‘মন্টু পাইলট’, ‘ইন্দুবালা ভাতের হোটেল’, ‘চরিত্রহীন’, ‘দুপুর ঠাকুরপো’র মতো ভুলে যাওয়ার ওয়েব সিরিজ নয়। এগুলো দেখেননি বাংলা ওটিটি-র এমন দর্শক খুব কমই রয়েছেন। আর যাঁরা এই সিরিজগুলো দেখেছেন তাঁরা সফল পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্যকেও চেনেন। সিরিজের পাশাপাশি বাংলা ছবি পরিচালনা এবং চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনাতেও তিনি বলিষ্ঠ। তাঁর পরিচালিত ছবি ‘বাদামি হায়নার কবলে’ও সাফল্য পেয়েছে। দেবালয় ভট্টাচার্যর গল্প, ছবি, সিরিজ মানেই অন্যরকম রসদ মিলবেই মিলবে। যেমন, সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম হইচই-তে স্ট্রিমিং শুরু হয়েছে তাঁর নতুন ওয়েবসিরিজ ‘বোকাবাক্সতে বন্দী’ (Bokabaksho te bondi)। এটি একটি সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার। এমন একটা সিরিজ যার সঙ্গে এযুগের মেগা ধারাবাহিকের অভিনেতা, অভিনেত্রী থেকে দর্শক নিজেকে ভীষণভাবে রিলেট করতে পারবেন। টিআরপি-লড়াইতে টিকে থাকতে বছরের পর বছর চলতে থাকা মেগা সিরিয়ালের চরিত্রেরা কীভাবে রিল আর রিয়েল লাইফে একাকার হয়ে যায় এবং অতি সাধারণ পরিবারের মা, বোনেরাও সেই ধারাবাহিককেই নিজের জীবন বানিয়ে ফেলেন এটাই এই ওয়েব সিরিজে বলার জায়গা। বাস্তব ঘেঁষা একটা প্লট যার উপস্থাপনটাও খুব নিখুঁত। দেখলে মনে হবে আরে এটাই তো হয়! ‘বোকাবাক্সে বন্দী’র গল্পের প্লটটা আসলে একটা মেগা ধারাবাহিক নির্মাণেরই রোজনামচা। যেখানে রিল আর রিয়েল লাইফের নায়িকার জীবনচর্চা, রিয়েল হাজব্যান্ড এবং রিলের হাজব্যান্ড-এর সঙ্গে সম্পর্কে রসায়ন, মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন, সংঘাত, রহস্য, প্রেম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এমনভাবে যে দর্শকেরাও গুলিয়ে ফেলবেন যে কোনটা রিল আর কোনটা রিয়েল।
ওয়েব সিরিজটা দেখতে বসে প্রথমেই মনে পড়ে যায় মহীনের ঘোড়াগুলি-র সেই বিখ্যাত গানের কথাগুলো। ‘পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে, স্যাটেলাইট আর কেবলের হাতে, ড্রয়িংরুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দী’ (Bokabaksho te bondi) গানটা সাত, আটের দশকের এই গান বাঙালিকে কী ভয়ঙ্কর সত্যি কথা ভবিষ্যৎ-বাণী করেছিল আজ কিন্তু তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন সকলে। সন্ধে নামলেই রিমোট হাতে টিভির সামনে বসে নিবিষ্ট মনে ধারাবাহিকের চরিত্র হয়ে ওঠা বহু মানুষের কাছেই তাই দেবালয়ের এই সিরিজে হয়ে উঠবে অতি-পরিচিত ছবি। এই ওয়েব সিরিজ প্রসঙ্গে পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘যন্ত্রের যন্ত্রণা নিয়ে আসলে গল্পটা। আমি থ্রিলার পড়তে এবং দেখতে অতটা ভালবাসি না। তবে, ছোটবেলায় রহস্যগল্প পড়তাম খুব। এখন, থ্রিলার বানাতে ভালবাসি। অন্যরকম কনটেন্ট। নামটাতেই বোঝা যাচ্ছে। অনেকেই নিজেকে রিলেট করতে পারবেন সিরিজটির সঙ্গে।’
