জয়িতা মৌলিক: শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ-নেপাল ঠিক যেন রিপিট টেলিকাস্ট! রাষ্ট্রপ্রধানদের বাড়িতে আগুন, মূর্তি ভাঙচুর, শারীরিক হেনস্থা, চপারে পালানোর চেষ্টা, স্থান আর কাল শুধু আলাদা। ঘটনার দৃশ্যপট কার্যত একই। মাত্র তিন বছরের মধ্যে ভারতের প্রতিবেশী তিন দেশে একই ধরনের গণ-অভ্যুত্থানের পুনরাবৃত্তি দেখে উদ্বিগ্ন সমাজবিজ্ঞানীরা, আশঙ্কায় কূটনৈতিক মহল। ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বশেষ রাজনৈতিক অস্থিরতার কেন্দ্র এবার নেপাল।
আরও পড়ুন-বাড়িতে আগুন লাগাল বিদ্রোহীরা, ঝলসে মারা গেলেন প্রাক্তন মন্ত্রীর স্ত্রী
২০২২-এ দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। ২০২৪-এ বাংলাদেশ। ২০২৫ দেখছে অস্থির নেপালকে। একইরকম গণঅভ্যুত্থান। প্রাথমিকভাবে কোথাও অর্থনৈতিক দেউলিয়া হওয়ার ঘটনা, কোথাও কোটা সংস্কার আন্দোলন, কোথাও সোশ্যাল মিডিয়ায় নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা দিয়ে শুরু হলেও হিংসাশ্রয়ী আন্দোলন শেষ হচ্ছে রাজনৈতিক পালাবদলের মধ্যে দিয়ে। বাংলাদেশের মতো নেপালেও আন্দোলনের রাশ যুব সমাজের হাতে। হিমালয়ের কন্যা নেপালের পালাবদল যেন শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশের রিপিট টেলিকাস্ট।
নেপালে ফেসবুক, ইউটিউব, এক্স-সহ ২৬টি সোশ্যাল মিডিয়া সাইট বন্ধ করার নির্দেশকে সামনে রেখে প্রতিবাদে সোমবার থেকেই ওলি সরকারের বিরোধিতায় নামে জেন-জি। পুলিশের গুলিতে মঙ্গলবার তা চেহারা নেয় বিদ্রোহের। তার চাপে পদত্যাগ করে পালাতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী। সামরিক বিমানে তাঁকে সরানো হয় বাসভবন থেকে। রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রী, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী-সহ অন্যান্য মন্ত্রীদের বাড়িতে ঢুকে অবাধে চলে লুঠ, অগ্নিসংযোগ। একইভাবে সেনা বিমানে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেন রাষ্ট্রপ্রধানরা।
এই একই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল ২০২২-এর শ্রীলঙ্কায়। তীব্র মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক অব্যবস্থা, বিদ্যুৎবিভ্রাট থেকে জ্বালানি তেল, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ঘাটতি— এইসব কারণে একাধিক সংকট দেখা দেয় শ্রীলঙ্কায়। তারই বিরোধিতায় গণঅভ্যুত্থান। তুমুল বিক্ষোভে উত্তাল হয় দ্বীপরাষ্ট্র। রাষ্ট্রপ্রধানের বাসভবনে ঢুকে লুঠ, ভাঙচুর বিক্ষোভকারীদের। রীতিমতো সুইমিংপুলে নেমে স্নান করে স্থানীয় মানুষ। ক্ষমতাচ্যুত হয় গোতাবায় রাজাপক্ষ সরকার।
আরও পড়ুন-পালাবদলের পর কে?
গতবছর এই সময় জ্বলছিল বাংলাদেশও। ‘জুলাই বিপ্লব’-এর আঁচে ঝলসে যায় হাসিনা সরকার। মূলত কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সামনে রেখেই ছাত্রদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারায় শেখা হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লিগ সরকার। আন্দোলনের নেপথ্যে মূল কারণ ছিল সরকারি চাকরিতে কোটা। শেখ হাসিনার পতনের পরে তাঁর বাড়িতে ঢুকে লুঠপাট করেন বাংলাদেশিরা। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর খাটে শুয়ে ছবি, ভিডিও পোস্ট। বাড়ির টিভি থেকে হাঁস-মুরগি নিয়ে পালান নাগরিকরা। অশ্লীল আচরণ করতেও দেখা যায় তাঁদের।
এবার সেপ্টেম্বরের ৮ ও ৯ তারিখ। স্যোশাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করাকে সামনে রেখে তুমুল বিক্ষোভ নেপাল জুড়ে। বিক্ষোভকারী বেশিরভাগই তরুণ প্রজন্ম। সংসদ ভবনে ঢুকে পড়ে তারা। সেখানে ঢুকে ভাঙচুর চালায় আন্দোলনকারীরা। সংসদ ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। বিক্ষোভ থামতে স্যোশাল মিডিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় কেপি শর্মা ওলি সরকার। কিন্তু ততক্ষণে জ্বলে গিয়েছে আগুন। মঙ্গলবার থেকে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে দেশ। দুর্নীতি-সহ একাধিক অভিযোগ ওলি সরকারের বিরুদ্ধে। তুমুল অশান্তি দেখা যায়।
যেভাবে রাষ্ট্রপ্রধানদের বাড়িতে হামলা হয়েছিল বাকি দু’দেশে, এখানেও তারই প্রতিফলন। রাস্তায় ফেলে মারা হয় দেশের অর্থমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রীকে। একইভাবে সেনার চপারে করে দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করেন ওলি। তবে, তিনি এখন নেপালের সীমান্ত অতিক্রম করতে পেরেছেন কি না তা স্পষ্ট নয়। যেভাবে হাসিনার পতনের পরে একের পর এক বঙ্গবন্ধু-সহ আওয়ামি লিগের নেতা-নেত্রীদের মূর্তি ভাঙা হয় বাংলাদেশ জুড়ে, নেপালেও এদিন সেই ছবি। রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টির প্রেসিডেন্ট রবি লমিছানেকে জেল থেকে মুক্ত করে দেওয়া হয়, ঠিক যেমন অভিযুক্ত বিএনপি-সহ রাজাকারদের বাংলাদেশের কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।
সোমবারই আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা ছিল, শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশের মতো নেপালে গণঅভ্যুত্থান হতে পারে। আর মঙ্গলবার সেই আশঙ্কাই সত্যি হল। শ্রীলঙ্কা কিছুটা ঘুরে দাঁড়াতে পারলেও বাংলাদেশ এখনও নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। তদারকি ইউনুস সরকার দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা আনতে পারছে না। নির্বিচারে অত্যাচারিত হচ্ছেন সেদেশের সংখ্যালঘুরা। এখন নেপালের সেনাবাহিনী বা বিরোধী রাজনৈতিক দল কীভাবে পরিস্থিতি সামলায় তার দিকেই নজর ভারত-সহ রাজনৈতিক মহলের।