স্মরণে সত্যেন

তিনি বিশ্ববন্দিত বাঙালি। যাঁর কালজয়ী তত্ত্বে পদার্থবিদ্যায় খুলে গিয়েছিল নয়া দিগন্ত! চমকে গিয়েছিলেন স্বয়ং আইনস্টাইনও। তিনি আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম পথিকৃৎ বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। পয়লা জানুয়ারি ছিল তাঁর জন্মদিন। এই দিনটি উপলক্ষে তাঁকে স্মরণ করলেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

আত্মমগ্ন বিজ্ঞানী
ওরা নিন্দুক; মন্দ কথায় রয়; তাই তো ওরা তাঁরে আত্মভোলা কয়! নাহ্ তিনি আত্মভোলা নন। তিনি আত্মমগ্ন। তিনি বিজ্ঞান, সাহিত্য, স্বদেশিকতা, সঙ্গীত এবং সমাজের সামগ্রিক উন্নয়ন হেতু সুচিন্তায় মগ্ন। তিনি নিবিড় অধ্যবসায়ী, মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত, সর্বভুক পাঠক, সাহিত্য অনুরাগী, সঙ্গীতজ্ঞ, সরল, স্বদেশি, গণিতজ্ঞ প্রভৃতি সবিশেষ বিশেষণে বিশেষায়িত; তিনি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাঁর সমসাময়িক ভারতবর্ষের বৈজ্ঞানিক, রাজনৈতিক এবং আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের কথা ভেবে তিনি অনেকসময় কিছু মৌলিক ভাব সম্পৃক্ত ধারণা ব্যক্ত করেছেন, যেগুলোকে অনেকেই ভুল বুঝেছেন, না হয় বুঝতে পারেননি। সমালোচকরা অনেকেই আজও মন্দ কথা বলেন। তবে তিনি তাঁর একনিষ্ঠ চিন্তা এবং কর্মের মাধ্যমে নিজের সাবলীলতা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই।

আরও পড়ুন-দিনের কবিতা

পরিচয়
বিশ্ববরেণ্য এই বৈজ্ঞানিক প্রতিভা ১৮৯৪ সালের ১ জানুয়ারি অবিভক্ত ভারতবর্ষের নদিয়া জেলার বড় জাগুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা সুরেন্দ্রনাথ এবং মাতা আমোদিনীর সাতটি সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় তিনিই। ছোট ছয় বোনের একমাত্র বড় দাদা সত্যেন। পিতামহ অম্বিকাচরণ এবং পিতা সুরেন্দ্রনাথ উভয়েই সরকারি চাকরি করতেন; পরিবার উচ্চশিক্ষিত, বলা ভাল ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত পরিবার। সমাজে অভিজাত এবং প্রতিষ্ঠিত; খুব স্বাভাবিকভাবেই জ্যেষ্ঠ পুত্র সত্যেনের পড়াশোনাও তদনুরূপ শুরু হয়।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি
পাঁচ বছর বয়সেই সত্যেনকে ভর্তি করা হয় জোড়াবাগান হোমের কাছে নর্মাল স্কুলে, যে স্কুলে কিছু সময়ের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছাত্র ছিলেন। তারপর তাঁকে হেডমাস্টার ক্ষুদিরাম বসুর তত্ত্বাবধানে নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলে ভর্তি করা হয়; সেখানে শিক্ষা প্রসঙ্গে ক্ষুদিরাম বসুর উদার চিন্তাভাবনা তাঁকে গভীরভাবে স্পর্শ করে; ছোটবেলাতেই স্বদেশি চিন্তাধারার সঙ্গে আলাপ। তবে মা-বাবার চিন্তা কমেনি, ব্যাপক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে সত্যেনের মেধার বিকাশ ঘটাতে, খুব ভাল পড়াশোনার কথা ভেবে তাঁকে ভর্তি করা হয় হিন্দু স্কুলে।

