(গতকালের পর)
ওয়াকফ (waqf bill) সম্পত্তি বেদখল হয়ে আছে প্রচুর। তা উদ্ধার করার কোনও উদ্যোগ কেন্দ্রীয় সরকারের নেই। দিল্লি স্টেশনের ও ৪নং স্টেশনের মধ্যে একটি মসজিদ আছে তা তুলে ফেলার জন্য তৎপরতা আছে। বেদখল ওয়াকফ সম্পত্তি উদ্ধারের পরিকল্পনা নেই। কলকাতা বিমানবন্দরের শেষ প্রান্তে ওয়াকফ সম্পত্তি ও মসজিদ নিয়ে বিতর্ক সবসময় আছে। কিন্তু স্পষ্ট সমাধানের রাস্তা নেই। কলকাতার টলি ক্লাব, গলফ ক্লাব সামান্য ভাড়ায় রয়েছে যা অকল্পনীয়। এসব নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তা না করে ওয়াকফ সম্পত্তিকে সরকারি কুক্ষিগত করার প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে। তাই এমন বিল। যা আইন হতে যাচ্ছে। শুধুমাত্র মুসলমানরা নয় সব মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা ধ্বংস হবে।
ওয়াকফে একজন সার্ভে কমিশনার থাকেন। সরকারই তাঁর নিয়োগ কর্তা। কোন সম্পত্তি ওয়াকফ তাতে তাঁর মতামত ও পর্যবেক্ষণ জরুরি। কিন্তু সেটা চূড়ান্ত নয়। আরও অনেক মাধ্যম দিয়ে যেতে হয়। এবার এই পদ হটিয়ে জেলাশাসককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই কাজের। শুধু স্মরণ করিয়ে দিই কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসন পুর্নবিন্যাস কমিটি বলেছেন জেলাশাসকদের ৬০/৭০টা দায়িত্ব, তা থেকে তাঁদের অব্যাহতি দেওয়া দরকার। এরপর যদি ওয়াকফের দায়িত্ব পড়ে তাহলে সোনায় সোহাগা। তিনি নীচুস্তরের কাউকে দায়িত্ব সঁপে দিয়ে কাজ শেষ করবেন সেটা বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়।
আগেই ছিল সংখ্যালঘু দফতরে মন্ত্রী, তিনি যেই হোন কেন কেন্দ্রীয় ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান হবেন। নতুন কিছু নয়। এই বিলে আবার নতুন করে বলা হয়েছে। কমিটি গঠনে বড় পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৯৫-র আইনে ছিল নির্বাচিত ও মনোনীত মিলিয়ে ৮-১২ জন সদস্য হবেন। তার মধ্যে মুসলমান এমপি ২ জন, এমএলএ বা এমএলসি ২ জন। আদালত থেকে ১ জন। মোতলায়ী। এখন এমপি ও এমএলএ ১ জন করে। ২ জন ব্যবহারজীবী। রাজ্য সরকারের একজন অফিসার। বার কাউন্সিলে ১ জন। চেয়ারপারসন ২ জন। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে ১১ জনের মধ্যে ৭ জন অমুসলিম হতে পারে। বিলে বলা হয়েছে যে, যারা প্রফেশনাল, আইনজ্ঞ এবং বার কাউন্সিলের প্রতিনিধি এবং মুখ্য আধিকারিক মুসলমান না হলেও চলবে। নতুন করে বলা হয়েছে মহিলা ২ জন থাকতে হবে। এটা আগের আইনে ছিল কমপক্ষে ২ জন মহিলা। বেশি হতে কোনও অসুবিধা ছিল না। এখন ২ জন নির্দিষ্ট করা হল। বোর্ডে অফিসার নিয়োগ সম্পর্কে সাচার কমিটির পর্যবেক্ষণ ছিল ওয়াকফ বোর্ডে এমন আধিকারিক যুক্ত করতে হবে যার ইসলামি আইন সম্পর্কে যথাযোগ্য জ্ঞান আছে। যাতে সে ওয়াকফের বিষয়গুলো ভালভাবে দেখাশোনা করতে পারে।
আরও পড়ুন-ধর্মীয় বিভাজন বাড়াতে এবার হাতিয়ার ওয়াকফ
এবার একটু অন্য কথা বলি। ১৯৯৭ সালে কর্নাটক হিন্দু রিলিজিয়াস ইনস্টিটিউট অ্যান্ড চ্যারিটেবেল অ্যাক্ট-এ বলা হয়েছে বোর্ডের সমস্ত সদস্য হিন্দু হতে হবে। কমিশনার, সরকারি আধিকারিক, মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক সকলকেই হিন্দু। সরকার কোনও অহিন্দুকে মনোনীত করতে পারবেন না। শুধু শিখ গুরদ্বোয়ারা অ্যাক্ট ১৯২৫-এ বলা হয়েছে তাদের বোর্ডের সমস্যা তো বটেই মুখ্য নির্বাহী আধিকারিককেও শিখ হতে হবে। মুসলমানদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা হচ্ছে কেন? স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে এর পিছনে বিজেপির নিশ্চয় কোনও বদ উদ্দেশ্য আছে। এবং আছেই।
অমুসলমান ওয়াকফ (waqf bill) করতে পারে কি না? নিশ্চয় পারে। ১৯৯৫ সালের আইনে সেটার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু ২০১৩ সালে ওয়াকফ আইনের সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়ে সেটা অনুমোদিত হয়েছে। কেন এটা করা হল? অনেক হিন্দু রাজা বা অন্যরা কবরস্থানের জন্য জমি দিয়েছেন। মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য জমি দিয়েছেন বা অন্যান্য সম্পদ দিয়েছেন। সেটা কীভাবে বিবেচিত হবে? এটা নিয়ে ২০১৯ সালে মামলা হয়। মহামান্য আদালত রায় দেন ইতিবাচক। সরকারের মনে কি এটাই আছে যে এ-কারণে ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলমানরাও থাকবেন। সবার প্রতি সম্মান রেখে বলছি এমন উদ্ভট চিন্তা কেবলমাত্র বিজেপি সরকারই করতে পারে। যাদের হাতে দেশ আর নিরাপদ নয়।
