দীর্ঘদিন কবিতা (Poem) লিখছেন অপূর্ব কোলে (Apurba Koley)। গতবছর প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতার বই ‘অ্যাশকাঠের বল্লম’। সুতীর্থ থেকে। ৮০ পৃষ্ঠার বইটিতে আছে বিভিন্ন স্বাদের কবিতা। সঙ্গে ছড়া, গান, কবিতিকা। গদ্য কবিতার পাশাপাশি আছে ছন্দের কবিতাও। সবমিলিয়ে বৈচিত্র্যময়। উচ্চারিত হয়েছে বর্তমান সময়ের এবং সমাজের কথা। সমস্যার কথা। তারসঙ্গে এসেছে পুরাণ, ইতিহাস, বিজ্ঞান ইত্যাদি প্রসঙ্গ। যাওয়া যাক কয়েকটি কবিতায়। শুরুতেই ‘বর্ণপরিচয়’ কবিতাটি। কবি লিখেছেন :
‘কবে বর্ণপরিচয় হয়েছিল, মনে নেই।/ কবে হাঁটুমুড়ে নিবেদন, মনে নেই।/ কবে অক্ষরের শাড়ি/ আমাকে জড়িয়ে ছিল/ মনে নেই।/ বিচ্ছেদের বহুদিন পর/ ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখি/ আমার শরীর জুড়ে/ অক্ষরের গাছ/ পাতায় পাতায় বাংলা ভাষা রৌদ্রস্নাত পাখি।’
অকারণ জটিলতা নেই। শুরুটাও হয়েছে খুব আটপৌরে ভাবেই। তবে ‘অক্ষরের শাড়ি’র মতো কবিতাটিও মাঝপথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নেয়। টের পাওয়া যায় অক্ষর গাছের অদৃশ্য উপস্থিতি। এই কবিতা (Poem) ভোরের নরম আলোর পাশাপাশি মনে করায় জীবনের অপরাহ্ণকে। তবে কোনও কালেই হাত ছাড়ে না প্রিয় বাংলা ভাষা। থেকে যায় আজীবন সবুজ। রৌদ্রস্নাত পাখির মতো। এ এক অন্যরকমের ভাষাপ্রেমের কবিতা।
সহজ অথচ গভীর ভাবনার প্রকাশ দেখা যায় ‘শিকারি’ কবিতায়। শুরুর পঙ্ক্তি :
‘দুটোই তো পক্ষ/ শিকার আর শিকারি।/ দেখো, পৃথিবীর জন্মের পর থেকে/ এই পক্ষ নিয়ে দড়ি টানাটানি।’
চরম বাস্তবধর্মী উচ্চারণ। পরবর্তী অংশে কবি বিভিন্ন ‘পক্ষ’কে উপস্থাপন করেছেন। শেষে লিখেছেন :
‘তুমিও আসলে শিকার করতে চাইছো/ দুটোই পক্ষ, তুমি কোন পক্ষের?’