আরও পড়ুন-স্বাস্থ্য পরিষেবায় ১০ বছরে লগ্নি ১.৫ লক্ষ কোটি

তখন ১৯০৭ সাল।
প্রতিযোগিতা বলে প্রতিযোগিতা! একদিকে হেয়ার স্কুল, অন্যদিকে হিন্দু স্কুল। একদিকে হেয়ার স্কুলের হেডমাস্টার একজন নামজাদা পালি স্কলার ঈশান ঘোষ, তো অন্যদিকে হিন্দু স্কুলের রসময় মিত্র, একজন যোগ্য হেডমাস্টার এবং নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। বলিষ্ঠ ইংরেজি শিক্ষার কথা ভেবে তিনি ছাত্রদের জন্য ইংলিশ কম্পোজিশন, গ্রামার, এবং ট্রান্সলেশনের উপর বই লিখেছিলেন। ছাত্রদের আবশ্যিকভাবে পড়ানো হত ইংরেজি, বাংলা, ইতিহাস, ভূগোল, অঙ্ক, এবং সংস্কৃত। সত্যেনের প্রিয় বিষয় ছিল অঙ্ক এবং বিজ্ঞান; তবে হিন্দু স্কুলের সুদক্ষ শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় সাহিত্য ও সংস্কৃতের প্রতিও তাঁর গভীর অনুরাগ জন্মায়। হিন্দু স্কুলের বাংলার শিক্ষক শরৎচন্দ্র শাস্ত্রী মহাশয়ের ভক্তিপূর্ণ শিক্ষা প্রদানই সত্যেনের মধ্যে বিজ্ঞানের বাইরেও সাহিত্য–সংস্কৃতি প্রেমের জন্ম দেয়।
ভবিষ্যৎ গড়ার লক্ষ্যে
হিন্দু স্কুলের লেজেন্ডারি অঙ্কের স্যার উপেন্দ্রনাথ বক্সি একবার একটি টেস্টে সত্যেন্দ্রনাথের অঙ্কের উত্তরপত্র দেখে তাঁর অসামান্য বৈজ্ঞানিক প্রতিভার আন্দাজ করেছিলেন। খুশি হয়ে শুধুমাত্র ১০০-র মধ্যে ১১০ নম্বরই দেননি; করেছিলেন আশীর্বাদ, বলেছিলেন একদিন সত্যেন অগুস্তাঁ-লুই কোশি কিংবা পিয়ের-সিমোন লাপ্লাসের মতো পৃথিবী বিখ্যাত গণিতজ্ঞ হয়ে উঠবে। উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি ১৯০৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সহপাঠী হিসেবে পান জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জি, নিখিলরঞ্জন সেন, পুলিনবিহারী সরকার, মানিকলাল দে, শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ, এবং অমরেশ চক্রবর্তীর মতো প্রতিভাবানদের। মেঘনাদ সাহা ওঁদের দু’বছর পর প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হন। এঁদের সকলের মধ্যে সত্যেন ছিলেন সবচেয়ে মেধাবী; ইন্টারমিডিয়েট, বিএসসি এবং এমএসসি সবেতেই তিনি প্রথম স্থানাধিকারী। তবে তাঁরা প্রত্যেকেই নিবিড় অধ্যবসায় ও বৈজ্ঞানিক গবেষণায় শুধুমাত্র নিজের ভবিষ্যৎ গড়েছেন তা নয়; সমসাময়িক ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান নীতি এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার রূপরেখা তৈরির ক্ষেত্রে তাঁরা একত্রে পথপ্রদর্শক হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। ওই ছাত্রদলের প্রত্যেকেই স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময়ই সত্যেন্দ্রনাথের বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশি চিন্তাধারা এবং সাহিত্য–সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে পথচলা শুরু।
নবজাগরণে বিজ্ঞান ও সত্যেন বসু
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাসে প্রাচীন ভারতীয়রা তাঁদের স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করেছেন। বৈজ্ঞানিক উৎসাহও ছিল বেশ; তবে ওই বৈজ্ঞানিক চিন্তাবিদদের কাছে তাঁদের তত্ত্বের পরীক্ষামূলক যাচাই করার জন্য কোনও পদ্ধতি ছিল না। এই বিষয়টি আরও আশ্চর্যজনক যখন আমরা দেখি যে সেই সময়ে বিজ্ঞান দর্শনের একটি অংশ ছিল। ইউরোপীয় নবজাগরণের কোনও প্রভাব তখন ভারতীয় বিজ্ঞানের উপর পড়েনি। এমনকী পশ্চিমের দেশগুলোতেও বিজ্ঞান তখনও আধুনিক হয়ে ওঠেনি; গ্যালিলিও যখন একজন প্রকৃত বিজ্ঞানীর মতো