এজগতের সবচেয়ে নিটোল, অপত্য, নিখাদ সম্পর্ক হল মা আর সন্তানের সম্পর্ক। মা নিজের সবটুকু দিয়ে একটা শিশুকে বড় করে তোলে, জগতের সব অন্ধকার কালিমা থেকে সন্তানকে আগলে রাখে, সব ত্যাগ শুধু মা-ই করে। ‘মা’-এর কোনও অপরাধ থাকতে পারে না। তাই মা শব্দটি যতই ছোট্ট হোক তার ভার অনেক। কিন্তু মাতৃত্বের ভিত কি শুধু রক্তের সম্পর্কের মধ্যে আটকে থাকে? ঔরসজাত সন্তানই কি সব? তা নয়, মাতৃত্ব এক অনুভূতি তাই মা না হয়েও মায়ের মতোন যাঁরা তাঁদের কাছেও সেই রসদ পূর্ণ করে রাখেন ভগবান। তাও মাতৃত্বের সেই সহজ বৃত্তিকে মেনে নিতে পারেন না বহু নারী। আপন-পরের দ্বিধায় ভোগেন। রক্তের সম্পর্ক না ভালবাসার টান… পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর ছবি ‘ডিয়ার মা’ এমনই এক প্রশ্নের সম্মুখীন। এক মা আর তাঁর দত্তক নেওয়া মেয়ের জীবনযাপন, টানাপোড়েন, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, ভালবাসা বা কোথাও একটা ভালবাসতে না পারার সমীকরণ নিয়ে তৈরি এই ছবি। এই ছবি সম্পর্কের এক গভীর মনস্তত্ত্বের। অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী এমন ধরনের ছবি করতেই বেশি অভ্যস্ত। তাঁর ছবির একটা চেনা ছক রয়েছে, সে-ছকেই তিনি এঁকেছেন ‘ডিয়ার মা’কে (Dear Maa)।
দশমাস দশদিন গর্ভে ধারণ করে একটি শিশুর জন্ম দেওয়া আর একটি শিশুকে দত্তক নেওয়া— এই দুইয়ের সূক্ষ্ম তফাতের মাঝে দাঁড়িয়ে এই ছবির কেন্দ্রীয় নারী চরিত্র বৃন্দা মিত্র। একটি কোম্পানির কো-ফাউন্ডার তিনি। বৃন্দার স্বামী অর্ক প্রয়াত। একটা সময় বৃন্দা এবং অর্কর পশার ভালই ছিল। কিন্তু কেরিয়ারিস্ট হয়েও অর্ক চাইত বাবা হতে, এদিকে বৃন্দা একেবারেই তা চাইত না। নিজের উজ্জ্বল কেরিয়ারকে সন্তানের জন্য কম্প্রোমাইজ করার কোনও সদিচ্ছা তার ছিল না। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে কেরিয়ারের সঙ্গে আপস করাকে আমল দিতে চায়নি বৃন্দা। কিন্তু অর্কর চাওয়া-পাওয়া, নিত্যদিনের টানাপোড়েনে শেষমেশ বৃন্দা এবং অর্ক সন্তান দত্তক নেবার সিদ্ধান্ত নেয়। একটি মেয়েকে দত্তক নেয় তারা। ছোট্ট একরত্তি সেই মেয়ে অর্কর জীবন ভরিয়ে দেয়। বাবার স্নেহচ্ছায়ায়, পরিবারের দীর্ঘদিনের সহয়িকা নির্মলার কাছে বড় হতে থাকে ঝিমলি। মা হিসেবে বৃন্দা সেই মেয়েকে গ্রহণ করলেও দত্তক নেওয়া সন্তানের প্রতি কোথাও একটা টানের অভাব বোধ করত সে। আবার তারই ব্যস্ততম জীবনের কারণে সেই সন্তান তাকে চিনতে শিখছে না, তার সঙ্গে কোনও বন্ধন গড়ে উঠছে না এই ভাবনাও বৃন্দাকে অস্বস্তি দিত।
আরও পড়ুন-কৃত্রিম উপগ্রহ নিসার-এর অভিযানে বাংলার কৌশিক