উত্তর অজানা। এই অভিজ্ঞতা আমাদের প্রত্যেকের। আসলে শিকারিও অনেক সময় শিকার হয়ে ওঠে। প্রাত্যহিক জীবন দিয়েছে এই চরম শিক্ষা। কবিতাটি সার্থক।
অসামান্য ছন্দের কবিতা ‘ঘুমন্ত ধান’। কবিতার কিছুটা অংশ :
‘এখন আমার আতঙ্কে দিন কাটে/ এই বুঝি সে এলো চক্র হাতে;/ গুচ্ছ গুচ্ছ ধান ফলেছে মাঠে/ সম্বৎসর লক্ষ্মী বাঁধা পাতে।’
কীসের আতঙ্ক? অদৃশ্য হানাদারের? আধুনিক বর্গির? চতুর বিদেশি বণিকের? নেপথ্য কারণ স্বল্প বিনিয়োগে অধিক মুনাফা? হয়তো। তাই তো সতর্কতা। বিনিদ্র রাতজাগা। শেষ চার পংক্তি :
‘আমার পোড়া চক্ষেতে ঘুম নেই/ ঠাকুরদাদার পুরাণ ভীতি জাগে:/ তবে কী সেই ধ্বংসকাল এলো/ খোকার মুখে ধানের গন্ধ লাগে…।’
স্মরণে আসে কবি রায়গুণাকরের আলোকিত পঙ্ক্তি : ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। কোথাও যেন বাঁধা পড়ে যায় এক সুতোয়।
আরও একটি ছন্দবদ্ধ এবং দীর্ঘ কবিতা (Poem) ‘করোনাপর্ব ও ফেসবুক পাড়া ২০২০’। কবি লিখেছেন :
‘মালগাড়ি আসে মালগাড়ি চলে যায়/ লকডাউনের স্তব্ধতা ভেঙে খান/ অচেনা অসুখ ঘুরছে পৃথিবীময়/ এখন কেবল গৃহবন্দির গান।’
সাম্প্রতিক সময়ের কবিতা (Poem)। ধরা পড়েছে অতিমারির ভয়াবহ ছবি। রাষ্ট্রের গতির চাকায় নিষ্পেষিত অসহায় প্রাণ। রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন রণক্লান্ত পরিযায়ী। মর্মান্তিক ঘটনাকে স্মরণ করায় অংশটি। আছে আরও কিছু কিছু সমসাময়িক ঘটনার উল্লেখ। কবিতা জুড়ে কখনও ঝরে পড়েছে রাগ, কখনও প্রতিবাদ। সমগ্র কবিতাটি হয়ে উঠেছে সময়ের দলিল। শেষ চার পঙ্ক্তি :
‘তোমার আমার মাঝখানে মুখবই/ কথা কম বল, একুকু এখন দায়/ আসলে আমরা বন্ধু কেউই নই/ মালগাড়ি আসে মালগাড়ি চলে যায়।’
বিন্দুমাত্র কুহকের আশ্রয় নেননি সমাজ সচেতন এই কবি। সরাসরি প্রকাশ করেছেন নিজেকে। ‘মালগাড়ি আসে মালগাড়ি চলে যায়’ পড়তে পড়তে মনে হয়, আমারাই যেন নিষ্পেষিত, গতি-বিদ্ধ হচ্ছি প্রতিমুহূর্তে। জ্ঞানে, অজ্ঞানে। সত্যদ্রষ্টা কবি আমাদের চোখ খুলে দেন। জানতে এবং বুঝতে শেখান।
ভালো লাগে ‘ক্রুশ’, ‘মাধুকরী’, ‘অনশন’, ‘প্রচ্ছদ’, ‘ফেরা’, ‘মোমবাতি’ প্রভৃতি কবিতাগুলো। প্রচ্ছদশিল্পী সমীক্ষা মাজী।
শরৎ চট্টোপাধ্যায় এই সময়ের একজন সুপরিচিত কবি। গতবছর আবিষ্কার থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর কবিতার বই ‘অপ্রস্তুত দু-হাত’। ৬৪ পৃষ্ঠার বই। পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে কিছু আশ্চর্য কবিতা (Poem)। কোনো কোনো পঙ্ক্তি নাড়িয়ে দিয়ে যায়, ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায়। কবি তৈরি করেছেন নিজস্ব কাব্যভাষা।
ছোট্ট একটি কবিতা ‘কুঁড়ির জিজ্ঞাসা’। তুলে ধরা যাক কবিতাটি :
‘জ্যোৎস্নায়/ প্রতিফলকে/ আমৃত্যু ঋণে/ বেঁচে থাকতে হয়/ যা দিই, পুড়ে ছাই হয়ে রামধনু/ দেখবার কিছু বাকি থাকলে/ বলো,/ ঝাঁপ দেবো/ ফুলের আগে তুমিই কি একমাত্র অবিনশ্বর/ কুঁড়ি?’