কোনওপ্রকার অথরিটি, বিশেষ করে অ্যারিস্টটলিয়ান অথরিটির উপর কোনওপ্রকার বিশ্বাস না রেখে পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের কথা বলেন, তারপর বিজ্ঞান তার আধুনিক রূপ পেতে শুরু করে। প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিদ্যা, শল্যচিকিৎসা, এবং ধাতুবিদ্যার মতো ফলিত বিজ্ঞানের বেশকিছু উন্নয়ন হলেও দ্বাদশ শতাব্দীর পর রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিদেশি আক্রমণের কারণে ভারতীয় বিজ্ঞান একেবারেই পিছিয়ে পড়ে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ব্রিটিশ শাসন এবং ইংরেজি শিক্ষা আসার আগে পর্যন্ত ভারতবর্ষে বিজ্ঞানের অন্ধকার যুগ চলেছিল। উনিশ শতকের রেনেসাঁস আমাদের দেশে আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা করে। ১০ এপ্রিল, ১৮০২ সালে দ্যা গ্রেট ট্রিগনোমেট্রিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া, ৪ মার্চ, ১৮৫১ সালে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া, ১৫ জানুয়ারি, ১৮৭৫ সালে ভারতীয় আবহাওয়া দফতর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আধুনিক বিজ্ঞানের জয়যাত্রা প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম মডার্ন সায়েন্টিফিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ২৯ জুলাই, ১৮৭৬ সালে ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার তৈরি করেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স। ডাঃ সরকার তাঁর পেশেন্ট বিজয়নগরমের মহারাজার আর্থিক সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করেন একটি সায়েন্টিফিক ল্যাবরেটরি। উনিশ শতকের শেষের দিকে, ঠিক এই সময়েই ভারতবর্ষের বৈজ্ঞানিক ইতিহাসে আবির্ভূত হন তিনজন উজ্জ্বল নক্ষত্র বিজ্ঞানী— আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এবং তাঁদের অনেকটাই জুনিয়র রামানুজন। ভারতবর্ষে আধুনিক বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ রচনা করেন এই তিনজন।
নবজাগরণের প্রভাব একটু দেরিতে হলেও, বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই বৈজ্ঞানিক গবেষণা ক্ষেত্র দারুণভাবে প্রশস্ত হয়। ১৯১৩ সালে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটিতে বিজ্ঞানের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট পাঠ্যক্রম চালু হয় স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সৌজন্যে। এই সময়ই বিশ্বের বৈজ্ঞানিক মহলে তিনজন ভারতীয় বিজ্ঞানীর গবেষণা সকলের নজর কাড়ে— ১৯২০ সালের কোনও গ্যাসের তাপীয় আয়নীকরণ সংক্রান্ত মেঘনাদ সাহার দ্য সাহা ইক্যুয়েশন; ১৯২৪–’২৫ সালে প্রকাশিত সত্যেন বসুর তাপগতিবিদ্যার দ্য বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স; এবং ১৯২৮ সালে উন্মোচিত ভারতীয় পদার্থবিদ স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামনের দ্য রামন এফেক্ট। এছাড়াও বিজ্ঞানী জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখার্জি, শান্তিস্বরূপ ভাটনগর এবং বীরবল সাহানির মতো প্রতিভাবান গবেষকদের কাজ ভারতীয় বিজ্ঞানকে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড় করিয়েছিল। আজকে একথা আমাদের স্বীকার করতে কোনও দ্বিধা নেই যে, আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম ফাদার ফিগার হলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর সফরের আগে ব্যবস্থাপনা দেখলেন দুই মন্ত্রী