এমনই হঠাৎ একদিন সকালে অর্ক না ফেরার দেশে চলে যায় তখন বৃন্দার মনে হয় মেয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে ওঠা দরকার কিন্তু বৃন্দার ব্যস্ততার কারণে তা হয়ে ওঠে না। ঝিমলি নির্মলার সাহচর্যে বড় হতে থাকে। আর বাড়তে থাকে মা-মেয়ের দূরত্ব। অর্ক চলে যাবার পর যখন বৃন্দা ভাবতে শুরু করে এবার সে শুধুই তার মেয়েকে আঁকড়ে ধরে বাঁচবে ঠিক সেই সময় হঠাৎ একদিন নিখোঁজ হয় বারো বছরের কিশোরী ঝিমলি। বৃন্দা নিখোঁজ ডায়রি করতে যায় থানায়। ইনস্পেক্টর অসিতাভ নন্দীর সঙ্গে কথা হয় তার। শুরু হয় পুলিশি তদন্ত। এই ছবির শুরুটা হয়েছে এই পুলিশ বা পুলিশি তদন্তের শুরু থেকে। পুরো গল্পটা ফ্ল্যাশব্যাকে দেখিয়েছেন পরিচালক। কোথায় গেল ঝিমলি? পালিত বাবার মৃত্যুর পর অবসাদে, যন্ত্রণায়, একাকিত্বে কি সে পালিতা মাকে ছেড়ে চলে গেল? কাকে ভয় পেত ঝিমলি? কোন অজানা ভয় তাকে তাড়া করে বেড়াত? বৃন্দা মেয়েকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিল কিন্তু যখন চেষ্টা করল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে! তাহলে এরপর কী হবে! কীভাবে এগবে ঘটনাক্রম! এই সব কিছুর উত্তর রয়েছে অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর ‘ডিয়ার মা’ (Dear Maa) ছবিতে। এই ছবির কাহিনি, চিত্রনাট্য অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী এবং শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যের। আধুনিক সমাজ, সমাজব্যবস্থা, দত্তক নেওয়া নিয়ে আজও যে সোশ্যাল ট্যাবু— পারপার্শ্বিক পরিস্থিতি সেই সব কিছু পরতে পরতে উঠে এসছে এই ছবিতে।
প্রায় ১০ বছর পর বাংলা ছবিতে ফিরলেন অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী। আর এই ফেরা মনে থেকে যাবে দর্শকদের। কারণ ‘ডিয়ার মা’-এর (Dear Maa) সঙ্গে নিজেকে রিলেট করতে পারবে দর্শক। রক্তের সম্পর্কই কী সব, না ভালবাসার টান আত্মার বন্ধন— এই প্রশ্নের মুখোমুখি হবেন তাঁরা। এই ছবির সূচনা থ্রিলারের মতো করেই তারপরে ধীরে ধীরে মনস্তাত্ত্বিক উন্মেষ। এই ছবির আবেগ নির্মেদ ঝরঝরে— খুব স্মার্ট। ছবিতে অনবদ্য জয়া আহসান। তাঁর অভিনয়ের বলিষ্ঠতা নিয়ে বলার কিছু নেই। দারুণ অভিনয় করেছেন অর্ক অর্থাৎ অভিনেতা চন্দন রায় সান্যাল, ইনস্পেক্টরের চরিত্রে শাশ্বত খুব ভাল। শিশুশিল্পী অহনা এবং নন্দিকা দাস অসাধারণ। এঁরা ছাড়াও রয়েছেন ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, অনুভা ফতেপুরিয়া, পদ্মপ্রিয়া জানকী রামন, সায়ন মুন্সি প্রমুখ। বিক্রম ঘোষের আবহ সঙ্গীত ছবিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে। তাঁর সুরারোপিত গানগুলো শুনতে বেশ ভাল লাগে। ক্যামেরায় রয়েছেন অভীক মুখোপাধ্যায়। ছবিটা বহুদিন মনে থেকে যাবে দর্শকদের— এটা বলাই যায়।