কবিতাটি তুমুল প্রেমের কবিতা হিসেবে আমার সামনে ধরা দেয়। বার বার মুখোমুখি হই। প্রতিবার মনে হয়, এ এক পবিত্র মিলন এবং নবজন্মের কবিতা। জৌলুসহীন। জ্যোৎস্নার মতো স্নিগ্ধ। আটপৌরে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিচু স্বরে বাঁধা। ফিরে ফিরে আসতে ইচ্ছে করে এমন সৎ কবিতার কাছে।
‘বাঁশির থ্যালাসেমিয়া’ কবিতায় কবি লিখেছেন :
‘হিম্মতওয়ালি চাঁদ অসুখ চেনে না, ঋতু মানে/ ডাগরমাত্রায় ভুল শুধরে দেয়/ চাঁপার সুগন্ধ রাতে, সিঁড়িটির গণিত/ বেয়ে ওঠার মুহূর্ত যেন/ কোকশাস্ত্রের থিওরি, এজন্মে/ প্র্যাকটিক্যাল ভুল দ্বাদশ খেলোয়াড় হয়ে/ দূর থেকে বাঁশির থ্যালাসেমিয়া দেখি…’।
আছে আরও কিছুটা অংশ। শব্দপ্রয়োগে কবি যথেষ্ট সাহসী। কিছুটা বেপরোয়াও। নিখুঁত দক্ষতায় ঘটিয়েছেন যথাযথ প্রয়োগ। তাই চাঁদকে ‘হিম্মতওয়ালি’ বিন্দুমাত্র আরোপিত মনে হয় না। ‘সিঁড়িটির গণিত/ বেয়ে ওঠার মুহূর্ত যেন/ কোকশাস্ত্রের থিওরি’ পড়তে পড়তে প্রশ্ন জাগে, এ কোন সিঁড়ির গণিত? ধাপে ধাপে হৃদয় চেনার? শরীর চেনার? কে এই অপ্রয়োজনীয় ‘দ্বাদশ খেলোয়াড়’? যে পেয়েছে আলো না-চেনার নির্মম অভিশাপ? হয়তো। কবিতাটি (Poem) নির্মেদ, সংকেতধর্মী।
এক চরম উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে ‘ডাক পাঠালে না আসাই ভালো’ কবিতায়। কবি লিখেছেন :
‘মন চায় তুমি এসো/ ডাক পাঠাতে গিয়ে অভিমান কেঁদে ওঠে/ তবুও ডাক পাঠাই,/ তারপরেই বুঝতে পারি, তুমি না/ এলেই ভালো।’
শেষ অংশে কারণ জানিয়েছেন কবি। আসলে অনেক সময় চাওয়া না-চাওয়া, পাওয়া না-পাওয়ার মাঝে থেকে যায় এক চুমুক দূরত্ব। সময় বিশেষে না-দেখাও অনেক বেশি দেখা, না-বলাও অনেক বেশি বলা। মুখোমুখি হলে মুছে যায় গভীর রহস্য। প্রকাশিত হয় অসহনীয় বাস্তব। তাই হয়তো অদৃশ্য দূরত্ব। শেষপর্যন্ত সেই অভিমুখেই নিয়ে যাওয়া হয়েছে কবিতাটিকে।
ভাল লাগে ‘স্বপ্নে কোনো ধারবাকি নেই’, ‘জ্বর’, ‘বোতাম’, ‘শূন্যস্থানে একা’ কবিতাগুলো। দেবাশিস সাহার প্রচ্ছদ প্রশংসনীয়।
এইবছর সোপান থেকে প্রকাশিত হয়েছে সুবর্ণ রায়ের কবিতার বই ‘প্রেমের কবিতা’। ২২৮ পৃষ্ঠার বই। শুরুতেই ‘মেষপালকের গান’। কবিতায় আছে ৫৪টি অংশ। টানা গদ্যে লেখা। ৬ সংখ্যক কবিতায় কবি লিখছেন :
‘ধনুকের ছিলার মতো ছিটকে উঠেছিল দারুণ দ্বিপ্রহর। ফুলের পাপড়ি যেমন খোলে তেমন মেলে ধরেছিল উৎস। পাহাড় ভেঙে উপত্যকা আর উপত্যকা ঘিরে স্রোতস্বিনী যেমন, তেমনই এগিয়ে চলেছিল ক্ষয় আর গঠন…’।
