শখের সাহিত্যিক ছিলেন না মহাশ্বেতা দেবী। খ্যাতির মোহ ছিল না। দূরে বসে নয়, তিনি সাধারণ মানুষের কথা লিখেছেন ঘনিষ্ঠভাবে মেশার পর। তাদের দুঃখ, দুর্দশা জানার পর। এইভাবেই তিনি একটা সময় হয়ে উঠেছিলেন সমাজের বঞ্চিত-নিপীড়িতের কণ্ঠস্বর। অবহেলিত মানুষের অধিকার নিয়ে লিখেছেন। তাঁদের জন্য কাজ করেছেন।
জন্ম ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি। ঢাকায়। বাবা কল্লোল যুগের সাহিত্যিক মণীশ ঘটক। মা ধরিত্রী দেবী। কাকা ছিলেন চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। শিল্প সাহিত্যের ঐতিহ্যমণ্ডিত পরিবারে বড় হয়েছেন মহাশ্বেতা। ছাত্রী হিসেবে ছিলেন মেধাবী। কিছুদিন পড়াশোনা করেছেন শান্তিনিকেতনে। পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের আশীর্বাদ। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দুটো কবিতা উপহার দিয়েছিলেন।
১৯৩৯ সাল। তখন অষ্টম শ্রেণি। খগেন্দ্রনাথ সেন সম্পাদিত ‘রং মশাল’ পত্রিকায় প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় মহাশ্বেতার। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত লেখাটির শিরোনাম ‘ছেলেবেলা’।
আরও পড়ুন-পানচাষিদের স্বার্থে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ প্রশাসনের
১৯৪৭ সালে ঘর বাঁধেন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে। ১৯৪৮ সালে জন্ম হয় একমাত্র পুত্র নবারুণের। মহাশ্বেতা গভীরভাবে লেখালিখির মধ্যে ডুবে যান মূলত বিয়ের পরই। এক সময় সুমিত্রা দেবী ছদ্মনামে ‘সচিত্র ভারত পত্রিকা’য় ফিচার ও গল্প লিখতে শুরু করেন। লেখেন বীরাঙ্গনা ঝাঁসির রানির উপর। ‘দেশ’ পত্রিকায় সেটা ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। ‘ঝাঁসির রাণী’ বই আকারে প্রকাশিত হয় ১৯৫৬ সালে। ওই বছরই ঐতিহাসিক পটভূমিকায় খুদাবক্স ও মোতির প্রেমের কাহিনি অবলম্বন ‘নটী’ উপন্যাস রচনা করেন। ১৯৫৮ সালে লোকায়ত নৃত্যগীতির আলোকে রচনা করেন ‘মধুরে মধুরে’ উপন্যাস। ১৯৫৯ সালে লেখা ‘প্রেমতারা’ উপন্যাসটি রচনা করেন। এই পর্বে তিনি বিশেষ আঙ্গিকে ‘যমুনা কী তীর’ (১৯৫৮), ‘তিমির লগন’ (১৯৫৯) ‘রূপরেখা’ (১৯৬০), ‘বায়োস্কোপের বাক্স’ (১৯৬৪) ইত্যাদি উপন্যাস পাঠকদের উপহার দেন।
আরও পড়ুন-আন্তর্জাতিক লজ্জা : মুখ্যমন্ত্রী, বিশ্ব মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টেও বিজেপির বাংলা-বিদ্বেষের কথা
গত শতকের ছয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে মহাশ্বেতা রাজনৈতিক চেতনায় ঋদ্ধ ইতিহাস নির্ভর কাহিনির আলোকে ব্যতিক্রমধর্মী কয়েকটি উপন্যাস রচনা করেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘আঁধার মানিক’ (১৯৬৬), ‘কবি বন্দ্যঘটি গাঞির জীবন ও মৃত্যু’ (১৯৬৭)।
তৃতীয় পর্বের সাহিত্যকর্মে অন্ত্যজ শ্রেণির দলিত মানুষের ইতিহাস, যাপিত জীবন তুলে ধরেছেন। লিখেছেন ‘হাজার চুরাশির মা’ (১৯৭৪), ‘অরণ্যের অধিকার’ (১৯৭৫) ‘চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর’ (১৯৮০), ‘বিরসা মুণ্ডা’ (১৯৮১), ‘অক্লান্ত কৌরব’ (১৯৮২) ‘সুরজ গাগরাই’ (১৯৮৩), ‘টেরোডাকাটিস, পূরণসহায় ও পিরথা (১৯৮৭), ‘ক্ষুধা’ (১৯৯২), কৈবর্ত খণ্ড (১৯৯২) ইত্যাদি উপন্যাস। তাঁর লেখা ছোটগল্পের সংকলনগুলোর মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য ‘শালগিরার ডাকে’ (১৯৮২), ‘ইটের পরে ইট’ (১৯৮২), ‘হরিরাম মাহাতো’ (১৯৮২), ‘সিধু কানুর ডাকে’ (১৯৮৫) ইত্যাদি।
১৯৮০ সালে বাবা মণীশ ঘটকের প্রয়াণের পর মহাশ্বেতা তাঁর বাবার বিকল্পধারার লিটল ম্যাগাজিন ‘বর্তিকা’ সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯২ সালে জেনেভা মহিলা সম্মেলনে প্রতিনিধিত্ব করেন ভারতের। তাঁর সাহিত্যকর্ম ইংরেজি, জার্মান, জাপনি, ফরাসি, ইতালীয় ভাষার অনূদিত হয়েছে। সেইসঙ্গে অনূদিত হয়েছে ভারতের বিভিন্ন ভাষায়।
আরও পড়ুন-ধরাশায়ী বিজেপি, খেজুরির দুই সমবায়ে বিপুল জয় তৃণমূলের
‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসের জন্যে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান। এছাড়াও লাভ করেন জ্ঞানপীঠ পুরস্কার, ভুবনমোহিনী দেবী পদক, নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য স্বর্ণপদক, পদ্মশ্রী সম্মাননা, জগত্তারিণী পুরস্কার, বিভূতিভূষণ স্মৃতি সংসদ পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত লীলা পুরস্কার। ১৯৯৭ সালে ম্যাগসাসাই পুরস্কার পান আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করার জন্যে। ১৯৯৮ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডক্টরেট প্রদান করে। ২০০১ সালে ভারতীয় ভাষা পরিষদ সম্মান লাভ করেন। ২০১১ সাল থেকে কয়েক বছর পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০১৬-র ২৮ জুলাই প্রয়াত মহাশ্বেতা দেবী। আজও তিনি চর্চিত, পঠিত। তাঁর গল্প-উপন্যাস বহু বিশেষ করে ‘হাজার চুরাশির মা’ পাঠককে আন্দোলিত করে। ভাবায়।