সেই সময় চারদিক থেকে নিগৃহীত হচ্ছিলেন পল রোবসন। রেকর্ডিং কোম্পানিগুলো তাঁর গান প্রকাশে অনিহা দেখাচ্ছিলেন, স্টেজ শো করতে পারছিলেন না, হলিউড থেকেও তিনি তখন বিতাড়িত হয়েছিলেন আর এই সময়ই তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন স্টেজ শো করতে। আর এখানে পল রোবসন ‘ওল্ড ম্যান রিভার হি ডোন্ট সে নাথিং’ এই গানটি গান । আর এই গানটা মন ছুঁয়ে যায় তাঁর। এই গানটির আদলে তৈরি করেন সেই কালজয়ী অসাধারণ গান ‘বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও নিঃশব্দে নীরবে ও গঙ্গা তুমি বইছো কেন’। আর তিনি হচ্ছেন ভূপেন হাজারিকা।
আরও পড়ুন-রাসযাত্রা, তত্ত্বে ও কাহিনিতে
আসামের জন্মগ্রহণ করলেও তিনি বাঙালির ঘরের ছেলে ছিলেন। সারা জীবন ধরে তিনি একের পর এক অসাধারণ গান উপহার দিয়ে গিয়েছেন আপামর বাঙালিকে। তিনি হচ্ছেন কিংবদন্তি কণ্ঠের অধিকারী, গায়ক, সংগীতজ্ঞ, কবি, চলচ্চিত্রনির্মাতা ও সুরকার ভূপেন হাজারিকা। যিনি উত্তাল কণ্ঠে বলেছিলেন— ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি ছুটে ছুটে আয়, আয় মরণ ভুলে গিয়ে ছুটে ছুটে আয়’।
ভূপেন হাজারিকা ১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আসামের তিনসুকিয়ার সাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নীলকান্ত হাজারিকা এবং শান্তিপ্রিয়া হাজারিকার দশ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সকলের বড়।
আরও পড়ুন-নিজ কেন্দ্রে বিজয়া সম্মিলনীতে এসে উষ্ণ অভ্যর্থনায় ভাসলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
ভূপেন হাজারিকা জন্মগত প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। আসামের সংস্কৃতি এবং লোকগানকে আঁকড়ে ধরে বড় হয়েছেন তিনি। মাত্র দশ বছর বয়স থেকেই তিনি গান লিখে তাতে সুর দিতেন। একজন শিশুশিল্পী হিসাবে অসমের চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের সূচনা ঘটেছিল। মাত্র ১২ বছর বয়সে ‘ইন্দুমালতী’ নামক একটি অসমীয়া ছবিতে ‘বিশ্ববিজয় নওজোয়ান’ শিরোনামের একটি গান গেয়েছিলেন ভূপেন হাজারিকা।
গুয়াহাটির কটন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট আর্টস এবং এরপর কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর অর্জন করেন। ১৯৫২ সালে তিনি কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল ‘প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষায় শ্রবণ দর্শন পদ্ধতি ব্যবহার করে ভারতের মৌলিক পদ্ধতি প্রস্তুতি সংক্রান্ত প্রস্তাব’। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন পল রোবসনের গান শোনেন তিনি। তাঁকে দেখে তাঁর কথা শুনে মোহিত হয়ে যান ভূপেন হাজারিকা আর তারপরেই পল রোবসনের ওল্ড ম্যান রিভার হি ডোন্ট সে নাথিং এই গানটির আদলে ‘বিস্তীর্ণ দুপারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও…’-এর মতো কালজয়ী গানের সৃষ্টি করেন।
আরও পড়ুন-জামা খুলিয়ে অত্যাচার করেছেন বিজেপি নেতা লোকনাথ, বিস্ফোরক যুব মোর্চা কর্মী
পড়াশোনা শেষ করে ভারতবর্ষে ফিরে আসেন ভূপেন হাজারিকা। কিছুদিন তিনি গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এরপর গুয়াহাটি থেকে চলে আসেন কলকাতায়। এবং চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা শুরু করেন। সংগীত পরিচালনার পাশাপাশি তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘের (আইপিটি) একজন সক্রিয় কর্মী এবং নেতা হিসেবে গণনাট্যের কাজও করতে শুরু করেন।
গীতিকার আনন্দিরাম দাস, কমলানন্দ ভট্টাচার্য আর পার্বতীপ্রসাদ বড়ুয়ার মাধ্যমে আসামের গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন ভূপেন হাজারিকা। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল বরণগীত, বিহুগীত, চা-মজদুরের গান, গোয়ালপাড়ার গান ইত্যাদি ইত্যাদি। এই গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর পরিচিতি শৈশবেই ঘটেছিল এবং এই সংস্কৃতিতে তিনি প্রভাবিতও হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে যিনি ভূপেন হাজারিকাকে প্রভাবিত করেছিলেন তিনি ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব জ্যোতিপ্রসাদ। ভূপেন হাজারিকার সংগীতজীবনের পথচলা শুরু হয়েছিল হিন্দুস্থানি ক্লাসিক্যাল সংগীত ও উচ্চাঙ্গ নৃত্যের ওস্তাদ বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার হাত ধরে।
