনের মধ্যেই উপসর্গ কমে যায়, তবে গুরুতর ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শে শিশুদের হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত।

আরও পড়ুন-কল্কে পেল না বিজেপি, সমবায় ভোটে ৯ আসনেই জয়ী তৃণমূল

ঠান্ডাজনিত রক্তনালির সংকোচন
চিকিৎসকেরা বলেন রেনো’স ফেনোমেনন। ঠান্ডা আবহাওয়ায় রক্তনালির হঠাৎ সংকোচনের কারণে হাতের আঙুল বা পায়ের আঙুল প্রথমে ফ্যাকাশে সাদা, পরে নীলচে, এবং শেষে লালচে হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে তীব্র ব্যথা, অবশ ভাব বা সুচ ফোটার মতো অনুভূতি দেখা যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে এটি প্রায়ই অন্য কোনও অটোইমিউন রোগ যেমন লুপাস বা স্ক্লেরোডার্মা— এর দ্বিতীয় লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয়।
এটি শিশুদের মধ্যে অত্যন্ত বিরল— প্রাদুর্ভাব ১ শতাংশেরও কম। তবে শীতের তীব্র ঠান্ডা এ রোগের আক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। যেসব অঞ্চলে দূষণ, মানসিক চাপ ও তাপমাত্রার অস্থিরতা প্রবল, সেখানেই এই অবস্থা আরও জটিল হয়ে ওঠে। সাধারণত কিশোর বা কিশোরীদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, তবে প্রায়ই সঠিকভাবে শনাক্ত না হওয়ায় এর প্রকৃত হার অজানা রয়ে গেছে।
শীতে গরম গ্লাভস ও মোজা ব্যবহার করা, ক্যাফেইন ও ধূমপানের সংস্পর্শ এড়ানো জরুরি। গুরুতর বা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষেত্রে রক্তনালিকে শিথিল করার ওষুধ, যেমন ক্যালসিয়াম চ্যানেল ব্লকার, ব্যবহার করা হয়।
এসবের বাইরেও শীতকালে বায়ুদূষণের মাত্রা যখন আকাশ ছুঁয়েছে, তখন শিশুদের মধ্যে বিরল ধরনের হাঁপানির প্রকোপ বা দূষণজনিত হৃদপেশির প্রদাহ (মায়োকার্ডাইটিস)-এর ঘটনাও ক্রমে নজরে আসছে, যদিও এ-সংক্রান্ত তথ্য এখনও সীমিত। অপুষ্ট শিশুরা, বিশেষ করে শহরের বস্তি অঞ্চলে বা উচ্চভূমি এলাকায় দ্বিগুণ ঝুঁকিতে থাকে। কিছু আদিবাসী অঞ্চলে ফ্রস্টবাইট সমস্যার বিরল উদাহরণও নথিবদ্ধ হয়েছে।

Latest article