কর্মজীবন ও গবেষণা
মাত্র একুশ বছর বয়সে, ১৯১৫ সাল এই ভারতীয় গণিতজ্ঞ ও তাত্ত্বিক পদার্থবিদ এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন; তবে তার আগেই কুড়ি বছর বয়সে তিনি উষাদেবীকে বিয়ে করেন। কর্মজীবনের শুরুতেই ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির আওতাধীন রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে ১৯১৬–’২১ সাল অবধি তিনি আধুনিক গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞানের লেকচারার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর ১৯২১-এ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সের রিডার হিসেবে যোগ দেন। এখানেই তাঁর গবেষণা আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ছাত্রদের তড়িৎ-চুম্বকত্বের উপর জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের থিওরি এবং থার্মোডাইনামিক্সের পাঠ দেন। পড়ানোর সময় তাপগতিবিদ্যার একটি তাত্ত্বিক সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে তাঁর অনুমিত একটি ভুলের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে খুঁজে পান ‘বোসন’ কণার অস্তিত্ব। কণা পদার্থবিদ্যায় বোসন হল এক ধরনের মৌলিক কণা, যা বল-বাহক হিসেবে কাজ করে এবং কণা ও শক্তির মধ্যে মিথস্ক্রিয়া ঘটায়। লব্ধ পর্যবেক্ষণ থেকে তিনি জার্মান পদার্থবিদ ম্যাক্স প্লাঙ্কের কোয়ান্টাম রেডিয়েশন ল’-এর উপর ভিত্তি করে সনাতনী পদার্থ বিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়াই ‘প্লাঙ্কস ল অ্যান্ড দ্য হাইপোথিসিস অফ লাইট কুয়ান্টা’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র রচনা করেন।
প্রকাশনার জন্য পাঠালেও তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়নি, কারণ তাঁর তত্ত্ব তখনও ঠিক তাঁদের বোধগম্য ছিল না। নিরুপায় হয়ে গবেষণাপত্রটি বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে লিখে পাঠান; তিনি পড়ে বুঝতে পারেন সত্যেন বসুর তত্ত্বকথা; নিজেই জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে বিজ্ঞানী বসুর পক্ষে পাঠিয়ে দেন ‘সাইটশ্রিফ্ট ফার ফিজিক্’ জার্নালে। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার পর পৃথিবীর সামগ্রিক বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। সেদিনের সেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তত্ত্ব কোয়ান্টাম স্ট্যাটিসটিক্সের পথ উন্মোচন করেছে— বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে ওই যুগান্তকারী খোঁজ বসু–আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স নামে খ্যাত।
ফলস্বরূপ তিনি ইউরোপের এক্স-রে এবং ক্রিস্টালোগ্রাফি ল্যাবরেটরিতে লুই ডে ব্রগলি, মেরি কুরি এবং আইনস্টাইনের সঙ্গে দু’বছর কাজ করেন। তাঁরা একত্রে পদার্থ বিজ্ঞানকে পদার্থের বসু–আইনস্টাইন কনডেনসেট, বসু–আইনস্টাইন ডিস্ট্রিবিউশন, বসু–আইনস্টাইন কোরিলেশনস-এর মতো তত্ত্ব উপহার দেন। বিজ্ঞানী বসু তাঁর নিরলস গবেষণায় খুঁজে পান বোসন কণার অস্তিত্ব, আবিষ্কার করেন আইডিয়াল গ্যাসের অনুরূপ বোসন গ্যাস। আবিষ্কার করেন ফোটন গ্যাস এবং প্রতিষ্ঠা করেন দ্য আইডিয়াল বোস ইক্যুয়েশন অব স্টেট। বোসনিক স্ট্রিং থিওরিও তাঁরই খোঁজ। বোসনিক স্ট্রিং থিওরি হল এমন একটি তত্ত্ব যেখানে কণাগুলিকে শূন্যমাত্রিক বিন্দুর পরিবর্তে একমাত্রিক স্ট্রিং হিসেবে বর্ণনা করা হয় যা কণার ভর ও শক্তির উৎস নির্ধারণ করে।
পলিম্যাথ সত্যেন
ম্যাথ এবং ফিজিক্সের বাইরেও তিনি কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, মিনেরোলজি, অ্যানথ্রোপলজি, জিওলজি, জুলজি, বায়োটেকনোলজি, আর্টস, দর্শন, সাহিত্য এবং সঙ্গীতের প্রতি গভীরভাবে উৎসাহী ছিলেন। তিনি একজন পটু এসরাজ বাদক ছিলেন, নিজেই সুর বাঁধতেন, গাইতেন এবং শুনতেন ভক্তিভরে। সাহিত্য, বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁর টান এবং জ্ঞান ছিল অসামান্য। কবি বুদ্ধদেব বসু, অন্নদাশঙ্কর রায়, ভাষাবিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, গায়িকা রাজেশ্বরী দত্ত হয়ে উঠেছিলেন তাঁর সাহিত্যসঙ্গী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গেও মাঝেমধ্যে চলত আলাপচারিতা। কবিগুরু তাঁর বিজ্ঞানধর্মী বিশ্বপরিচয়, অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁর জাপানে ভ্রমণ রচনা, এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর অর্কেস্ট্রা কাব্যগ্রন্থ সত্যেন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেছিলেন।