আর একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ— এই বিলে যে সম্পত্তিগুলি ওয়াকফ (waqf bill) হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে কিন্তু দলিলপত্র নেই সেগুলোকে ওয়াকফ বা লিফা থেকে বাদ দেওয়া হবে। বাবরি মসজিদ সম্পর্কে রায় দেবার সময় বিচারকরা বলেছিলেন আমাদের বিচার ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে ওয়াকফ হিসাবে ব্যবহার করা সম্পত্তিকে মান্যতা দিয়েছে, যদিও তাদের হাতে লিখিত কোনও কাগজ নেই। দীর্ঘদিন ধরে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসাবে ব্যবহার হওয়াটাকেই প্রমাণ হিসাবে ধরতে হবে। যদি এই বিল পাশ হয়ে আইন হয় তা হলে জামা মসজিদের কাগজ বা দলিল চাওয়া হবে। দিল্লি রেল লাইনের মসজিদের দলিল দেখতে চাওয়া হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের এটাই কি প্রকৃত উদ্দেশ্য? বাবরি মসজিদ সম্পর্কে রায় দেবার সময় প্রধান বিচারপতি সমস্ত যুক্তি মুসলমানদের পক্ষে দিয়ে বলেছিলেন বহু-বহু দিন ধরে হিন্দুরা ওখানে পুজোঅর্চনা করছে। আজ সেখানে রামমন্দির হয়েছে। মুসলমানরা সেটা মেনে নিয়েছে। তাহলে নতুন ওয়াকফ আইন হলে সেই বাবরি মসজিদ কেস বিচার তো উল্টে যাবে। দেশের পরিস্থিতি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বিজেপি সবাই বুঝতে পারছেন।
ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে কোনও সমস্যা হলে তার সমাধানের জন্য ৩ জন সদস্যের ওয়াকফ ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়। তাঁরা হবেন একজন বিচারপতি। তিনি প্রথম শ্রেণির জেলা সেশন বা সিভিল জজ (সভাপতি)। আর একজন অতিরিক্ত জেলাশাসক পদের আধিকারিক। আর ইসলামিক আইনে বিষেশজ্ঞও রাখা হয়নি। সরকারের মনের ইচ্ছা বুঝতে বোধ হয় আমাদের অসুবিধা হচ্ছে না।
আর একটা বিষয় না বললে নয় যে, নতুন বিলের ১৯ নং ধারাতে একটা প্রস্তাব করা হয়েছে যাতে ওয়াকফ সংক্রান্ত ব্যাপারে ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতাকে কমানো হয়নি শুধু। রাজ্য সরকারেরর ক্ষমতাও কমানো হয়েছে। ১৯৯৫-এর আইনের ৩৭ নং ধারা সংশোধন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার ভুলে গেছেন যে জমি সংক্রান্ত বিষয় সংবিধান রাজ্যের এক্তিয়ারের মধ্যে রেখেছে। জোরের সঙ্গে বলব যে, ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল ২০২৪ একটু সংবিধান-বিরোধী বিল।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারতে মুসলমান শাসকদের সময় থেকেই ওয়াকফ সম্পত্তি বাড়তে থাকে। আবার এটাও সত্য যে, ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে অনেক দুর্নীতি হয়েছে। বিজেপি সেটাই বলছে আসল কথা বাদ দিয়ে। আলাউদ্দিন খিলজী (১২৯৬-১৩১৬) দুর্নীতিগ্রস্ত মোতোয়ালীদের চরম শাস্তি দিয়েছিলেন। মানুষের লোভ সমাজে আছে। তার শাস্তির নিয়মও আছে। আকবরের আমলেও এমন ঘটনায় শাস্তি দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এসবকে অজুহাত করে এমন একটা কালা বিল আনা যায় না।
আমাদের পার্টি সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস প্রথম থেকেই এই বিলের প্রতিবাদ করে আসছে। আমাদের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কড়া মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। সংসদীয় কমিটিতে দু’জন সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও নাদিমুল হক তাঁদের যোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে বিভেদ ও হিংসা সৃষ্টি করার জন্য নরেন্দ্র মোদি সরকার এসব করছে। প্রথমেই বলেছি এই আইন চালু হলে দেশের গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদ নষ্ট হবার পক্ষে যথেষ্ট হবে। আপমানিত হবে আমাদের শ্রদ্ধার সংবিধান। আসুন, প্রতিবাদের মিছিলে নাম লেখাই।