ওয়েব সিরিজের গল্পের শুরু অপালাকে দিয়ে। যে কিনা জনপ্রিয় ধারাবাহিক ‘মন সোহাগের ঘর’-এর সন্ধ্যামণি। এই মেগাতে অভিনয় করেই অপালা এতদিন পর্যন্ত সংসার চালিয়েছে ,স্বামী, শাশুড়ির সব দায়-দায়িত্ব পালন করেছে। কিন্তু আসলে এই জীবনটা কোনওদিন চায়নি সে। মেগা ধারাবাহিকের দায়িত্ব কাঁধে টানতে গিয়ে তার সংসারচর্চা একপ্রকার ব্যাহতই হয়েছে। তাই সে চেয়েছে রিল লাইফের সন্ধ্যামণির খোলস ছেড়ে আবার অপালা হয়ে উঠতে। একটা সুখের সংসার গড়ে তুলতে। স্বামী, সন্তান নিয়ে আগামীর সুখী গৃহকোণের স্বপ্নে বিভোর অপালা সিরিয়াল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু শ্যুটের শেষ দিনে সেটে গিয়েই যেন সব গুলিয়ে গেল। অস্তিত্বের সংকটে পড়লেন নায়িকা অপালা এবং চরিত্র সন্ধ্যামণি। আসল-নকলের ঘেরাটোপে বন্দি হলেন তিনি। শ্যুটিং সেট মুহূর্তে ভ্যানিশ। সন্ধ্যামণির স্বামী ইন্দ্র হয়ে উঠল তাঁর বাস্তবের স্বামী আর চৌধুরী পরিবারের বিশাল সেটটাই তার রিয়েল সংসার এবং সেখানকার লোকজনেরা তার স্বজন। হঠাৎ করেই সে দেখল সে অপলা নেই কখন সন্ধ্যামণি হয়ে গেছে। অপালার জীবনের বাস্তব আর তার কল্পনা এক নিমেষে গেল তালগোল পাকিয়ে। একইসঙ্গে ওটিটির পর্দায় চোখ রাখা সিরিজের দর্শকও গুলিয়ে ফেললেন সবটা। এটাই এই সিরিজের মজা। রিল আর রিয়েলের দড়ি-টানাটানি। এই টানাপোড়েনটাই বাস্তব। আমরা দর্শকেরা এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এমন টানাপোড়েনেই তো ভুগি। সিরিয়ালের চরিত্রে, পরিবার সব হয়ে যায় আমাদের পরিবার আর অভিনেতা বা অভিনেত্রীরা একটা চরিত্রে অভিনয় করতে করতে কোথাও যেন বাস্তবেও হয়ে ওঠেন সেই চরিত্রটির। ব্যাস বোকাবাক্সেই বন্দী হয়ে যাই সবাই। ছাড় পেতে চাইলেও সম্ভব হয় না। গভীর মনস্তত্ত্বের এই সিরিজ দর্শককে ভাবাবে।
আরও পড়ুন: প্রশ্ন কেলেঙ্কারির পান্ডার বাড়িতেই থাকত ভোলেবাবা
এই সিরিজ প্রসঙ্গে অভিনেত্রী সোলাঙ্কি রায় বললেন, ‘যে কোনও পেশাতেই আমরা থাকি না কেন রোজ কেউ মোটিভেশন পাই না। এক ধরনের কাজ করতে করতে একঘেয়েমি আসেই। আমরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের কাজের জায়গাতে একটা রোল প্লে করি। তাই প্রত্যেকের মধ্যেই জীবনের কোনও না কোনও সময় এই অস্তিত্বের সঙ্কট হয়তো আসে যে কোনটা আসল আমি বা আমি কে? আমিও ওই প্রশ্নটার মধ্যে দিয়েই যাই একজন মানুষ হিসেবে, একজন অভিনেত্রী হিসেবে। বাক্সটা আসলে বোকা মানুষটা নয় তাই সে উত্তর খুঁজতে থাকে। নতুন কনসেপ্ট আশা করি দর্শকদের ভাল লাগবে।
প্রসঙ্গত এই ওয়েব সিরিজের হাত ধরে কামব্যাক করলেন জনপ্রিয় টেলি অভিনেত্রী সোলাঙ্কি রায়। এর আগে ‘গাঁটছড়া’ ধারাবাহিকে তাঁকে শেষ অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল। দীর্ঘদিন ব্রেকের পর আবার তাঁকে দেখতে পাবেন দর্শক। এই সিরিজে সোলাঙ্কি রায় ছাড়াও রয়েছেন ছোটপর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা নীল ভট্টাচার্য এবং সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিনেত্রী সন্ধ্যামণির রিয়েল লাইফে অপালার স্বামীর ভূমিকায় রয়েছেন সৌম্য। এই সিরিজে ‘আমি কে’ নামে নতুন একটি গান সম্প্রতি রিলিজ করেছে যেটা বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। গানটি গেয়েছেন ইন্দ্র। গানটি কম্পোজ করেছেন অমিত চ্যাটার্জি। সর্বোপরি বলা যায় সিরিজটা দর্শককে ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়াবে। কোনটা রিল আর কোনটা রিয়েল গুলিয়ে দেবে। সিরিজটা দেখতে বসে একটা আলাদা কৌতূহল তৈরি হবে রিল আর রিয়েলকে জানার। এটাই গল্পের প্লাস পয়েন্ট। এটাই আপনাকে বসিয়ে রাখবে সিরিজটা দেখার জন্য।