বেলা

পুরুষশাসিত, সংস্কারাচ্ছন্ন সমাজে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার লড়াই করেছিলেন তিনি। এক সাধারণ আটপৌরে বাঙালি মেয়ে থেকে হয়েছিলেন জনপ্রিয় সঞ্চালিকা এবং রান্নার বইয়ের লেখিকা। সদ্য মুক্তি পেল আকাশবাণীর ‘মহিলা মহল’-খ্যাত সেই জিনিয়াস বেলা দে-র বায়োপিক ‍‘বেলা’। ছবির পরিচালক অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়। কেন্দ্রীয় চরিত্রে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। এ-ছবির স্বাদের ভাগ হবে না। লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

অল ইন্ডিয়া রেডিও, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজকুমার মল্লিক, ইন্দিরাদেবী, লীলা মজুমদার, আশাপূর্ণা দেবী, নীলিমা সান্যাল, জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‍‘শিশু মহল’, ‘মহিলা মহল’ আজও অনেক বাঙালির নস্টালজিয়া। ১নং গারস্টেন প্লেস-এ তখন চাঁদের হাট। আকাশবাণীর প্রথম অফিসের ঠিকানা। সেই চাঁদের হাটের মণিমুক্তোদের মধ্যে একটি মুক্তো ছিলেন সেই ‘মহিলা মহল’ খ্যাত সঞ্চালিকা বেলা দে। যাঁর জীবনসংগ্রামের সাক্ষী সেই স্বর্ণযুগ। তাঁকে জানতে পারেনি এই প্রজন্ম। আবার অনেকেই তাঁকে ভুলেও গেছেন। সাধারণ, আটপৌরে বাঙালি মেয়ে থেকে জনপ্রিয় সঞ্চালিকা এবং রান্নার বই-লেখিকা বেলা দে-র জীবনের বর্ণময় অধ্যায়ের সূচনা হয় আকাশবাণীতেই। সেই সময়ের তাঁর পরিচিতি, লোকপ্রিয়তা আজকে বসে কেউ অনুধাবন করতে পারবে না। তাঁর কণ্ঠস্বর, কথা বলার ধরনে মুগ্ধ ছিলেন শ্রোতারা। মহিলা মহলে তাঁর দেওয়া রেসিপির জন্যে বসে থাকতেন প্রতিটি বাড়ির মহিলা। দেশি-বিদেশি রান্নার রেসিপি, হারিয়ে যাওয়া রান্নার পুনরুদ্ধার, মেয়েদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলাপ-আলোচনা, আড্ডার আসরের জন্য মুখিয়ে থাকতেন মেয়েরা। সেই জিনিয়াস বেলা দে-র ব্যক্তিগত জীবন ছিল প্রতিকূলতায় ভরা তাও তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তিনি শুধু নিজের জন্য লড়াই করেননি বাংলার মেয়েদেরও লড়তে শিখিয়েছিলেন। তাঁর সেই অজানা গল্প নিয়েই সদ্য বড়পর্দায় মুক্তি পেল পরিচালক অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়ের ছবি ‘বেলা’ (Bela)।

ব্রাহ্ম গালর্সের ছাত্রী কিশোরী বেলার সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে হয়েছিল। রায়বাহাদুর হেমচন্দ্র দে-র পুত্র ধীরেনের সঙ্গে। ধীরেন তখন ডাক্তারি পড়তে বিলেত যাবেন। বাবার কথায় বিয়ে পিঁড়িতে বসলেন। যদিও বেলার মা একেবারেই চাননি এত ছোট বয়সে পড়াশুনোর আগেই বিয়ে হোক তাঁর। কিন্তু বিধিবাম। বিয়েটা হলই। ঠিক হল ধীরেন চলে যাবে লন্ডন আর ম্যাট্রিক দিয়ে বেলাও চলে যাবে স্বামীর কাছে। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হল না কোনওদিনই। প্রথম প্রথম যোগাযোগ রাখলেও একটু একটু করে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলেন ধীরেন। এর মধ্যেই বাজল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। ঠিক সেইসময় চলে গেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও। রবি ঠাকুরই যে ছিলেন বেলার একমাত্র মনের আশ্রয়। স্বামীর সঙ্গে চিঠিপত্র লেনদেন ততদিনে সব বন্ধ। তখন বেলা লন্ডনে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। সে-যুগে লন্ডন যেতে সময় লাগত প্রায় একমাস। সেখানে গিয়ে বুঝলেন দেরি হয়ে গেছে অনেকটা। স্বামী ডাঃ ধীরেন দে ততদিনে দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জার্নি শুরু বেলার। সেই মুহূর্তে ফিরে গেলেন না দেশে। বাবার পরিচিত মিসেস আরভিনের কাছে পেলেন আশ্রয়। তাঁর কাছেই বিদেশের নানান রান্নার জ্ঞান অর্জন করলেন বেলা। মিসেস আরভিন তাঁকে পরিচয় করালেন হোম সায়েন্সের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে। দেশে ফেরার আগে তিনি বেলাকে উপহার দিলেন তাঁর বড় সাধের রান্নার ডায়েরিটি। মায়ের কাছেই বাঙালি রান্নায় হাতেখড়ি হয়েছিল বেলার। ছোট্ট থেকে রেডিও ছিল বেলা সবচেয়ে পছন্দের। একদিন সেই অল ইন্ডিয়া রেডিওই তাঁর ঠিকানা হল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ছিলেন বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাড়িতে নিত্য-আনাগোনা। তিনিই একদিন তাঁকে নিয়ে এলেন আকাশবাণীতে। মনের সুপ্ত থাকা বহুদিনের ইচ্ছে পূরণ হল। সেই সময় ‘মহিলা মহল’ করতেন রেখা মেনন। একটা সময় রেখা মেননের দায়িত্ব চলে আসে বেলার কাঁধে। তখন দেশ স্বাধীন হওয়ার মধ্যরাতের জহরলাল নেহেরুর ভাষণের পরম মুহূর্তের সাক্ষীও থেকেছেন বেলা। কিন্তু রেডিওতে কাজ করতে গেলে যে দিন-রাতের হিসেব থাকলে চলবে না! এদিকে সমাজ কী বলবে? দাদারা চাইলেন না বেলা চাকরি করুক। নিজের সঙ্গে আপস করেননি বেলা। হারিয়ে যেতে চাননি কালের অতলে। বাবা, দাদার অনুমতি নিয়ে একদিন ঘর ছাড়লেন তিনি। এরপর আকাশবাণীই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান-জীবন। আজ থেকে সত্তর-আশি বছর, আগে মেয়েদের মধ্যে রান্না নিয়ে কিছু করে দেখানোর আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলছিলেন বেলা দে। এখন যাঁকে আমরা ফুড ভ্লগিং বলি সেটাই শুরু করেছিলেন উনি। দেশভাগের পর আসা লক্ষ লক্ষ শরণার্থী পরিবার বিশেষ করে সেই পরিবারের মহিলাদের পথের দিশা দেখিয়েছিলেন বেলা (Bela)।

