‘ময়দান’ ছবির স্মৃতি এখনও তাজা দর্শক মনে। ছবিটি ফুটবল কোচ সৈয়দ আব্দুল রহিমের বায়োপিক। ছবিটি মুক্তির পর যথেষ্ট প্রশংসা পেয়েছে, এতে অভিনেতা অজয় দেবগণের অভিনয়ও বেশ চর্চিত ছিল কিন্তু তাঁকে পিছনে ফেলে বাজিমাত করলেন কার্তিক আরিয়ান। সদ্য মুক্তি পেয়েছে তাঁর অভিনীত স্পোর্টস ড্রামা ‘চান্দু চ্যাম্পিয়ন’। এটিও একটি বায়োপিক। সমালোচক থেকে দর্শক সবার মধ্যে সাড়া ফেলে দিয়েছে ছবিটি। কিছু মাস আগে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ময়দান’-এর চেয়ে বেশ ভাল স্কোর তুলছে বক্স অফিসে ‘চান্দু চ্যাম্পিয়ন’ (Chandu Champion)।
বলিউড, টলিউড জুড়ে এই মুহূর্তে শুধু বায়োপিক-এর হাওয়া। লেজেন্ডদের নিয়ে ছবি করার একটা ট্রেন্ড চালু হয়েছে। সেই ট্রেন্ডের হাওয়াতেই রিলিজ করল পরিচালক কবীর খানের ছবি ‘চান্দু চ্যাম্পিয়ন’। প্রতিটা বায়োপিকই দর্শকদের অনুপ্রেরণা জোগায়। ছবি দেখতে দেখতে রক্ত গরম হয়ে ওঠে। কিন্তু ‘চান্দু চ্যাম্পিয়ন’ এমন এক কাহিনি যেটা বিশ্বাস করা খুব কঠিন। আর তাতে অভিনয় করাটাও ঠিক ততটাই কঠিন। ছবিতে চান্দুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন কার্তিক আরিয়ান। ২০১১-তে ‘প্যায়ার কা পঞ্চনামা’ ছবির মাধ্যমে বলিউডে পা রাখেন কার্তিক। তারপর থেকে যে ক’টা ছবি করেছেন এখনও পর্যন্ত সবগুলোই বেশ চর্চিত। তাঁর ফ্যান ফলোয়ার খুব কম নয়। এ বছর তাঁর কেরিয়ারের সেরা ছবিটি উপহার দিলেন দর্শকদের। একথা তিনি নিজেও বলেছেন বারবার।
কেন কার্তিক আরিয়ানের কেরিয়ারের এটা সেরা ছবি তা জানতে হলে আগে জানতে হবে কে এই চান্দু চ্যাম্পিয়ন? কী তাঁর গল্প?
ভারতের প্রথম প্যারা অলিম্পিক ফ্রি-স্টাইল সুইমিং-এ গোল্ড মেডেলিস্ট, পদ্মশ্রী হলেন মুরলীকান্ত পেটকর। এটা তাঁরই বায়োপিক।
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতের মহারাষ্ট্রের সাংলি এলাকার ইসলামপুরে মুরলীকান্তের জন্ম। ছোট থেকেই তাঁর চোখে একটাই স্বপ্ন ছিল অলিম্পিক খেলে ভারতের জন্য পদক আনা। তাঁর আদর্শ তখন ছিলেন দারা সিং। পালোয়ান হবার প্রচেষ্টায় হাসির খোরাক হতেন মুরলী আর ব্যঙ্গ-কৌতুক করেই সবাই তাঁকে বলত ‘চান্দু চ্যাম্পিয়ন’। চান্দু মানে হেরো। হেরো তকমা পাওয়া মুরলী হাল ছাড়েননি। যোগ দিয়েছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। উদ্দেশ্য একটাই ছিল খেলোয়াড় হবেন। কিন্তু জীবন তো অত সহজ নয়। আমরা ভাবি এক, হয় আর এক। মুরলীকান্তের জীবনেও তেমনটাই ঘটল। ১৯৬৫-র ভারত-পাক যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায় তাঁর শরীর। ৯টি বুলেট লেগেছিল তাঁর। প্রায় দু’বছর কোমায় চলে যান এরপর যখন জ্ঞান ফেরে ততদিনে তিনি হারিয়ে ফেলেছেন তাঁর স্বাভাবিকভাবে চলা-ফেরার শক্তিটুকুও। ভাগ্যের এই চরম পরিহাস মানতে চাননি তিনি। মনের জোরে আবার ঘুরে দাঁড়ান। কুস্তিগির থেকে বক্সার তারপর হলেন সাঁতারু। সেই সুইমার হিসেবে ‘চান্দু চ্যাম্পিয়ন’ হওয়ার লক্ষ্যে কীভাবে পৌঁছলেন তিনি, কীভাবে পদ্মশ্রী খেতাব পেলেন সেটা নিয়ে এই গল্প।
আরও পড়ুন- মেয়র ও আমলাদের সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ
ছবিতে মুরলীকান্তের চরিত্রটা বেশ চ্যালেঞ্জিং। সেই চরিত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে কোনও ফাঁক রাখেননি কার্তিক। উজাড় করে দিয়েছেন নিজেকে। মুরলীকান্ত হয়ে উঠতে নিজের চেহারার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। চান্দুর মতো অমন পেশিবহুল দেখতে হয়ে ওঠা খুব সহজ ছিল না তাঁর জন্য। সেই কারণে গত দু বছর ছেড়েছিলেন তাঁর প্রিয় মিষ্টি। সম্পূর্ণ চিনি বর্জিত ডায়েট করেছেন তিনি। ৩৯ শতাংশ বডিফ্যাট থেকে ৭ শতাংশ বডিফ্যাটে পরিণত হওয়ার সেই সফর কতটা কঠিন ছিল তা শুধু তিনিই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। পরবর্তীতে এ-প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি যে চরিত্রটায় অভিনয় করলাম সেই চান্দু কখনও হার মানে না। মুখ থুবড়ে পড়ে, হোঁচট খায় কিন্তু আবার উঠে দাঁড়ায়। না জেতা পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যায়, ছোট থেকে তেমনই হতে শিখেছি আমি। ছবিটা করার সময় মনের উপরেও অনেক চাপ পড়েছিল। কখনও কখনও আত্মবিশ্বাসের অভাবও হয়েছে, ভেবেছি পারব তো! কিন্তু সত্যি পেরেছি।’
কঠোর পরিশ্রমে কার্তিক আর চান্দু (Chandu Champion) কখন যেন মিলেমিশে এক হয়ে গেছে তাই এই ছবির চ্যাম্পিয়ন তিনিই। প্রথম সপ্তাহে বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়লেও ইতিমধ্যেই আয়ের সংখ্যার বিচারে ৩০ কোটির গণ্ডি পার করে গেছে কবীর খানের এই ছবি। ছবির বক্স অফিস কালেকশন সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে ৩০•১২ কোটি। এক থা টাইগার এবং বজরঙ্গি ভাইজানের মতো ব্লকবাস্টারগুলির জন্য পরিচিত, কবীর খানের শেষ ছবি ৮৩ বক্স অফিস আয় এর চেয়ে কম ছিল।
ছবিটির চিত্রনাট্য সাজিয়েছেন কবীর খান, সুমিত অরোরা ও সুদীপ্ত সরকার। প্রযোজনায় সাজিদ নাদিয়াদওয়ালা, ফিরুজি খান। এই ছবিতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিজয় রাজ, যশপাল শর্মা, রাজপাল যাদব, শ্রেয়াস তলপড়ে, সোনালি কুলকার্নি প্রমুখ। ছবির সঙ্গীত পরিচালক প্রীতম। গীতিকার অমিতাভ ভট্টাচার্য, আই পি সিং, কৌসর মুনির।
২০২০-র ১৪ জুন সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু হয়। সেই সুশান্তের চতুর্থতম মৃত্যুবার্ষিকীতে মুক্তি পেল ‘চান্দু চ্যাম্পিয়ন’ (Chandu Champion)। প্রসঙ্গটা ওঠবার কারণ কবীর খান এই ছবিটির জন্য প্রথমে নির্বাচন করেছিলেন সুশান্তকেই। তাঁর কাছেই এসছিল প্রস্তাব। চিত্রনাট্য শুনেই রাজি হয়ে যান সুশান্ত। অভিনেতা একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘গল্পটা শুনেই আমি রাজি হয়ে যাই। কী অপূর্ব অনুপ্রেরণা জোগানো একটি ছবি!’ ‘এম এস ধোনি’-তে অভিনয়ের পরে এমনই একটি চরিত্রে অভিনয় করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই ইচ্ছে তাঁর আর পূরণ হয়নি। বিধির বিধান ছিল অন্য। তাই ছবিটা আর করা হয়নি তাঁর। অবশেষে কার্তিকের ঝুলিতে আসে সেই অফার। যেহেতু চতুর্থতম মৃত্যুবার্ষিকীতে ছবিটি মুক্তি পেল নেট নাগরিকদের মতে এই ছবি যেন একপ্রকার তাঁকেই উৎসর্গ করা হল। এরপর কার্তিকের ঝুলিতে আসে এই ছবি। কার্তিককে নিয়ে পরিচালক যথেষ্ট আশাবাদী ছিলেন তাঁর ভরসাও ছিল। তিনি কার্তিকের প্রশংসা করতে গিয়ে শেয়ার করেছেন, ‘ছবিটিতে যুদ্ধের একটি সিকোয়েন্স রয়েছে যা আট মিনিটের। এটি একটি একক শট, এতে কোনও কাটা নেই। এর জন্য প্রচুর প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল। কার্তিককে ২০০-৩০০ সৈন্যের সঙ্গে মহড়া দিতে হয়েছিল। কাশ্মীরের আরু উপত্যকায় ১০০০০ ফুট উচ্চতায় তাঁকে মহড়া দিতে হয়।’ এই কঠোর পরিশ্রমই তাঁকে সেরার সাফল্য এনে দিয়েছে ।