প্রেম তো বটেই। তুমুল শরীরী প্রেম। তবে শুধুই কি তাই? লবনাক্ত শরীরের সীমানা ছাড়িয়ে কোথাও কি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়নি উন্মুক্ত প্রকৃতির সঙ্গে? হয়েছে। পাশাপাশি হয়েছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন। অজান্তেই। ‘দারুণ দ্বিপ্রহর’ কেন? এইসময়ই তো ঘটে শক্তির, উষ্ণতার চরম প্রকাশ।
‘অভিমানী ধুলো’য় আছে টুকরো টুকরো ৪২টি কবিতা। প্রতিটি দুই পংক্তির। কয়েকটি উল্লেখ করা যাক। ২ সংখ্যক কবিতায় কবি লিখছেন :
‘তোমার কোনো কবিতা নেই। আমারও নেই।/ আমরা কবিতা অথচ।’
ব্যক্তি নয়, যে-কোনো সম্পর্ক পবিত্র হলেই কবিতায় রূপ নেয়। সম্ভবত সেই ভাবনারই প্রকাশ ঘটাতে চেয়েছেন কবি।
প্রেম ও প্রকৃতি আরও একবার হাত ধরাধরি করে ৪ সংখ্যক কবিতায়। কবি লিখছেন :
‘রূপালি রাত। রাতজাগা পাখি। পাখিরব।/ গাছগাছালি বাগিচাপথ মুখর।’
দুদণ্ড শান্তি দেয় এইরকম লাজুক পঙ্ক্তি। অফুরন্ত প্রাণের আরাম।
‘অস্ফুট আগুনের ভাষা’ কবিতায় যাওয়া যাক। কবি লিখেছেন :
‘কী যে হবে/ কী হবে কথা/ অনন্ত অতিক্রান্ত মুখরতা/ কার সুর/ কে গাইবে গান/ ধূ-ধু জীবন আসর শুনশান।’
এই কবিতায় প্রেম আছে। আছে তুমুল অ-প্রেমও। পরের অংশ :
‘মুখ আর মুখোশ/ অহেতুক তুলি-রং/ অচেনা সবাই জগৎ ভরা সঙ/ কে বা দেবে/ কে বা নেবে মন/ চৈত্র দুপুর অকারণ অকারণ।’
ধরা পড়েছে গভীর অনিশ্চয়তা। এবার শেষ দুই পঙ্ক্তি :
‘অকারণ আগুনের ভাষা/ যে ভাষায় কথা বলে ভালোবাসা…।’
নিছক সাদামাঠা প্রেমের কবিতা বলা যায় কি? মনে হয় না। আরও এক বা একাধিক অর্থ বহন করে। কবিতাটি বাঁধা হয়েছে ছন্দে। কোথাও কোথাও নেওয়া হয়েছে সান্ধ্যভাষার আশ্রয়।
সংকলনের শেষ কবিতা ‘তুমি আছো’। কবি লিখেছেন :
‘সত্তার ভিতরদেশে/ স্বপ্নের অনেক গভীরে/ দুটি শব্দের মাঝামাঝি/ অক্ষর থেকে অক্ষরের দূরত্বে/ কলম আর পৃষ্ঠার মধ্যবর্তীতায় আছো।/ যেমন বৃষ্টি মানেই জল,/ এপিটাফ মানেই পাথরের নিস্তব্ধতা/ যেখানে সময় আর দীর্ঘনিশ্বাস/ চিহ্ন রেখে যায়…/ লিখে রাখে কবিতা/ সুর লাগে গানে।’
কবিতার শরীরেই লুকিয়ে রয়েছে টুকরো টুকরো কবিতা। অনুসন্ধিৎসু মন ঠিক খুঁজে নেয়। ‘বৃষ্টি মানেই জল,/ এপিটাফ মানেই পাথরের নিস্তব্ধতা’য় শুধুই প্রেম নেই, আছে আরও অনেক কিছু। অতিরিক্ত। ঘটেছে অনন্ত ভাবনার বিস্তার। পাতার পর পাতা কবিতাগুলো পড়ে সেই উপলব্ধিই হয়েছে আমার। দেবাশীষ সাহার প্রচ্ছদ যথাযথ।