আরও পড়ুন-শ্রমিকদের স্বার্থে, সামাজিক সুরক্ষার লক্ষ্যে কাজ করছে তৃণমূল
অসমীয়া চলচ্চিত্রে সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে গানের জগতে প্রবেশ করলেও ভূপেন হাজারিকা পরবর্তীকালে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় প্রচুর গান গেয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি গেয়েছিলেন ‘জয় জয় নবজাতক বাংলাদেশ, জয় জয় মুক্তি বাহিনী, ভারতীয় সৈন্যের সাথে রচিলে, মৈত্রীর কাহিন’। এই গানটি সকলের হৃদয় জয় করতে সক্ষম হয়েছিল।
ভূপেন হাজারিকা তার গানের মাধ্যমে মানুষের গল্প, সমাজের গল্প তুলে ধরতেন। গানের মাধ্যমে গল্প বলার দক্ষতা, বিরহ, মিলন, প্রেম, একাকীত্ব, দুঃখ আনন্দ আবেগের কথা সুন্দরভাবে তুলে ধরার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। তার গাওয়া যে গানগুলো সকলের হৃদয় স্পর্শ করেছিল এবং এখনও করে সেই গানগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ‘মানুষ মানুষের জন্য,জীবন জীবনের জন্য,একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না’। অথবা ‘দোলা হে দোলা, আঁকাবাঁকা পথে মোরা কাধে নিয়ে ছুটে যাই রাজা মহারাজাদের দোলা’ কিংবা ‘সাগর সঙ্গমে সাঁতার কেটেছি কত’ আবার ‘গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা, চোখে দুই জলের ধারা মেঘনা যমুনা’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
আরও পড়ুন-মধ্যপ্রদেশ: বাসের সঙ্গে গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে মৃত বহু
ভূপেন হাজারিকা প্রিয়ংবদা প্যাটেল-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ভূপেন ও প্রিয়ংবদার একমাত্র সন্তান হচ্ছেন তেজ হাজারিকা। প্রিয়ংবদার সঙ্গে ১৩ বছর ঘর করার পর তাঁরা আলাদা হয়ে যান। তবে ভূপেন হাজারিকার সঙ্গে প্রিয়ংবদার বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি। কিন্তু তবুও তাঁরা আলাদা আলাদা থেকেছেন। ভূপেন হাজারিকার জীবনে এরপরেও প্রেম এসেছিল। কল্পনা লাজমির সঙ্গে তাঁর একটি অসমবয়সি প্রেম দানা বেঁধেছিল। কল্পনা লাজমি ছিলেন ভূপেন হাজারিকার একজন ভক্ত। এই ভক্তই ভূপেন হাজারিকার মতো অগোছালো, বেহিসাবি মানুষটিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৭৬ সাল থেকে তাঁরা দুজনে একত্রে একটি ফ্ল্যাটে বসবাস শুরু করেন এবং আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে কল্পনা লাজমিকে তার সঙ্গিনী হিসাবে পরিচয় দিতে শুরু করেন ভূপেন হাজারিকা। কল্পনা লাজমির পরিচালিত অন্যতম ছবি রুদালির সংগীতের দায়িত্বে ছিলেন ভূপেন হাজারিকা। এ-ছাড়াও তিনি বহু অসমীয়া, বাংলা এবং হিন্দি চলচ্চিত্রে গায়ক সুরকার পরিচালক হিসাবে কাজ করেছেন।
আরও পড়ুন-মধ্যপ্রদেশ: বাসের সঙ্গে গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে মৃত বহু
শিল্পী জীবনে বহু পুরস্কারে ভূষিত হন ভূপেন হাজারিকা। ১৯৭৫ সালে শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক চলচ্চিত্র ‘চামেলি মেমসাহেব’ ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে পদ্মশ্রী লাভ করেন তিনি, এ-ছাড়াও পদ্মভূষণ, দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কার, অসমরত্ন পুরস্কার ইত্যাদি পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। মৃত্যুর পরে তিনি ২০১৯ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ভারতরত্নে ভূষিত হন।
আরও পড়ুন-হামলার নাটক সাজাতে ব্যর্থ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী
২০১১ সালের ৩০ জুন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন ধীরুভাই আম্বানি হাসপাতালে ভর্তি হন ভূপেন হাজারিকা। এবং সেই বছরের ৫ নভেম্বর কিডনির সমস্যার কারণে তাঁর মৃত্যু ঘটে। আসামে শেষকৃত্যসম্পন্ন হয়। সেই শেষকৃত্যে যোগ দিয়েছিলেন প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ।
২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর এই প্রখ্যাত শিল্পীর ৯৬তম জন্মদিনে গুগল ডুডলের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।