আরও পড়ুন-উড়ে যাই দূরে যাই

কিছু পাওয়া, কিছু না-পাওয়া
বিখ্যাত বসু–আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স এবং ইউনিফায়েড ফিল্ড থিওরির উপর অনবদ্য কাজের জন্য বিজ্ঞানী কাদেরেশ্বর ব্যানার্জি, দৌলত সিং কোঠারি, এস এন বাগচী এবং এ কে দত্ত ১২ জানুয়ারি, ১৯৫৬ সালে সত্যেন বসুর নোবেল পুরস্কারের জন্য একটি চিঠি দিয়েছিলেন। দুঃখজনকভাবে সেদিন নোবেল কমিটির পক্ষ থেকে বিজ্ঞানী ওস্কার বেঞ্জামিন ক্লেইন বিজ্ঞানী বসুর কাজের মূল্যায়ন করে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার উপযুক্ত মনে করেননি। ভারতবাসীর জন্য এটি আজও বেদনাদায়ক!
তবে ১৯৫৪ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত করেন এবং ১৯৫৯ সালে তিনি ভারতবর্ষের জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত হন; এই পদে তিনি দীর্ঘ পনেরো বছর ছিলেন। ১৯৫৮ সালে তিনি লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো উপাধি লাভ করেন। তিনি ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এবং ইন্ডিয়ান সায়েন্স কংগ্রেসের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। তিনি একদা রাজ্যসভার মনোনীত সাংসদ নির্বাচিত হন। ভারতীয় বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর অনস্বীকার্য অবদানের কথা মাথায় রেখে, ১৯৮৬ সালে কলকাতার সল্টলেকে এস এন বোস ন্যাশনাল সেন্টার ফর বেসিক সায়েন্সেস প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৪ সালে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে একটি ১০০ টাকার পোস্টাল স্ট্যাম্পের সূচনা করা হয়। ৪ জুন, ২০২২ সালে গুগল ডুডল তাঁকে ফিচার করে। কেউ বলেন খেয়ালি, কেউ বলেন আলসে, কিন্তু না, তিনি একজন আত্মমগ্ন ও আত্মসন্তুষ্ট সাধক বিজ্ঞানী। তিনি ৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪ সালে আমাদের ছেড়ে না-ফেরার দেশে চলে যান।

Latest article