গত ২৮ জানুয়ারি মুক্তি পেয়েছে ‘দ্য স্টোরিটেলার’। গল্পের কেন্দ্রে তারিণীখুড়ো বা তারিণী বন্দ্যোপাধ্যায়। ফেলুদা, প্রফেসর শঙ্কুর পরে এই চরিত্রটিকে নিয়ে আস্ত একটি সিরিজ লিখেছিলেন সত্যজিৎ রায়। রহস্য, রোমাঞ্চ, ভূত, ডাকাত, ম্যাজিক, বাঘ ইত্যাদি বিষয়ের গল্পগুলো এতটাই জমাটি যে পড়া শুরু করলে থামা যায় না। বেনিয়াটোলা লেন থেকে বালিগঞ্জে মাঝেমধ্যেই আসতেন তারিণীখুড়ো। ভুলু, ন্যাপলা, চটপটিদের নিজের জীবনের বিচিত্র গল্প শোনানোর জন্য। সিরিজের ‘গল্পবলিয়ে তারিণীখুড়ো’ গল্পটি ১৯৮৮ সালে লেখা। সত্যজিৎ রায়ের এই গল্পটিকেই চলচ্চিত্রে রূপ দিয়েছেন পরিচালক অনন্ত নারায়ণ মহাদেবন। নাম, ‘দ্য স্টোরিটেলার’ (The Storyteller)।
তারিণীখুড়ো চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন পরেশ রাওয়াল। বাঙালি চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত। সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, দারুণ অভিজ্ঞতা। তার উপর সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টি চরিত্র। বাঙালিদের আমার এমনিই ভাল লাগে। কারণ ওঁরা মনে যা ভাবেন, দ্বিধাহীনভাবে তা প্রকাশ করেন। সাহিত্যচর্চা থেকে শিল্পচর্চা-সংস্কৃতি বিষয়টা বাঙালির মজ্জাগত। কলকাতায় বহুবার এসেছি। মনে রাখতে হবে, লর্ডসে যেমন ক্রিকেট না খেললে কুলীন পর্যায় ক্রিকেটার হওয়া যায় না, ঠিক তেমন কলকাতায় পারফর্ম না করলে শিল্পী হওয়া যায় না। খুব সুন্দর কলকাতা শহর। এতবার এসেও আমার আশ মেটেনি। একই শহরে ইতিহাস এবং আধুনিকতা পাশাপাশি বসবাস করে।
এবার আসা যাক গল্পের কথায়। এটা মূলত তারিণীর ঘুরে দাঁড়ানোর কাহিনি। প্রতিশোধ নেওয়ার কাহিনি। তারিণী আপাত সহজ সরল মানুষ। স্মৃতিতাড়িত প্রৌঢ়। অবসরপ্রাপ্ত। মধ্যবিত্ত। বিপত্নীক। প্রয়াত স্ত্রীর ছবি নিয়ে ঘোরেন। তাঁর ছেলে আমেরিকায় প্রতিষ্ঠিত। ছেলের অনুরোধ সত্ত্বেও তারিণী আমেরিকায় যান না। তরুণ তারিণীকে তাঁর স্ত্রী এবং বন্ধুরা বারবার গল্প লেখার অনুরোধ করতেন। কিন্তু তারিণী পাশ কাটিয়ে যেতেন। গল্প বলাতেই তাঁর আনন্দ। একদিন অবসরপ্রাপ্ত তারিণীর নজরে পড়ে সংবাদপত্রের একটি বিজ্ঞাপন, যেখানে গারোড়িয়া নামে এক গুজরাতি ভদ্রলোক ‘স্টোরিটেলার’ চেয়েছেন। তারিণী কলকাতা ছেড়ে পাড়ি জমান আমেদাবাদের উদ্দেশে।
গারোড়িয়া ধনী ব্যক্তি। কাপড়ের ব্যবসায়ী। তিনি তারিণীকে জানান, তাঁর নিদ্রাহীনতার অসুখ রয়েছে। তিনি এমন এক গল্পকথককে খুঁজছেন, যিনি তাঁকে ঘুম পাড়াতে পারবেন বা বলা ভাল, যাঁর গল্প তাঁকে ঘুমের দেশে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। তবে শর্ত একটাই, সেই গল্প হতে হবে একান্ত মৌলিক। কোনও বইতে পড়া ধার করা গল্প তাঁকে শোনানো চলবে না।
আরও পড়ুন- ভালবাসার দিনে হিংসার হিসাব