আরও পড়ুন-বেজিং থেকে কিমের মলমূত্র নিয়ে উঃ কোরিয়া ফিরলেন তাঁর রক্ষীরা

এ ছবি দেখতে বসে আবেগতাড়িত হবেনই দর্শক। সেই হারিয়ে যাওয়া অনেক পুরনোকে ফিরে পাবেন তাঁরা। ছবির শুরুতে গপ্প মীরের আসরে। মীর এবং জগন্নাথ বসুর কথকতায় শুরু হয়েছে বাঙালির ভুলে যাওয়া সেই নারীর গল্প। কিশোরীবেলার চরিত্রে শ্রীভট্টাচার্যকে মনে থেকে যাবে সবার সঙ্গে তাঁর কিশোর স্বামী ধীরেন দে-কেও মনে থাকবে (অভিনেতা আরয়ুন ঘোষ)। এই জুটিটা যেমন মিষ্টি তেমন তাঁদের সাবলীল অভিনয়। বড়বেলার বেলা অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত যিনি এ-ছবির মেরুদণ্ড। ঋতুপর্ণার সম্পর্কে যতটা বলব ততটাই কম বলা হবে। তাঁর অভিনয় দর্শকদের চোখের কোণে জল আনবেই আনবে। এই ছবির অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলেন নীলিমা সান্যাল। যিনি ছিলেন সেই সময় দিল্লি অল ইন্ডিয়া রেডিওর বিখ্যাত সংবাদপাঠিকা। নীলিমা সান্যাল কলকাতায় থাকাকালীন ছিলেন বেলা দে-র খুব কাছের বন্ধু। সেই চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাসবদত্তা। নির্মল ভট্টাচার্যর চরিত্রে সৌরভ চক্রবর্তী ঋতুপর্ণার পাশে বেশ বলিষ্ঠ। খুব ভাল লেগেছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চরিত্রে দেবপ্রতিম দাশগুপ্তকে। এছাড়া ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, পদ্মনাভ দাশগুপ্ত, মধুজা বন্দ্যোপাধ্যায়, বুলবুলি পাঁজা— প্রত্যেকেই ভীষণভাবেই যথাযথ। যার কথা না বললে বাদ থেকে যাবে সেই পরিচালক অনিলাভ চট্টোপাধ্যায় ডেবিউ ছবিতেই গড়লেন মাইলস্টোন। কারণ এ-এক ভিন্ন স্বাদের ছবি— যে-স্বাদের ভাগ হবে না। এই ছবির সঙ্গে অন্য বাণিজ্যিক ছবির তুলনা একেবারেই চলে না। খুব ডিটেলিং রেখেছেন ছবিতে। অনেক পড়াশুনো করেছেন, ভেবেছেন এবং গোটা টিম খুব পরিশ্রম করে কালাতীত একটা বিষয়কে সহজ, স্বাভাবিক ছন্দে তুলে ধরেছেন। ছবির গানগুলো শ্রুতিমধুর। সঙ্গীত পরিচালক রণজয় ভট্টাচার্য এবং অমিত চট্টোপাধ্যায়। গান গেয়েছেন অরিজিৎ সিং, সোমলতা আচার্য চৌধুরী, ঈপ্সিতা মুখোপাধ্যায়। দর্শক-টানার রেটিং কী হবে জানা নেই তবে, মানুষের মন-টানা রেটিং বেশি হবেই এই ছবির।

Latest article