শর্ত পছন্দ হয় তারিণীর। প্রতি রাতে গারোড়িয়ার সামনে উজাড় করতে থাকেন গল্পের ডালি। গারোড়িয়া অবিবাহিত। প্রৌঢ়। সমবয়সি তারিণীর সঙ্গে তাঁর একরকম বন্ধুতা রচিত হয়। গারোড়িয়া এক সময় তারিণীকে জানান, কেন তিনি বিয়ে করেননি। তাঁর যৌবনের কাঙ্ক্ষিতা নারী সরস্বতী অন্য এক পুরুষের গলায় মালা দেন। গারোড়িয়াকে তিনি বাতিল করেন এই কারণেই যে, গারোড়িয়া অশিক্ষিত, পরিশীলিত নন। পরবর্তী সময়ে গারোড়িয়া ব্যবসায় সাফল্য পান। অন্যদিকে সেই মহিলার স্বামী ততদিনে প্রয়াত। গারোড়িয়া ওই মহিলার সামনে নিজেকে শিক্ষিত ও পরিশীলিত প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। তারিণীকে ডেকে এনে তাঁর কাছে অনিদ্রার অছিলায় গল্প শোনার মূল উদ্দেশ্য, তাঁর বলে যাওয়া কাহিনিগুলিকে আত্মসাৎ করা এবং ছদ্মনামে, নিজের ছবি-সহ গুজরাতি সাহিত্য পত্রিকায় সেগুলো প্রকাশ করা।
যদিও গারোড়িয়ার এই কীর্তি খুব বেশিদিন চলল না। স্থানীয় এক পাঠাগারে তারিণী যেতে শুরু করেন। সেখানেই এক গুজরাতি পত্রিকায় ‘গোর্কি’ ছদ্মনামে লিখিত একটি গল্প নজরে আসে তাঁর। সঙ্গে লেখক হিসাবে যাঁর ছবি ছাপা হয়, তিনি গারোড়িয়া। গ্রন্থাগারিকের কাছে তিনি গল্পটির বিষয়বস্তু জানতে চান। গ্রন্থাগারিক তাঁকে যা জানান, সেটি তাঁরই বলা গল্প। তারিণী আরও জানতে পারেন, গারোড়িয়া ‘গোর্কি’ নামে বেশ বিখ্যাত। ব্যাপারটা বুঝতে অসুবিধা হয় না তারিণীর। নিজেকে সংস্কৃতিমান প্রমাণ করে গারোড়িয়া ওই মহিলাকে মুগ্ধ করতে চান। এই তঞ্চকতার প্রতিশোধ নিতে উদ্যত হন তারিণী।
তারিণীর ভূমিকায় পরেশ রাওয়াল বলা যায় জাদু দেখিয়েছেন। এই বয়সেও তিনি নিজেকে যথেষ্ট ভেঙেছেন। ভেবেছেন চরিত্রটি নিয়ে। গারোড়িয়া চরিত্রে আদিল হুসেনও প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। গারোড়িয়ার জীবনের অপ্রাপ্তি আর ধূর্ততার মিশেলকে তিনি একত্র করেছেন অসামান্য দক্ষতায়। সব মিলিয়ে এই ছবি বহুস্তরীয়। একমাত্রিক বিন্যাসে দেখা সম্ভব নয়। তবে ছবিটি যে ত্রুটিহীন, সেটা কিন্তু বলা যায় না। এর সব থেকে বড় সমস্যা মন্থর গতি। কোনও কোনও দৃশ্য অতি-দীর্ঘ। যা চাপ ফেলতেই পারে দর্শকের মাথায়। আরেকটি বিষয় বড় বেশি কানে লেগেছে, সেটা হল, বারবার তারিণীকে বাঙালি প্রমাণ করার জন্য তাঁকে দিয়ে অকারণে বাংলা সংলাপ বলানো হয়েছে, বাংলা গান গাওয়ানো হয়েছে। ছবির আবহসঙ্গীতেও মেশানো হয়েছে সত্যজিতের সুর ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’। এ যেন সত্যজিতের গন্ধ ছড়িয়ে যুদ্ধ জয়ের মরিয়া চেষ্টা। এর ফলে বরং পরিচালকের অক্ষমতাই প্রকাশ পেয়েছে।
এতকিছুর পরও ‘দ্য স্টোরিটেলার’ (The Storyteller) কোথাও যেন মনের মধ্যে ছাপ রেখে যায়। রহস্য আছে। পাশাপাশি অদ্ভুত সারল্য ছড়িয়ে রয়েছে সমগ্র ছবি জুড়ে। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ডিজনি হটস্টারে দেখে নেওয়া যায়।